‘স্যালুট’ মাশরাফি

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়, চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন করা, চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে, আমার না-থাকা জুড়ে।- কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র কবিতা কি মাশরাফির বিন মুর্তজার মনের কথাই বলছে? বাংলাদেশের এই সেরা ক্রিকেটার তার ১০ বছরের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পথচলা থামিয়েছেন। হঠাৎ করেই বিদায় বলেছেন, তাই চার-ছক্কার লড়াই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর হয়তো দেখা যাবে না তাকে। একদিন ওয়ানডে থেকেও বিদায় নিবেন। কিন্তু বিদায় বললেই তো হারিয়ে যাওয়া নয়। এই দেশের ক্রিকেট এগিয়ে যাবে তারই রেখে যাওয়া চলার পথের ছাপ দেখে দেখে। মাঠে তার লড়াকু রূপ যা এখন টাইগার ক্রিকেটারদের জয়ের মন্ত্র। সেই মন্ত্রে এগিয়ে যাবে নতুন যুগের মাশরাফিরা। বৃহস্পতিবার কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে নিজের শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচটি তিনি খেলতে নেমেছিলেন। গোটা বাংলাদেশ তখন গর্বের সঙ্গে তাকিয়ে বিদায়ী অধিনায়কের দিকে। কিন্তু অধিনায়ক বললেন তিনি নিজেই এই দেশের জন্য, এই দেশের মানুষের জন্য খেলতে পেরে গর্বিত। তিনি বলেন, ‘নিজেকে গর্বিত মনে করছি। ১০ বছর ধরে এই ফরমেটে বাংলাদেশের হয়ে খেলেছি। অবশ্যই গর্ব করার মতো ব্যাপার। আমার পরিবারেরও উচিত গর্ব করা। বন্ধু, সতীর্থ, ভক্ত সবাইকে ধন্যবাদ জানাই এভাবে আমাকে এতদিন সমর্থন দিয়ে আসার জন্য।’ ভিন ভূমে দাঁড়িয়ে টি-টোয়েন্টিকে বিদায় জানাতে হয়েছে দেশের সেরা এই অধিনায়ককে। কিন্তু তার এই বিদায় মুহূর্তে ক্রিকেটপ্রেমীরা হাজার মাইল দূরে থাকলেও বলতে ভোলেননি- ‘স্যালুট মাশরাফি’।
চাপ ছিল তার উপর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেয়ার। বোর্ড কর্তাও ভেবেছিলেন তিনি হয়তো অধিনায়কত্ব ছেড়ে খেলবেন সাধারণ ক্রিকেটারের মতোই। কিন্তু এতটা অবহেলার পাত্রও নন তিনি। তাই একেবারেই অবসরের ঘোষণা দিলেন টি-টোয়েন্টি থেকে। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন তরুণ আর রুবেলের মতো অবহেলিতদের সুযোগ দিতেই তার এই সরে দাঁড়ানো। শেষ পর্যন্ত দেশের মঙ্গল চান বলেই অনেক বিতর্ক, অনেক চাপা অভিমান আর ক্ষোভের কথা বুকের মধ্যেই পুড়িয়ে দিয়েছেন। গতকাল টসে জয় দিয়েই শুরু করেছিলেন ক্যারিয়ারের শেষটি-টোয়েন্টি ম্যাচটি। এটি ছিল শ্রীলঙ্কা সফরে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচও। প্রথম ম্যাচের টসের আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন তার অবসরের। সেই ম্যাচে এলোমেলো খেলে ৬ উইকেটে হেরে গিয়েছিল টাইগাররা। কিন্তু শেষ ম্যাচটি জিততেই মরিয়া ছিল দলের প্রতিটি সদস্য। কারণ এই জয়ই হবে তাদের প্রাণপ্রিয় অধিনায়কের জন্য একমাত্র বিদায় উপহার। শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়েছেন। দেশকে এনে দিয়েছেন এক স্মরণীয় জয়।
দেশের হয়ে ২০০১ সালে মাশরাফি বিন মুর্জতার টেস্ট ও ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল। এর ঠিক ছয় বছর পর বাংলাদেশ প্রবেশ করে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের যুগে। ২০০৬ সালের ২৮শে নভেম্বর খুলনায় টাইগারদের লড়াইয়ে প্রথম প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশ ব্যাট হাতে নেমে ১৬৬ রান করে। যেখানে মাশরাফির ব্যাট থেকে আসে ৮ নম্বরে নেমে ২৬ বলে ৩৬ রানের ঝড়ো ইনিংস। ২টি করে চার-ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন। বল হাতেও ২৯ রান দিয়ে এক উইকেট। প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশ ও মাশরাফিরা জয় পেয়েছিলেন ৪৩ রানের। ম্যাচসেরা হয়েই এই টি- টোয়েন্টি ফরমেটে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। এরপর খেলেছেন ৫৪টি ম্যাচ। বিদায় নিচ্ছেন অধিনায়ক হিসেবে এই ফরমেটে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি জয় উপহার দিয়ে। এত সাফল্যের পরও মাশরাফি কখনই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট উপভোগ করেননি।
টি-টোয়েন্টিতে ডানহাতি এই পেসারের রয়েছে ৪২ উইকেট। ব্যাট হাতে তুলেছেন ৩৭৭ রান। সেরা বোলিং ফিগারটি আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০১২ সালে ওই ম্যাচে ১৯ রান দিয়ে চার উইকেট নিয়েছিলেন মাশরাফি। তিনি উপভোগ না করলেও এই ফরমেটে তার নেতৃত্বে খারাপ করেনি বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০১৬ সালে তার অধিনায়কত্বেই ঘরের মাঠে এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টির ফাইনালে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। শেষপর্যন্ত ভারতের বিপক্ষে হার মেনে রানার আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের। এ পর্যন্ত এই ফরমেটে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ২৭ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে। সেখানে ৯ টিতে জিতেছে বাংলাদেশ, হার ১৭ ম্যাচে। ফলাফল আসেনি একটি ম্যাচে। মাশরাফির হাত ধরে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পাকিস্তাান-শ্রীলঙ্কার মতো বড় দলগুলোর বিপক্ষে জয়ও পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে শেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেতো ভারতকে প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল বাংলাদেশ। ওয়ানডের পর টি-টোয়েন্টিও মাশরাফির নেতৃত্বে টাইগারদের হুংকার ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব ক্রিকেটে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর