কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ৭ ফ্যাক্টর

কুসিক নির্বাচনের বাকি মাত্র কয়েকদিন। মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চারজন। তবে ধানের শীষ প্রতীকে সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু ও নৌকা প্রতীকে আঞ্জুম সুলতানা সীমার মধ্যেই জমবে লড়াই। ভোর থেকে মধ্যরাত অবধি ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ছুটছেন তারা দুজন। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন উন্নয়ন আর সুশাসনের। দুই প্রার্র্থীর পক্ষেই চলছে তুমুুল প্রচারণা। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে নগরীর প্রতিটি রাস্তা, গলি আর ভবনের দেয়াল। মুহুর্র্মুহু মাইকিং, গণসংযোগে কুমিল্লা এখন রীতিমতো উৎসবের নগরী। কিন্তু এতকিছুর পরও কয়েকটি ফ্যাক্টর নিয়ে অস্বস্তিতেই রয়েছেন দুই প্রার্র্থী। দুইজনেরই রয়েছে প্লাস এবং মাইনাস পয়েন্ট। এসব নিয়ে তাই চলছে নানা বিশ্লেষণ আর হিসাব-নিকাশ। সরজমিন কুমিল্লার নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপে ওঠে এসেছে তেমন সাতটি ফ্যাক্টর। জলাবদ্ধতা, যানজট, নারী ভোটার, নতুন ভোটার, সংখ্যালঘু ভোটার, জামায়াত ও এমপি বাহার- ফ্যাক্টরই নির্ধারণ করবে কুসিক নির্বাচনের ফলাফল। সাত সমীকরণের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কুসিক নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জয়-পরাজয়।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সার্ভিস ড্রেন না থাকায় অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যায় এ নগরী। সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। সরু রাস্তাঘাট, যত্রতত্র গড়ে ওঠা বহুতল ভবন, অপরিচ্ছন্ন ও ঘিঞ্জি নগর এখন কুমিল্লার পরিচয়। পানি নিষ্কাশনে পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্রতিটি ওয়ার্ডেই যানজট, জলাবদ্ধতা নিত্য সঙ্গী এখানকার নাগরিকদের। বিগত নির্বাচনেও এ ইস্যুটিই ছিল অন্যতম ফ্যাক্টর। জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বারবার জনপ্রতিনিধি নির্র্বাচিত হয়েছেন প্রার্থীরা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে রূপান্তরের পাঁচ বছর পর এ রকম নগর জনপ্রত্যাশার সঙ্গে মেলে না। এবারও প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির শীর্র্ষে রয়েছে এ সমস্যার সমাধান। একটু ভারী বৃষ্টিপাত হলেই নগরীর রাস্তাগুলো নালা-নর্দমার ময়লা পানিতে তলিয়ে যায়। বিশেষ করে শহরের প্রাণকেন্দ্র সংলগ্ন ঝাউতলা, বাদুরতলা, জিলা স্কুল সড়ক, ভিক্টোরিয়া কলেজসহ শহরের
অধিকাংশ এলাকা। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা এ ইস্যুটিই নিয়ে এসেছেন সামনে।
কুসিকবাসীর আরেকটি বড় সমস্যার নাম যানজট। শহরে এখন বৈধ যানের চেয়ে অবৈধ যানের সংখ্যাই বেশি। বর্তমানে ১০ হাজার ৫৩০টি লাইসেন্সের বিপরীতে রিকশা চলে অন্তত ৩০ হাজার। ইজিবাইক চলে অন্তত ২৫ হাজার। সিটি করপোরেশনে ট্রাফিক পয়েন্ট রয়েছে ছয়টি। অপ্রশস্ত রাস্তা ও ফুটপাথ এবং জলাবদ্ধতার কারণে যানজট লেগে থাকে কান্দিরপাড়, বাদুরতলা, রাজগঞ্জ, চকবাজার, টমছমব্রিজ এলাকায়। এছাড়া কুমিল্লা শহরে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ গাড়ি চলাচল করে। শহরের মধ্যে তিনটি ইন্টার সেকশন রয়েছে। আলেখারচর ক্রসিং হলো কুমিল্লা শহরের প্রবেশ দ্বার। ওই ক্রসিং দিয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশের গাড়িগুলো প্রবেশ করে। প্রতিদিন এখানে বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটে। বিএনপি দলীয় প্রার্র্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেন, তিনি নিজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে করপোরেশন নিজস্ব অর্থায়নে রাস্তা, ড্রেন ও ফুটপাথ উন্নয়ন, ড্রেনের আবর্জনা পরিষ্কারে তদারক করেছি। জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনে একটি মাস্টার প্ল্যানও করা হয়েছে। মেয়র নির্বাচিত হলে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক সম্প্রসারণ ও খাল সংস্কারের মাধ্যমে নগরীর জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনে প্রাধান্য দেবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্র্থী আঞ্জুম সুুলতানা সীমা বলেন, মেয়র নির্বাচিত হলে কুমিল্লা নগরীর জলাবদ্ধতা, যানজটসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান করবেন।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৮ হাজার। পুরুষের তুলনায় নারী ভোটারের সংখ্যা দুই হাজার বেশি। বিশেষ করে শহরের পূর্র্র্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের নারী ভোটাররাই ফ্যাক্টর। নারী ভোটারদের মধ্যে ভোট দেয়ার প্রবণতা বেশি। গত নির্বাচনেও ভোটকেন্দ্রগুলোতে নারী ভোটারের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। অন্যদিকে সংখ্যার দিক থেকে যেমন পুরুষ ভোটার কম, কর্মজীবীর সংখ্যা বেশি। প্রায় ১৫ হাজারের মতো পুরুষ ভোটার চাকরি সূূত্রে অবস্থান করছেন বিদেশে ও জেলার বাইরে। ইচ্ছে করলেও তাদের বড় অংশটি ভোটের দিন উপস্থিত থাকতে পারবেন না। ফলে কুসিক নির্বাচনে নারী ভোটাররাই হয়ে দাঁড়িয়েছেন মূূল ফ্যাক্টর। তাই নারীরা যে প্রার্থীর পক্ষে ঝুঁকবে ফলাফল তারই অনুকূলে যাবে। আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার প্রত্যাশা দল-মতের চেয়ে নারী হিসেবে তার দিকেই ঝুঁকবে নারী ভোটারদের মন। কারণ উপজেলা নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে ৮০ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও বিএনপি দলীয় প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু সেরকম মনে করেন না। তার মতে, নারী হলে যে নারী ভোট পাওয়া যাবে এমনটা নয়। এছাড়া নারী ভোটারদের মধ্যে ধানের শীষের সমর্থকই বেশি। কুমিল্লার নারীরা অনেক সচেতন। তবে রাজনৈতিক মহল মনে করেন, নারায়ণগঞ্জে ডা. আইভী মেয়র নির্র্বাচিত হওয়ার পর সারা দেশে নারী প্রার্থীদের প্রতি নারী ভোটারদের আগ্রহ বেড়েছে। তবে ডা. আইভীর মতো ক্যারিশম্যাটিক নন সীমা। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীই এখন টার্র্গেট করেছেন নারী ভোটারদের। সাক্কু-সীমা এখন ছুটছেন রান্না ঘরে কিংবা কর্মজীবী মহিলাদের কর্মস্থলে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোটারদের এক চতুর্র্থাংশ হচ্ছে সংখ্যালঘু। নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডেও দেড় শতাধিক এলাকায় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের এ ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। এ হিসেবেও এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। ঐতিহ্যগতভাবে সংখ্যালঘু ভোটারদের বিবেচনা করা হয় আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। তাই নির্বাচনে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ভোট বিএনপি প্রার্থীর জন্য বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎপরতা শুরু হয়েছে কুমিল্লার হিন্দু সমপ্রদায়ের সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ, পূজা উদযাপন পরিষদ, আন্তর্জাতিক সংগঠন মাইনরিটি রাইটস কমিশন ও স্থানীয় সংগঠন মাইনরিটি রাইটস ফোরামসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সংগঠন। তবে নগরীর হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংখ্যালঘু সব ভোট আওয়ামী লীগ প্রার্থী পাবে এ ধারণা ঠিক না। শংকর হত্যার ঘটনায় আঞ্জুম সুলতানা সীমার পরিবারের প্রতি কুমিল্লার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এখনও মনে রাগ- ক্ষোভ বয়ে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে কুমিল্লা সিটিতে হিন্দুদের একটি অংশের সমর্থন রয়েছে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে। মেয়র হিসেবে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে একটি আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সাক্কুর।
কুসিক নির্বাচনের আরেকটি ফ্যাক্টর নতুন ভোটার। তাদের সংখ্যা ৩৮ হাজার ২৮৭ জন। যারা এবারই প্রথমবারের মতো ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন কুসিক নির্বাচনে। নতুন ভোটারদের সঙ্গে আলাপে উঠে এসেছে তাদের পছন্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে ব্যক্তি ইমেজ, যোগ্যতা। তাদের কাছে দলীয় প্রতীক খুব একটা বিবেচ্য বিষয় নয়। তারপরও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ নানা কারণে বড় দু’দলে বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সামান্য সংখ্যক ভোটারই ভোট দেবে নিজস্ব দৃৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এছাড়া তাদের সামনে বিকল্প কোনো প্রার্র্থীও নেই।
কুমিল্লা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কিংবদন্তিতুল্য ঘটনা হচ্ছে আফজাল খান-বাহার দ্বৈরথ। এ দ্বৈরথ নিয়ে রয়েছে বহু গল্প। বিএনপির প্রয়াত নেতা কর্র্নেল (অব.) আকবর হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি কুমিল্লায় আসতেন কম। এর জবাবে বিএনপির এ নেতা বলতেন, তার কুমিল্লা যাওয়ার দরকার হয় না; কারণ সেখানে তার দুইজন কর্মী (আফজাল-বাহার) রয়েছেন, যারা তার নির্বাচনী মাঠ ঠিক রাখেন। এভাবেই আফজাল-বাহারের দ্বৈরথের সুফল নিতো বিএনপি। বিগত সিটি নির্বাচনের পর অস্তাচলে আফজালের রাজনীতি। অন্যদিকে বাহার এখন সদর আসনের এমপি। প্রশ্ন উঠেছে চিরবৈরিতা ভুলে বাহারউদ্দিন বাহার কি দলীয় রাজনীতিতে এককালের প্রতিদ্বন্দ্বীর কন্যাকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দেবেন, নাকি কৌশলে সব ম্যানেজ করে চলবেন। নৌকার প্রার্থী সীমা প্রচারণায় বাহারের কর্র্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের দাবি করলেও দৃশ্যত ভোটের মাঠে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় বাহারপন্থিরা। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, সরাসরি দলীয় সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামতে বিধিনিষেধ রয়েছে মন্ত্রী-এমপিদের। এ সুযোগে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ার সুযোগ রয়েছে সরকারদলীয় সদর এমপি বাহারের। এ ভীতি ও আশঙ্কা কাটছে না সীমা সমর্থকদের। কুসিক নির্র্বাচনে তাই নৌকার প্রার্থীর জন্য বড় ফ্যাক্টর সদরের এমপি বাহারপন্থিদের ভোট। তার ওপর আফজাল পরিবারের ক্ষমতার দাপটের বিষয়টি ফেলতে পারে নেতিবাচক প্রভাব। অন্যদিকে বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্র্যন্ত নেতাকর্মীরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে ঐকমত্য হয়ে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। তবে, বিএনপি নেতা মনিরুল হক চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর ও সদর দক্ষিণের একাংশ নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছেন বিএনপি প্রার্থী সাক্কু।
কুমিল্লা সিটিতে একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে ২০দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতের। জামায়াতের সমর্থন পাল্টে দিতে পারে ভোটের চিত্র। নীতিগতভাবে তাদের সমর্থন ধানের শীষের পক্ষেই যাবার কথা। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাপক দমন-পীড়নের শিকার দলটির নেতাকর্মীরা। ফলে রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হয়ে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করবে নাকি পরিস্থিতি উত্তরণে তলে তলে সরকার দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে সে আশঙ্কা স্থানীয় বিএনপি নেতাদের। ফলে জোটের প্রধান মিত্র জামায়াতকে নিয়ে দ্বন্দ্ব কাটেনি বিএনপির।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর