মার্শাল আর্টের দুই কিশোরী

ভোর ৪টা। সূর্য উঠতে ঢের বাকি। তখনই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ওরা-একজন দুজন করে। ওরা ২১ কিশোরী। সবাই ঠিক মতো হাজির হয়েছে কি না, সেটা দেখভাল করে আফরিন। তারপর মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে ওঠে একে একে। ওদের নিয়ে ভোর ৫টার কিছুক্ষণ আগেই বাসটা হাজির হয় চন্দ্রিমা উদ্যানে। ৫টায় ওখানে হাজির হন দিলদার হাসান। মার্শাল আর্টের জাতীয় কোচ তিনি। তাঁর নির্দেশনায় মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নেয় সবাই। ৫টা থেকে ৮টা-টানা তিন ঘণ্টা। চলে পলকা শরীরে ক্ষিপ্রতা আনার নানা কৌশল। এখানেই মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নেয় ওরা দুজন। একজন সাদিয়া আকতার আফরিন আর অন্যজন নাসরিন আকতার শম্পা। মাত্র দেড় বছরের প্রশিক্ষণেই আত্মরক্ষায় আট-দশজন ছেলের চেয়ে এগিয়ে ওরা।

প্রথমে কারাতে

সাদিয়া পড়ছে বাংলাদেশ জার্মান কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নবম শ্রেণিতে। আর শম্পা পড়ে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটে সপ্তম শ্রেণিতে। ওরা দুজনই ২০১৩ সালে ভর্তি হয় বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেশনে। আত্মরক্ষার অন্যতম সেরা উপায় হিসেবে নেওয়া শুরু করে প্রশিক্ষণ। আফরিন জানায়, ‘মামা মোহাম্মদ মাহবুব রব্বানীর পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় আমরা প্রথমে কারাতে ফেডারেশনে ভর্তি হয়েছিলাম। ফেডারেশনটি আমাদের বাসা থেকে বেশ কাছে ছিল।’

এরপর মার্শাল আর্ট

এক বছর কারাতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আত্মরক্ষার বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে ওরা ভর্তি হয় মার্শাল আর্টে। প্রতিষ্ঠানের নাম ডায়মন্ড মার্শাল আর্ট ট্রেনিং সেন্টার। এখানকার কোচ দিলদার হাসান। ক্লাস হয় চন্দ্রিমা উদ্যানে। কিছুদিন আগে আফরিন কারাতে ফেডারেশন থেকে অর্জন করে ব্রাউন বেল্ট। এই অর্জনের কারণে কারাতে কোচের সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে ওর। সানবীমস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কারাতে কোচিংয়ে সে কোচের সহকারী হিসেবে কাজ করছে। সম্মানীও আকর্ষণীয়। ঘণ্টায় হাজার টাকা।

স্বর্ণপদক

৭ জুন থেকে চতুর্থবারের মতো শুরু হয়েছিল বেগম ফজিলাতুন্নেসা আন্তর্জাতিক মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতা। অংশ নেয় ১৬টি দেশ। ওরাও অংশ নেয়। তবে প্রতিযোগিতার কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল দুজনই। কিন্তু কোচ ওদের বললেন, নিজেরা যেটা অনুশীলন করো, সেটাই বিচারকদের সামনে দেখাবে। ব্যস, এর বেশি কিছু তো নয়।

কোচের কথায় সাহস হয় দুজনের। বড় আসর। দেশি-বিদেশি প্রতিযোগী। তবু ঘাবড়ায়নি দুই কন্যা। অন্য দেশের প্রতিযোগীদের পরাস্ত করে স্বর্ণপদক জিতে নেয় তিন কিশোরী। আফরিন ও শম্পার পাশাপাশি স্বর্ণপদক পাওয়া আরেকজন হচ্ছে সাথী আকতার। সাথী আকতারও ওদের সঙ্গে চন্দ্রিমা উদ্যানে অনুশীলন করে। পড়ে বাংলাদেশ জার্মান কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে নবম শ্রেণিতে।

শম্পা জানায়, ‘এ পুরস্কার পাওয়ায় বাসার সবাই খুশি হয়েছে। খুশি হয়েছেন আমাদের কোচ দিলদার হাসান স্যার ও রব্বানী মামা। দেশের পক্ষ থেকে পুরস্কার জেতায় আমরাও খুব আনন্দিত। দেশের জন্য একটা সম্মান তো আনতে পেরেছি।’

বখাটেরা কুপোকাত

গত ২৩ জুন স্কুল থেকে রব্বানী মামার বাসায় আসছিল আফরিন, শম্পা ও তাদের কয়েকজন বান্ধবী। মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের সামনে তখন ইভ টিজিংয়ের শিকার হচ্ছিল মেয়েরা। নেতৃত্ব দিচ্ছিল মিরাজ নামের এক বখাটে। আগেও মাঝেমধ্যে উত্ত্যক্তের শিকার হতো ওরা। কিন্তু সেদিন বখাটেদের চ্যালেঞ্জ করে বসে আফরিন ও শম্পা। উত্ত্যক্ত করতে নিষেধ করে মিরাজকে। শুরু হয় মিরাজের সঙ্গে তর্কাতর্কি। একপর্যায়ে অ্যাকশনে যায় আফরিন ও শম্পা। আড়াই বছর ধরে শেখা কারাতে এবং মার্শাল আর্টের কয়েকটি কৌশল খাটায় বখাটেদের ওপর। ওতেই নাস্তানাবুদ মিরাজ ও তার চ্যালা আলামিন। উত্ত্যক্তকারী বখাটেদের এভাবে নাস্তানাবুদ করার ঘটনাও বিরল। তবে সাহস করে এগিয়ে গেলে মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের আত্মরক্ষা করতে পারে। তো এই সাহসটা কিভাবে পেল? আফরিন জানায়, ‘মাহবুব রব্বানী মামা আমাদের আত্মরক্ষার জন্য কারাতে ও মার্শাল আর্ট শিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কেন? শুধুই শেখার জন্য তো নয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো সাহসী হওয়ার জন্য। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, অন্যায়কে মেনে নিয়ে বারবার মরার কোনো অর্থ হয় না। মরলে একবারই।’

ওদের ব্যস্ততা

ওরা কিন্তু ভীষণ ব্যস্ত। ভোর ৪টা থেকে শুরু ওদের ব্যস্ততা। ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত মার্শাল আর্টের ক্লাস। ক্লাস থেকে ফিরতে ফিরতে ৯টা। ফিরেই গোসল করে খেয়েদেয়ে স্কুলে। স্কুল থেকে ফেরার পর বিকেলে আবার কারাতের ক্লাস। অথবা টিউটরের কাছে পড়া। সন্ধ্যায় নিজের পড়াটা শেষ করে ফেলতে হয় চটজলদি। কারণ রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। আবার ভোর ৪টায় উঠতে হবে তো। এত ব্যস্ততায় দিন কাটাতে বেশ লাগে ওদের। কোন দিক দিয়ে যে একটা দিন চলে যায়, বুঝতেই পারে না। আফরিনের ইচ্ছা বড় হয়ে ও প্রকৌশলী হবে। আর শম্পা হতে চায় সরকারি কর্মকর্তা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর