ভালো নেই বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিরা দুর্নীতি অনিয়ম ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগে অন্তত ৭০ জন অপসারণ

দুর্নীতি, অনিয়ম, মামলা-মোকদ্দমা, পুলিশি হয়রানি সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোট থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এখন ভালো নেই। গত কয়েক মাসে সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা এবং সিটি করপোরেশন মিলিয়ে অন্তত ৭০ জনেরও বেশি জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে পরিষদের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ, অর্থ আÍসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত থাকার মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

অবশ্য সাময়িক এই বরখাস্তের বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক বিবেচনায় হচ্ছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্থানীয় সরকারের বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে চার্জশিট হলেই জনপ্রতিনিধিরা বরখাস্ত হচ্ছেন। কিন্তু চূড়ান্তভাবে মামলার ফলাফল কী হবে- এটা কেউ জানেন না। আর এসব মামলা নিষ্পত্তি হতে হতে আরেকটা নির্বাচনের সময় চলে আসে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আইনি বিধানটির অপব্যবহার হচ্ছে। এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ বলেন, যদিও রাজনৈতিকভাবে মামলা দিয়ে বিরোধী পক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, অন্যদিকে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট অনেকে মামলা মাথায় নিয়ে মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচিত হচ্ছেন। আবার কারও কারও মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তাতে করে এটা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে এক ধরনের অকার্যকর করে দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে সারা দেশে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত ২৭ জন চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সময়ে উপজেলা পরিষদের ১১ জন ভাইস চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সারা দেশে ২৩৩টি পৌরসভার মধ্যে খ ও গ শ্রেণির পৌরসভার ১৩ মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ইউনিয়ন পরিষদের বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যানকেও একইভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অবশ্য পৌরসভার বরখাস্তকৃত মেয়রদের অনেকে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ সাময়িক স্থগিত করিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তবে তারা স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছেন না। লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ চালালেও অনেকেই আছেন আÍগোপনে। আবার এমন অনেক মেয়র আছেন যারা আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে খুশি করে তবেই নিজেদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন গোপনে গোপনে।

সূত্র জানায়, গত বছর অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর গত ঈদের আগ পর্যন্ত সারা দেশে ২৭টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। বরখাস্তকৃত চেয়ারম্যানরা হলেন- রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মো. আবু সাইদ চাঁদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোখলেসুর রহমান, শিবগঞ্জ উপজেলার মো. কেরামত আলী, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার মো. মাজেদুর রহমান, পলাশবাড়ীর আবুল কাওছার মোহাম্মদ, গোবিন্দগঞ্জের ফারুক কবির আহমদ, গাইবান্ধা সদরের আবদুল করিম, বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার মো. নূরুল ইসলাম, গাবতলীর মোর্শেদ মিলটন, দুপচাঁচিয়ার আ. গনি মণ্ডল, সোনাতলার এ কে এম আহসানুল তৈয়ব জাকির, পাবনার চাটমোহরের হাসাদুল ইসলাম হীরা, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান সারওয়ার জাহান চৌধুরী, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান মো. নূরুল করিম, পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার নজরুল ইসলাম এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল বারী। এ ছাড়া সাময়িক বরখাস্তকৃত ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে রয়েছেন- উখিয়ার সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, বগুড়ার শাজাহানপুরের জহুরুল ইসলাম ও আদমদীঘির ইউনছ আলী, গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর আবুল তালেব সরকার, শেরপুরের আরিফুর রহমান মিলন ও দুপচাঁচিয়ার মোত্তালেব হোসেন, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার শাহজাহান আলী, খুলনার ফুলতলার গাওসুল আজম মোল্লা এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান প্রেম সাগর হাজরা। বরখাস্তকৃত এই চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের সবাই সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা ও সদস্য। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছিল তাতে এসব জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা এবং মদদ ছিল বলে অভিযোগ আছে। এদের প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইন, বিস্ফোরক আইন ও অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগেও একাধিকজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, পৌরসভার মেয়রদের বরখাস্তের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এ কারণে গত কয়েক মাসে সারা দেশের ১৭টি পৌরসভার মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ঈদের আগে বরখাস্ত করা হয়েছে বরগুনার বেতাগী পৌরসভার আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র আলতাফ হোসেন, সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌর মেয়র আকতারুল ইসলাম ও রাজশাহীর কাঁটাখালী পৌরসভা মেয়র মাজেদুর রহমানকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বরখাস্তকৃত মেয়রদের মধ্যে অনেকেই সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এদেরই একজন হচ্ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র শামীম কবির হেলিম। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র বিস্ফোরক আইনে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। তিনি বরখাস্তের বিরুদ্ধে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে এলাকায় অবস্থান করলেও কখনোই পৌরসভার কোনো সভায় উপস্থিত হন না। শুধু গোপনে গোপনে গুরুত্বপূর্ণ নথিতে স্বাক্ষর করেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ঈদের আগে বরখাস্তকৃত কাঁটাখালী পৌরসভার মেয়রও উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের স্থগিতাদেশ নিয়েছেন।গত মহাজোট সরকারের সময় অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়ররা নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে তিনজন সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তারা হলেন- সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান। তাদের মধ্যে আরিফুল হক ও মান্নান কারাগারে আছেন। সিলেটের মেয়রকে বরখাস্ত করা হয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত হওয়ার পর। মান্নানকে বরখাস্ত করা হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে। একই অভিযোগে বরখাস্ত রাজশাহীর মেয়র বুলবুলও। তিনি এখন আছেন আত্মগোপনে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর