অস্বাস্থ্যকর আর নোংরা পরিবেশে থাকছে পুলিশ

পুলিশের থাকার ঘর গ্রামের গোয়ালঘর কিংবা মুরগির খামারের চেয়ে বেশি খারাপ। দুর্গন্ধ, নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বছরের পর বছর মাঠ পর্যায়ের থানা পুলিশ এ অবস্থায় বসবাস করছেন। বর্তমানে জঙ্গিরা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই অবস্থায় পুলিশের নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। থানা ফাঁড়ির ৯০ ভাগ পুলিশ সদস্যের আবাসনের সংকট প্রকট। যা আধাপাকা থাকার ঘর রয়েছে সেখানে পয়:নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। ভাঙ্গাচোড়া, নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। অনেকে বৃষ্টির সময় পলিথিন দিয়ে পানি ঠেকায়। এ অবস্থায় তারা কোনভাবে ঘুমিয়ে না ঘুমিয়ে রাত কাটায়। দেশে জঙ্গিদের অপতত্পরতার কারণে ভিআইপি, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সরকারি ভবনসহ সর্বত্রই বাড়তি নিরাপত্তা প্রদানে শীর্ষ প্রশাসন থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব নিরাপত্তা প্রদানের সিংহভাগ দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের উপর।

যেখানে পুলিশের থাকার নিরাপত্তা নেই সেখানে অন্যান্য নিরাপত্তা প্রদানে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। রাজধানীসহ দেশের বেশ কয়েকটি থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে পুলিশের বসবাসের করুণ দৃশ্য এই প্রতিবেদক স্বচক্ষে দেখেছেন। পুলিশ সদস্যরা তাদের করুণ অবস্থার বিস্তারিত তথ্য এই প্রতিবেদককে জানান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশের বাসস্থান, পদোন্নতি, বেতন ভাতা বৃদ্ধিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছেন। তবে চাহিদার তুলনায় পুলিশের বাসস্থান সীমিত। পুলিশের শীর্ষ প্রশাসন মাঠপর্যায়ের পুলিশের থাকার এই অমানবিক বিষয়টি তারা কখনও খোঁজ নিয়েও দেখেননি। যুগের পর যুগ তারা এ অবস্থায় বসবাস করে আসছে।

শীর্ষ পর্যায়ে পুলিশের একটা অংশ ব্যস্ত পদ-পদবি টিকিয়ে রাখতে, একশ্রেণি ব্যস্ত দলবাজি করে আখের গোছাতে। কেউ কেউ আবার নানা ফন্দিফিকির করে বছরের পর বছর ভালো জায়গায় পোস্টিং নিচ্ছে। এ অবস্থা সব সরকারের আমলেই চলে আসছে। এ কারণে মাঠপর্যায়ের আবাসন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে কোন নজরদারি নেই এমন অভিযোগ মাঠপর্যায়ের পুলিশের। পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক বলেন, পুলিশের আবাসন সমস্যা নিরসনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

মুন্সিগঞ্জের ভবের চর পুলিশ ফাঁড়ি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশেই এই ‘হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি’। এটি ৫০ বছর ধরেই আছে। এখানে জনবল ২৩ জন। এসআই দুই জন, সার্জেন্ট দুই জন, এএসআই একজন, এটিএমআই (হাবিলদার) একজন ও নায়েক একজন। ফাঁড়ি ইনচার্জ আবুল হাসেম। মেঘনা ব্রিজের পশ্চিম পাশ থেকে দাউদকান্দি ব্রিজ পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার এই ফাঁড়ির দায়িত্ব পালন করছে।

সরেজমিনে এই ফাঁড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি লম্বা শেডোর মধ্যে অমানবিক পরিবেশে থাকছেন পুলিশ সদস্যরা। শেডের উপর পলিথিনে মোড়ানো। আধা পাকা ঘরের বেশিরভাগই ভাঙ্গাচোড়া। আশপাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। ভিতরে ঢুকতেই নাকে এসে লাগলো বিশ্রী গন্ধ। রান্না ঘরের অবস্থা যাচ্ছেতাই। টয়লেটের অবস্থাও ভয়াবহ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করছে পুলিশ সদস্যরা। মুরগির খামারের অবস্থাও এর চাইতে ভালো বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন একাধিক পুলিশ সদস্য। ফাঁড়ির ইনচার্জ বলেন, এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অবস্থান করায় অনেক পুলিশ সদস্য শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকেন। তবুও তারা ১৩ কিলোমিটার হাইওয়েতে যানজট নিরসনসহ নিরাপত্তা প্রদানে ২৪ ঘন্টা ডিউটি করে যাচ্ছে। পুলিশের ডিআইজি (হাইওয়ে) সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, ভবের চরের চেয়ে আরো নাজুক অবস্থা ইলিয়েটগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির। আমরা এসব থানা ও ফাঁড়ির আবাসন সংকট নিরসনে ইতোমধ্যে একনেক বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তা দ্রুত বাস্তবায়ন হবে।

রাজধানীর লালবাগ থানায় কনস্টেবল আছে ৩৭ জন, আনসার ১৫ জন, এমসআই ১৩ জন, ওসি একজন, ইন্সপেক্টর তদন্ত একজন রয়েছেন। অথচ তাদের থাকার ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ফাঁড়ির অবস্থান একটি কমিউনিটি সেন্টারের নিচতলায়। একগ্রুপ ঘুমায় আর অন্যগ্রুপ জেগে থাকে। গোসলখানার অবস্থা নাজুক।

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) সংবাদদাতা এম এ মোমেন জানান, সেখানকার পুলিশ ফাঁড়িতে জনবল আছে ৫০ জন। ওসি একজন, এসআই ২২ জন, এমসআই ১৪ জন ও কনস্টেবল ২৬ জন। থাকার কোন আবাসিক ভবন নেই। পুলিশ সদস্যরা থাকেন পরিত্যক্ত ভবনে। কেবল ওসির জন্য থাকার একটি ভবন আছে। সেটির অবস্থাও খুব একটা ভালো না।

ডোমার (নীলফামারি) সংবাদদাতা মো. মোজাফফর আলী জানান, সেখানকার পুলিশ ফাঁড়ির জনবল ৪২ জন। ওসি একজন, ইন্সপেক্টর তদন্ত একজন, এসআই ৭ জন, এএসআই ৯ জন ও কনস্টেবল ২৪ জন। এসআই ও এএসআইয়ের আবাসনের ব্যবস্থা আছে। বাকি পুলিশ সদস্যদের জন্য বাসস্থান নেই। ব্রাকের অফিসে মানবেতরভাবে জীবনযাপন করছেন তারা।

শিবালয় (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতা বাবুল আকতার মঞ্জুর জানান, শিবালয় থানা ও দু’টি পৃথক পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত সদস্যদের নানা সমস্যা মোকাবেলা করে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে কর্তব্য পালনের পাশাপাশি প্রতিজন সদস্য বাসস্থান বঞ্চিত হচ্ছেন। জানা গেছে, পদ্মা-যমুনা বেষ্ঠিত প্রায় ১১০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলায় প্রায় আড়াইলাখ লোকের বাস। উপজেলার স্পর্শকাতর পাটুরিয়া ফেরি ও আরিচা ঘাটসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমন্বয়ে গঠিত শিবালয় থানায় বর্তমানে ইন্সপেক্টর পদে দু’জনের মধ্যে একজন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন। এছাড়া এসআই ৭ জন, এএসআই ৮ ও কনেস্টেবল হিসেবে ৩৪ জন নিযুক্ত আছেন। এ উপজেলার মহাদেবপুরে ভাড়াকৃত ভবনে স্থাপিত পৃথক হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে একজন সার্জেন্ট রয়েছেন। তিনজনের স্থলে একজন এএসআই নিযুক্ত আছেন। তবে কনস্টেবলের সংখ্যা ১৭ জন। অপরদিকে, পদ্মা-যমুনাবেষ্টিত এ উপজেলার পাটুরিয়া ঘাট ও আরিচা নৌ-বন্দরসহ বিসৃ্তত এলাকায় নিরাপত্তার জন্য স্থাপিত নৌ-পুলিশ ফাঁড়িতে এসআই ২, এএসআই ৩ ও ১৩ জন কনস্টেবল রয়েছেন।

নৌ-ফাঁড়ির ইনচার্জ শামসুল আলম জানান, বর্তমান লোকবল দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ পাটুরিয়া ঘাটে যাবতীয় নিরাপত্তা বিধান, তল্লাশী কাজ পরিচালনা, বিশেষ করে ঈদ পূজাপার্বনসহ বিশেষ দিনে যাত্রীচাপ সামাল দিতে হচ্ছে। শিবালয় থানার ওসি তদন্ত মো. আলমগীর হোসেন আকন্দ জানান, শুধু ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার জন্য থানা কম্পাউন্ডে বাসা রয়েছে। অন্যরা থানা ভবনের আশপাশে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন।

বরংগাঈল হাইওয়ে ফাঁড়ি ইনচার্চ ইয়ামিন-উদ-দৌলা জানান, নিজস্ব ভবন, হাইওয়ে থানা নির্মাণের জন্য ইতিপূর্বে উথলী বাস ডিপোর পাশে ৮৭ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণ করা হলেও পরবর্তী পর্যায়ে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। ফলে মহাদেবপুরে একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশনে ভাড়া ভবনে ফাঁড়ি পরিচালিত হচ্ছে।

কচুয়া (চাঁদপুর) সংবাদদাতা আবুল হোসেন জানান, কচুয়া থানার পুলিশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মূলভবনে কার্যক্রম পরিচালনাসহ বিভিন্ন আবাসিক ভবনের কক্ষে বসবাস করছেন। পাঁচটি আবাসিক ভবনের ঊনিশটি কক্ষেরই জরাজীর্ণ অবস্থা। এসব কক্ষের ছাদ ও দেওয়ালে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। ছাদের আস্তর খসে পড়ে মরিচা ধরা রড ভেসে উঠেছে। ফাটল চুঁইয়ে পড়ে বৃষ্টির পানি। ওসির থাকার কক্ষটি খুবই নাজুক। যে কোন সময় এ কক্ষের ছাদ ও দেওয়াল ধসে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

দ্বিতল থানা ভবনের পূর্ব পাশের বড় কক্ষ ও দক্ষিণ পাশে সেকেন্ড অফিসারের কক্ষ দু’টির জরাজীর্ণ অবস্থা। একটু খানি বৃষ্টি হলেই ছাদের ফাটল দিয়ে পানি চুঁইয়ে পড়তে থাকে। এতে রেকর্ড পত্র বিনষ্ট হওয়াসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হয়। অফিসার ইনচার্জ এ.কে.এম.এস ইকবাল জানান, আমি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই কক্ষে আতংকের মাঝে দিন যাপন করছি। মূল ভবনসহ আবাসিক ভবনের নাজুক অবস্থা সর্ম্পকে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।

গৌরনদী (বরিশাল) সংবাদদাতা মো. জামাল উদ্দিন বলেন, বছর দুয়েক আগে বরিশালের গৌরনদী থানা মডেল থানায় উন্নীত হলেও একটি মাত্র ভবন ব্যতিরেকে এখানে আর কোনো উন্নয়নের ছোঁঁয়া আজও পরিলক্ষিত হয়নি। আবাসিক সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যার কারণে গৌরনদী থানায় কর্মরত ২ জন ইন্সপেক্টর, ১৪ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ৯ জন এএসআই ও ২৮ জন পুলিশ কনস্টেবল মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্তু সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর