হাওরে ডুবছে নতুন নতুন এলাকা থামছে না কৃষকের কান্না

ফের স্বপ্নভঙ্গ হাওরের কৃষকের। গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে হাওরের পর হাওর ধানী জমি। চোখের সামনে ডুবছে তাদের একমাত্র কষ্টফসল। ধান পাকার আগেই এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ে হাওরপাড়ে নেমে এসেছে চরম বিষাদ। ফসল হারানোর শোকে কাঁদছে ইটনা-অষ্টগ্রাম-মিঠামইনের হাওরপাড়ের কৃষক। তাদের বুকফাটা আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠেছে হাওরপাড়ের পরিবেশ। স্থানীয় কৃষকেরা জানান, মেঘনা, কালনী, কুশিয়ারা, ধনু, দাইরা, ঘোড়াউত্রা, ধলেশ্বরী, করাতিয়া কলকলিয়া, বৈঠাখালী, কলমারবাক নদীতে প্রতিদিনই অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়ছে। এসব নদ-নদী উপচে পড়ে পানি হাওরে ঢুকছে। পানির তোড়ে একের পর এক ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে পড়ছে। গত চার দিনে শুধু ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামইনের অন্তত ৩০টি হাওরের ২৫ হাজার হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া অব্যাহতভাবে পানি বাড়তে থাকায় সোমবার আরো কয়েকটি হাওর প্লাবিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন এসব এলাকার কৃষক। ইটনার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের বেশ কয়েক কৃষক জানান, জয়সিদ্ধি দক্ষিণে বিজয় বাঁধের হাওরে ৬ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমি রয়েছে। ৩২ কিলোমিটার সার্কুলার এই বাঁধের হাওরে ইটনার জয়সিদ্ধি ও এলংজুরি, মিঠামইনের কাটখাল, বৈরাটি, কেওয়ারজোড় ও ঢাকী এবং হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকাইলছেও এই ৭টি ইউনিয়নের অন্তত ২২টি গ্রামের কৃষকের জমি রয়েছে। ফুলপুরের খাল দিয়ে শনিবার ভোরে এই বাঁধের মিঠামইনের হাশিমপুর থেকে চারিগ্রামের দিকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা উপচে পানি হাওরে ঢুকতে শুরু করে। গত তিন দিনে দেখতে দেখতে এই হাওরের জমি তলিয়ে গেছে। অনেক কৃষক হাওর থেকে নিজের জমির ফসল সংগ্রহের শেষ চেষ্টা করছেন। নৌকা আর মাথাপিছু ৫-৬শ’ টাকা রোজে ধানকাটা শ্রমিক নিয়ে তারা ধান কাটার চেষ্টা করছেন। তলিয়ে যাওয়া জমির আধাপাকা ধান কাটতে গিয়েও কৃষককে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত যেসব হাওর প্লাবিত হয়নি, সেসব নিয়ে কৃষকের মাঝে যে ক্ষীণ আশা ছিল, পানি বাড়ায় তাদের সে আশাও ভঙ্গ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরে আতঙ্কিত কৃষকদের অনেকেই বাঁধ রক্ষার চেয়ে আধাপাকা বা কাঁচা যাই হোক জমির ধান কাটায় মনোযোগী হয়ে পড়ছেন। এ পরিস্থতিতে মৌসুমী ধান কাটা শ্রমিক আসার আগেই হাওর তলিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় ধান কাটা শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে গেছে। ২৫০-৩০০ টাকার বিপরীতে অনেককে ৬শ’-৭শ’ টাকায়ও শ্রমিক সংগ্রহ করে ধান কাটাতে দেখা গেছে। তারপরও শ্রমিক মিলছে না। অনেক কৃষক শ্রমিক না পেয়ে হাওরের পাড়ে বসে নিজের তলিয়ে যাওয়া জমির দিকে তাকিয়ে বিলাপ করছেন। বিজয় বাঁধের হাওর তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই প্রশাসনের উদাসিনতাকে দায়ি করছেন। সময়মতো ফুলপুরের খালের ভরাট হয়ে যাওয়া অংশের মাটি অপসারণ করে দিলে নদীর পানিতে হাওর আক্রান্ত হতো না বলে তারা জানিয়েছেন। জয়সিদ্ধি গ্রামের মুৃক্তিযোদ্ধা আবু তাহের ঠাকুর জানান, ২০০৪ সালে সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের উদ্যোগে এবং এনজিও প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’র তত্ত্বাবধানে এই সার্কুলার বাঁধটি নির্মিত হয়। বিজয় বাঁধের ভেতর ১৫ হাজার একর বোরো জমি রয়েছে, যেখান থেকে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে বাঁধটি সংস্কারের জন্য কৃষকেরা দাবি জানালেও বাঁধটি সংস্কার হয়নি। এরপরে ২০১০ সাল থেকে এবারসহ মোট ৪ বার হাওরটি তলিয়ে ধানীজমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জয়সিদ্ধি গ্রামের কৃষক সোলাইমান ঠাকুর জানান, ধারদেনা করে অনেক কষ্টে দুই একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলেন তিনি। কিন্তু পানিতে পুরো হাওরই তলিয়ে গেছে। কৃষক হামিদ মিয়া জানান, ধান সবে রঙ ধরেছে। এর মাঝেই তলিয়ে গেছে। এগুলো কেটে আনলে গরুকেও খাওয়ানো যাবে না।

জামালগঞ্জে পানির নিচে ৯ হাজার হেক্টর জমি
জামালগঞ্জ (সুনামগঞ্জ) প্রতিনধি: জামালগঞ্জের হালির হাওরের কালীবাড়ী বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর জমির ফসল। বাঁধ ভাঙার খবরে পুরো হাওর এলাকার প্রতিটি গ্রামে কৃষক কৃষানী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের কান্নার রোলে আকাশ ভারি হয়ে উঠেছে। বছরে একটি মাত্র বোরো ফসলে হাওর এলাকার কৃষকদের জীবন জীবিকা নির্ভর করতে হয়। হালির হাওর পাড়ের কালীবাড়ী বাঁধটি নির্মাণের জন্য জামালগঞ্জ সদর, নবগঠিত উত্তর ইউনিয়নসহ বেহেলী ইউনিয়নের কৃষকরা জোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। আর এই নিয়ে স্থানীয় কৃষকরা উপজেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিগত এক মাস ধরে অবহিত করে এলেও শেষরক্ষা হয়নি। কিন্তু কোনো ধরনের ভ্রূক্ষেপ আর কর্ণপাত করেননি বেহেলী ইউপি চেয়ারম্যান অসীম চন্দ্র তালুকদার ও তার পিআইসিরা। জানা যায়, শুধু হালির হাওরের কালীবাড়ী বাঁধের বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দের পর তা বাড়িয়ে ৪টি পিআইসি দেখিয়ে তা ৬০ লাখ টাকায় বৃদ্ধি করে। বেহেলীর চেয়ারম্যান অসীম চন্দ্র তালুকদার প্রত্যেকটি পিআইসি তার নিজস্ব লোক দিয়ে গঠন করে টাকা তুলে ঢাকা আর সুনামগঞ্জ শহরে অবস্থান করে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় কৃষকরা। হালির হাওরের কোনো বাধের ব্যাপারেই চেয়ারম্যান কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নিয়ে দায়সারা ভাবে ৩০ ভাগ কাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জামালগঞ্জের শস্যভাণ্ডার খ্যাত হালির হাওরের সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর জমির অধিকাংশই এখন পানির নিচে। হাওর এলাকার মানুষজন ক্ষোভে দাবি জানান বেহেলীর চেয়ারম্যান অসীম চন্দ্র তালুকদারকে আটক করে আইনের আওতায় আনার।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর