পুলিশের অপরাধ বন্ধে কড়া বার্তা

চাঁদাবাজি-ছিনতাই আর মাদকে জড়িয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ঈদকে সামনে রেখে সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরাও চাঁদাবাজি করছে। ছিনতাইয়েও জড়িয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকা বা সহযোগিতার অভিযোগও আসছে। এসব রোধে কড়া বার্তা পাঠিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। সম্প্রতি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাঠানো এক চিঠিতে তিনি এই কড়া বার্তা দেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অপরাধমূলক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া রোধ প্রসঙ্গে পাঠানো ওই চিঠিতে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা বা আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি নানারকম ভয়ভীতি দেখিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি করার অভিযোগ বহুদিনের। বিশেষ করে থানা পুলিশের রাতের টহলপার্টি এটি করে থাকে বেশি। নিরপরাধ মানুষকে ধরে এনে অর্থ আদায়ের মাধ্যমে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। এর পাশাপাশি ছিনতাইয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে এক শ্রেণীর অসৎ পুলিশ সদস্যরা। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের পরিচয় দিয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে গাড়িতে তুলে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়া হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে কখনো ‘ভুয়া পুলিশ’ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। কখনো ছিনতাই করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের হাতে ধরা খেলে তা ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে গ্রেপ্তারের কথা বলা হয়। সূত্র জানায়, মাদকের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ পুলিশ সদস্যদের। মাদক উদ্ধার করতে গিয়ে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া কিংবা মাদক ব্যবসায় সহযোগিতা করার অভিযোগও রয়েছে অনেক। অনেক পুলিশ সদস্যরা নিজেরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন। ফেনসিডিল থেকে শুরু করে গাঁজা কিংবা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন।
সূত্র জানায়, ঈদকে কেন্দ্র করে থানা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজির রমরমা ব্যবসা চলছে। গাড়ি আটকিয়ে অর্থ আদায়ের হার অন্য সময়ের চাইতে ঈদের সময় বেশি ঘটে থাকে। ঈদ উপলক্ষে পথেঘাটে ট্রাফিক সার্জন আর কনস্টেবলরা অর্থের পরিমাণও বাড়িয়ে নিয়ে থাকেন। সূত্র জানায়, থানা পুলিশ রাতের চেকপোস্ট কিংবা টহল পার্টির নামে সাধারণ মানুষকে তল্লাশির নামে হয়রানি করে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন পেন্ডিং মামলার ভয় কিংবা মাদকসহ আটকের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করে থাকে। রাতের টহল পার্টিগুলোর গাড়িতে সারারাত কাউকে না কাউকে বসে থাকতে দেখা যায়। গাড়িতে তুলে পরিবারের সদস্যদের অর্থ আনতে বলা হয়। সম্প্রতি হরহামেশাই এমন অভিযোগ আসায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া স্বাক্ষরিত আদেশের মাধ্যমে এসব বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। গত ১৭ই জুন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার থেকে শুরু করে সব জোনের উপ-কমিশনার, থানার ওসিসহ টিম লিডারদের কাছে ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে আছাদুজ্জামান মিয়া কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর থেকেই এসব বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি জারি করেছেন। ডিএমপির প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশন শাখার তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ কর্তৃক ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক সংক্রান্ত ১৭টি অভিযোগ পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে ১৩টি ঘটনা তদন্তে প্রমাণিত, দুটি ঘটনা তদন্তাধীন, ৭টি ঘটনায় বিভাগীয় মামলা ও ৪টি ঘটনায় ফৌজদারি মামলা রুজু হয়েছে। ওই সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃক ১০টি ছিনতাইয়ের অভিযোগ পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে ৯টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। একটি অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। এসব ঘটনায় ৬টি বিভাগীয় মামলা ও ২টি ফৌজদারি মামলা রুজু হয়েছে। চাঁদাবাজির অভিযোগ এসেছে ৩টি। মাদক সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে ৪টি। এই ৪টি অভিযোগই তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ১টি অভিযোগে বিভাগীয় মামলা ও ২টি অভিযোগে ২টি ফৌজদারি মামলা রুজু করা হয়েছে। এসব ঘটনায় একজন পুলিশ পরিদর্শক, দু’জন এসআই, একজন সার্জেন্ট, তিনজন এএসআই, একজন নায়েক ও ৯ জন কনস্টেবল জড়িত বলে জানা গেছে।
পুলিশ কর্তৃক অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রোধে কমিশনারের পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধমূলক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন সদস্য ছিনতাই কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ কিংবা জনতা কর্তৃক ধৃত হয়েছেন। বিভিন্ন মাদক যেমন- গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা ইত্যাদি সেবনের জন্য অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়তা কিংবা প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে কয়েকজন অভিযুক্ত হয়েছেন। টহল পার্টির কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে (বিশেষ করে রাত্রিকালীন) নিরীহ জনসাধারণকে সন্দেহভাজন হিসেবে আয়ত্তে নিয়ে টহল গাড়িতে তুলে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন জায়গা প্রদক্ষিণ করে থানায় না নিয়ে অর্থ আদায় করে পথিমধ্যে তাদের ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ মাঝেমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া, দুই একজন সদস্যের বিরুদ্ধে নারীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, পুলিশের মুষ্টিমেয় সদস্যের এহেন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথা বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি জনসাধারণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কিছু কিছু ঘটনা মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে। ফলে সমাজে পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে এবং বাংলাদেশ পুলিশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চিঠিতে বলা হয়, এমতাবস্থায় পুলিশের সকল বিভাগ যথা- অপরাধ, গোয়েন্দা, সদর দপ্তর, পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট, ট্রাফিক, ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি, প্ররক্ষা ইত্যাদির ইনচার্জগণ তার অধীনস্ত কর্মকর্তাগণ ও ফোর্সকে নিয়মিতভাবে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের আলোকে উপরে বর্ণিত বিষয়ে প্রণোদিত (মোটিভেশন) করবেন এবং পুলিশের কোন সদস্য কোন অনৈতিক বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক করবেন। অফিসার এবং ফোর্সদের প্রণোদনার কাজে অন্যান্য কর্মকর্তাগণ (এডিসি, এসি, ওসি, টিআই, আরআই, ফোর্স সুবেদার) তার অধীনস্ত বা আওতাধীন এলাকায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের একইভাবে প্রণোদিত করবেন। পাশাপাশি ইউনিট ইনচার্জগণ তার অধীনস্ত পুলিশ সদস্যদের চালচলন, চলাফেরা, আচরণ, মনোভাব ইত্যাদি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। তাতে কোন ব্যত্যয় দেখা দিলে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করবেন, সংশোধনের জন্য নির্দেশ দিবেন এবং তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবেন। তথাপি তাদের আচরণে, চালচলনে এবং মনোভাবে ইতিবাচক কোন পরিবর্তন বা সংশোধনের লক্ষণ পরিলক্ষিত না হলে তাদেরকে কঠোর বিভাগীয় বা আইনগত শাস্তির আওতায় আনবেন।
এদিকে ডিএমপি কমিশনারের এই কড়া বার্তা পাঠানোর দুই সপ্তাহ পার হতে না হতেই পল্লবী থানার দুই এসআই জাহিদুল ইসলাম ও জুবায়ের হোসেনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেছেন এক ভুক্তভোগী। আদালত সূত্র জানিয়েছে, গত রোববার  ঢাকা মহানগর হাকিম তারেক মঈনুল ইসলাম ভূঁইয়ার আদালতে মোসা. লাবণী বেগম নামে এক নারী এই মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন, সাইফুল ইসলাম (৩৪), আমানউল্লাহ (৫০), রুবেল (২৫), সিরাজ বক্স (৫৫), হারুন (৩৮)।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ১২ই মে মিরপুর আলীনগর হাউজিংয়ের পাশে বাদী লাবণীর মামা মমিন বক্স কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে হ্যাবিলি প্রপার্টিজের কাজ করছিলেন। এ সময় স্থানীয় সাইফুল ইসলাম ও আমানউল্লাসহ ১০-১২ জন তাদের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। গত ১৪ই জুন তারা কাজ করতে গেলে আসামিরা কাজে বাধা দেয়। এ সময় সন্ত্রাসীরা বাদিনীর ভাই রাজিব ও তার মামা মমিনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মামলায় বলা হয়, এ ঘটনার পর কোন কারণ ছাড়াই পল্লবী থানার এসআই জাহিদুল ইসলাম ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তাদের আটক করে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। বাদিনী ৫০ হাজার টাকা দেয়। পরে ১৮ই জুন পল্লবী থানার অপর এসআই জুবায়ের পল্লবীর সিরামিক রোডে বাদিনীর শ্বশুরকে হোটেল থেকে পুলিশের গাড়িতে তুলে লাঠিপেটা করেন। এ সময় বাদিনীর কাছে ৬০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। বাদী ২০ হাজার টাকা দেয়। বাকি টাকা না দেয়ায় তাদের ২০টি রিকশা নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশ এছাড়াও বাদীর পরিবারের সদস্যদের হত্যা মামলায় জড়ানোরও হুমকি দিচ্ছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর