হাওরবাসীর সঙ্গে ফসল-প্রতিরক্ষা চুক্তি করবে কি রাষ্ট্র

লক্ষণ শুভ না। ধানের রাজধানী হাওরাঞ্চলের ফসল ভেসে গেছে বন্যায়, উত্তরে নদী-শুকানো খরা। এদিকে ফেসবুকে মাতমের বিষয় নায়িকা অপুর সংসার। ওদিকে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের রঙ্গিলা আমেজ। নববর্ষের রসনার আকর্ষণ যে ইলিশ, তা হাওরে হয় না; কিন্তু পান্তার ভাতটা কৃষকেরাই ফলিয়ে থাকেন। বাংলা সনের শুরুতেই হাওরবাসী লাখ লাখ মানুষের পেটে ভাত না জুটলেও আমাদের পান্তা-বিলাস বেসুরো হবে না। আমরা ভাত খাই বটে, কিন্তু ধান ফলাই না। এই আমরা মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ, এই আমরা শহর-নিমশহরের মানুষ। বা গ্রামে থাকলেও যাদের আছে ডিশ টিভি আর ইন্টারনেট চালানোর খরচ, তারা উটপাখির মতো মুখ লুকাতে পারে টিভিতে আর স্পর্শসুখ পেতে পারে ডিজিটাল টাচস্ক্রিনের। আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই মাটির সঙ্গে, পানির সঙ্গে, আবহাওয়ার সঙ্গে। আমাদের সম্পর্ক বাজারের সঙ্গে। চালের দাম যতই বাড়ুক, বাজারে ডাঁট বজায় রাখার তৌফিক আমাদের আছে।

আমরা হয় রোমান্টিক, না হয় ফ্যান্টাস্টিক। ঝড়-বাদলে আমাদের মন তা তা থই থই করে নেচে ওঠে। বন্যার অপার জলরাশির ফটোগ্রাফিক বিউটি মাত করে রাখে আমাদের। কলকাতার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গুজরাটের বন্যা নিয়ে লিখেছিলেন, ‘ইন্দিরা, তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে যেতে পারে, বাঃ, কী সুন্দর!’ (ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

এই ‘আমরা’, মানে ‘আমার’ মতো আমরা। সংখ্যায় কম হলেও কী নিয়ে তর্ক করতে হবে আর কী নিয়ে চুপ থাকতে হবে, তা ঠিক করার মহাজন আমরাই। আমাদের নীরবতাকে ষড়যন্ত্র বলার কেউ নেই। আমরাই মিডিয়া আবার আমরাই পাঠক-দর্শক। আমরা সব্বাই খুব সচেতন। সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বড়বাজারের বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে উকিল-মোক্তার-ডাক্তার, সক্কলে যার যার স্বার্থ নিয়ে হিয়া থরো থরো আছি। এই আমাদের জন্যই এবারের বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের স্লোগান দেওয়া হয়েছে, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’। কথাটা সাংস্কৃতিকভাবে খুবই সুন্দর। আনন্দ, সত্য, মঙ্গল তো সংস্কৃতির মধ্যেই তালাশ করব। যে লাখো কৃষক আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা হঠাৎ-ঢলের মুখে মুখ ব্যাদান করে আল্লাহ-ভগবান ডাকছেন, তাঁদের আমাদের সুন্দর লাগার কথা নয়। যাঁরা তিতুমীরের মতো পানিতে বাঁশের কেল্লা বানিয়ে লড়ছেন, তাঁদের নেংটি-পরা কালোকেষ্ট মূর্তি আমাদের ভালো লাগার নয়। চোখের সামনে ঢেউখেলানো ফসলের মাঠে সাপের ফণার মতো বেনো জল দেখে যাঁদের বুক-চোখ শুকিয়ে যায়, তাঁরা অসংস্কৃত। চাষার ভূষা বা পোশাকও তো সুন্দর নয়। আমাদের সংস্কৃতি থেকে তাঁরা বাদ, আমাদের আনন্দ ও মঙ্গল থেকে তাঁরা বাদ। তাঁদের জন্য প্রকৃতির লাণত আর আমাদের জন্য অফুরান উৎসব।

কিন্তু অন্য ধরনের সুন্দরের জন্ম দিয়ে চলে কৃষকের কৃষ্টি। হাওরাঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত এক কৃষক পরিবারের কন্যা চিত্রকর পূরবী তালুকদারের লেখা থেকে ভাগ করে নিচ্ছি, ‘হাওড় অঞ্চলের মানুষের অনেক বড় একটা পার্বণ এই বৈশাখ, উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন চালের ভাত মুখে দেয় প্রতিটি পরিবার। চৈত্র মাসের শেষের দিক থেকে শুরু হয় ধান কাটার উৎসব—খলায় থাকে নানা জাতের ধান আর গলায় বিভিন্ন সুরের গান। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে সকালে পাঁচ তরকারি (গিমাই শাক, কাঁচা কাঁঠাল, আম-ডাল, ছোট মাছ, বেগুন ভাজি) আর ভাত রেঁধে আর বিকেলে ষাঁড়ের লড়াই (আড়ং) দিয়ে বৈশাখকে বরণ করে নেয় হাওড়ের মানুষ। ঠিক একই নিয়মে শেষ দিনে বিদায় জানানো হয় বৈশাখকে। হাওড়ে এই দুটি উৎসবকে বলা হয় আগ-বিষু আর শেষ-বিষু। গভীর রাতে শোনা যায় দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির সুর।’ সূত্র (বৈশাখে হাওড়বাসীর পাতে কী থাকবে?)

কিন্তু যাকে বলা হচ্ছে শুদ্ধ সংস্কৃতি, সংস্কার করতে করতে তা বর্তমানে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন তার উৎস ও জমিন যে কৃষ্টি, তা থেকে। কৃষ্টি কথাটার অর্থ কর্ষণ তথা চাষবাস। যা কিছুকে বাঙালিত্ব বলি, তার চৌদ্দ আনায় কৃষকজীবনের সৌরভ। কৃষির আবহেই জন্ম বাউল এবং ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি, মুর্শিদি-মারেফতির। এই হাওরের চাষার ঘর থেকেই জন্মান একজন বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম। চাষার কৃষ্টিতে যে মর্মের বেদন, তার সঙ্গে আনন্দলোকে বিরাজ করা শহুরে সুখীজনের সংস্কৃতির যোজন যোজন ফারাক। বেদনালোকের সত্য এবং আনন্দলোকের চিত্র এক নয়। তবে এত কিছুর মধ্যেও হাওরাঞ্চলের মানুষ রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর এলাকার কৃষকের দুর্দশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে সুরাহার কথা তুলেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ।

এবারে ইলিশের দাম চড়া। কিন্তু হাওরে বাঁধ ভাঙার জন্য দায়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু দুর্নীতিপ্রাণ কর্মকর্তা এবং তাঁদের সহযোগী ঠিকাদারদের অসুবিধা হবে না। সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ২০ শতাংশ ঘুষ দিয়ে সময়মতো বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের কাজ শেষ করা হয়নি। যে কাজে ২০ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়, সেখানে ঠিকাদারের দুর্নীতি কত শতাংশ হবে, তা অনুমান করা কঠিন না। গত বছরও ফসল মার গিয়েছিল নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ বিশাল হাওরাঞ্চলে। এবার তাই কৃষকেরা আগাম দাবি জানিয়ে আসছিলেন, সময়মতো বাঁধের কাজ যেন শেষ করা হয়। যেন বাঁধ নির্মাণে ফাঁকি ও দুর্নীতি না হয়। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির উন্নয়ন সে কথা শোনেনি। কাজ শেষ হয়নি, বিপুল দুর্নীতি হয়েছে এবং ঢলের মুখে সেই বাঁধ ভেসে গেছে। সেখানে ফসল একটাই হয়, যাকে বলে বোরো ধান। বাকি সময় এলাকাটা ডুবে থাকে নিচে। সবেধন নীলমণি বোরো মার গেলে কৃষকের আর কিচ্ছু করার থাকে না। বৈশাখে যেভাবে বোনাস দেওয়া হবে সরকারি কর্মচারীদের, সেভাবেই বাম্পার ফলনের জন্য কৃষকদের কোনোবার কি বোনাস দেওয়া হয়? বোনাস বাদ, সরকারি অবহেলায় বাঁধ ভেঙে যাঁদের সর্বনাশ হয়, তাঁরা কি ক্ষতিপূরণের যোগ্য নন? কৃষকের দেশে এমন কৃষকবিরোধী সিস্টেম কে বানাল?

পূরবী তালুকদার লিখছেন, ‘গত বছরও আমাদের ধান চলে গেছে নয়নভাগায়। পাকা ধান যখন পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে তখন তার আর মালিক থাকে না। যে যতটুকু কেটে নিতে পারে সে ধান তার হয়ে যায়। তবে এবার আর নয়নভাগা হয়নি, কারণ ধান যে এখনো কাঁচা। এর একটি ধানও কাটার বা কাজে লাগানোর কোনো উপায় ছিলো না। বছরের পর বছর ধান তুলতে না পেরে হাওড়ের কৃষকরা চরম বিপর্যস্ত। এই তালিকায় আমার কৃষক বাবাও রয়েছেন। …হতাশা আর চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে প্রতিটি পরিবারের। চালের আড়তগুলোতে ভিড় বাড়ছে, দাম বাড়ার কারণে অনেকে ভাত খাওয়ার চালটুকুও কিনতে পারছে না। গরু বিক্রির লাইন শুরু হয়ে গেছে হাটে, কে কিনবে? সবার একই অবস্থা। আগমনী আর বিদায় আজ মিলেমিশে একাকার, নিজেরা কী খাবেন, আর গোয়ালের গরুগুলোই বা সারাটা বছর কী খাবে? এতোটুকু খড়ওতো নেই। অনেক পরিবার যার যা আছে তাই নিয়ে শহরে আসার পরিকল্পনা করছে। একটাই কথা, গার্মেন্টসে কাজ করবে, কম হোক আর বেশি হোক, মজুরি পাক বা না পাক চোখের সামনে অন্তত এমন দৃশ্য আর দেখতে হবে না। কোনো কোনো পরিবার পাড়ি জমাচ্ছে সুনামগঞ্জ-ছাতক-চুনারুঘাটে পাথর ভাঙবে বলে।’

উন্নয়নের এই এক লাভ। আগে খরা-দুর্ভিক্ষে কৃষকেরা বিবাগি হয়ে দেশ ছাড়তেন বা গলায় ফাঁস নিতেন। এখনো যে হয় না, তেমন তা নয়। হয়। তবে বেশির ভাগই উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে আসে ঢাকার শহরে। গার্মেন্টসে কাজ নেন কারও মেয়ে, কারও ছেলে রিকশা চালান। কেউবা নেমে যান আরও নিচে। গত বর্ষায় তিস্তার ঢলে এভাবে জমি হারিয়ে লালমনিরহাটের ৬২ বিঘা জমির মালিক এক কৃষককে ঢাকায় এক বড়লোকের বাড়ির দারোয়ান হতে দেখেছি।

খেলাপিদের আরও ঋণ দেওয়া হয়, লোকসানের ধুয়া তুলে সহায়তা পান বড় শিল্পপতিরা, ঋণ করে অস্ত্রও কিনি, চুক্তি করি। শিল্পী ও গবেষক মাহা মির্জার কথা দিয়ে বেদনার এই প্রতিবেদন শেষ করি,
‘এমন দিন কি আসবে
প্রতিরক্ষা চুক্তি হবে
নজুমিয়ার বাড়ির উঠানে, চাদর পেতে।
রাষ্টের সঙ্গে ৮ কোটি চাষার?’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর