মার্চ ১৯৭১ ভুট্টোর চোখে শেখ মুজিব

একাত্তরের মার্চে আমাদের এই অঞ্চলে বিরাট একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেল পাকিস্তান। জন্ম হলো বাংলাদেশের। একটা দেশ ভেঙে আরেকটা দেশের জন্ম এবং তা–ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নয়, একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, এমন উদাহরণ সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে আর চোখে পড়ে না।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যখন তৈরি হয়, তখন এ নিয়ে বাঙালি মুসলমানের আবেগের কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু মোহমুক্তি হতে দেরি হয়নি। প্রথম গোলটা বাধল রাষ্ট্রভাষা নিয়ে, যার সূচনা ১৯৪৭ সালেই। ১৯৫২ সালে ভাষার প্রশ্নে বাঙালি তরুণদের বুকের রক্ত ঝরল। তারপর নানা ঘটনায় কেবলই অনিবার্য একটা পরিণতির দিকে ধেয়ে যাওয়া। অবশেষে ১৯৭১ সালে সব প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেল।

১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশ একটা ছন্দের মধ্যে ছিল। ১ মার্চ ছন্দপতন হলো। মার্চের ২৫ তারিখ পর্যন্ত বাঙালির মনোজগতে যে পরিবর্তনটুকু ঘটে গেল, তার পরিমাপ করা সহজ নয়। ১ মার্চ বাঙালি জনতা রাজপথেই পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ঘোষণা করল স্বাধীনতা। ২৫ মার্চ মাঝরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হঠাৎ আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই সূচনা হলো বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ।

একাত্তরের এই পালাবদলের প্রধান অনুঘটক ছিলেন তিনজন। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান, পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান—তিনজনই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের দুই যুগের পুরোনো রাষ্ট্রটি দুই টুকরো হচ্ছে। এই ভাঙার দায় তাঁরা চাপাতে চেয়েছেন একে অন্যের কাঁধে। এ প্রসঙ্গে আবেগ যতই থিতিয়ে আসছে, ততই উদ্‌ঘাটিত হচ্ছে সত্য। ধীরে ধীরে অজ্ঞানতার পর্দাটা সরে যাচ্ছে, অজানা তথ্য বেরিয়ে আসছে এবং আমরা ইতিহাসের মুখোমুখি হচ্ছি।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে যে মেরুকরণ ঘটল, তারপর পাকিস্তানের অখণ্ডতা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারটি প্রায় দিবাস্বপ্নের মতো হয়ে যায়। এক হাজার মাইলের দূরত্বে দুটো অঞ্চল, মাঝখানে ‘বৈরী’ প্রতিবেশী। সেখানে দুই মেরুর যুযুধান দুটো রাজনৈতিক দল নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর আস্থা পেয়ে কীভাবে একমত হয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সংবিধান তৈরি করবে—এটা একটা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে গেল। তখন অনেকেই দেয়ালের লেখা পড়তে পারেননি। তবে আমি নিশ্চিত যে নিজ নিজ বলয়ে জনমানুষের নেতা মুজিব এবং ভুট্টো ঠিকই তা পড়তে পেরেছিলেন। তবে তাঁদের পক্ষে কোনোভাবেই একমত হওয়া সম্ভব ছিল না। যদি আপসের মাধ্যমে একটা মীমাংসা হতো, তাহলে হয়তো অনেকে বলতেন—মধুরেণ সমাপয়েৎ। কিন্তু একটা যুদ্ধ এড়ানো গেল না। লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হলো, মানুষের বসতি পুড়ে ছাই হলো, কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হলেন।

আমরা জানি, শেখ মুজিব রক্তপাত চাননি। তিনি চেয়েছিলেন সমঝোতার মাধ্যমে একটা ফয়সালা। মুজিববিরোধীরা এটাকে তাঁর দুর্বলতা হিসেবে প্রচার করে বলেন যে তিনি স্বাধীনতা চাননি, তিনি তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন ইত্যাদি। যাঁরা এসব কথা বলেন, তাঁরা না জেনে বলেন অথবা কোনো রাজনৈতিক মতলব থেকে বলেন। একাত্তরের জানুয়ারি মাসে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলাদা আলাদা সংলাপেই তিনি বুঝে নিয়েছিলেন যে ‘পাকিস্তান’ অধ্যায়টি এখন শেষ। কেউ কেউ বলেন, তিনি কেন তখনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না। সমালোচকেরা একটা কথা বুঝতে অক্ষম যে শেখ মুজিবকে শুধু তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ বা সরকার গঠনের কথা ভাবলে চলত না। তাঁর কাঁধে চেপেছিল সাত কোটি মানুষের দায়িত্ব কিংবা ভাগ্য। হিসাবে একটু গরমিল হলেই তার মাশুল হতো অত্যন্ত বেশি। তিনি তখন রীতিমতো পুলসেরাতের ওপর দিয়ে হাঁটছেন। তখন তিনি আর নিছক মেঠো রাজনীতিবিদ নন, একজন স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়ক। দৌড়ে পল্টন ময়দানে গিয়ে অনেকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। জনতা তাঁদের পেছনে ছোটেননি। মুজিব চেয়েছিলেন একটা ‘নেগোশিয়েটেট সেটেলমেন্ট’। সেটা হয়নি। তাঁর রাজনৈতিক কৌশলটি পরে তাঁর সহকর্মীরাও মানুষকে ঠিকমতো বোঝাতে পারেননি। সে জন্য অনেককেই বলতে শোনা যায়, তিনি যদি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিতেন, পরে আমাদের আর এত কষ্ট সইতে হতো না। এ কাজটি তিনি কেন করেননি, তার একটা ব্যাখ্যা তিনি বাহাত্তরের জানুয়ারিতে সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দিয়েছিলেন।

শেখ মুজিবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষ ছিলেন ভুট্টো। শেখ মুজিবকে এ দেশের অনেক বাঙালি রাজনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবী ভুল বুঝলেও ভুট্টো তাঁকে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে সরাসরি কথাবার্তা যেমন হয়েছে, তেমনি হয়েছে পরোক্ষে, জনসভায়, আলোচনায় বা গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে। সেখানে দুজনই একে অপরের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু কেউই পরস্পরের বিরুদ্ধে খিস্তিখেউর করেননি, ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন করেননি। অথচ মুজিবের হাঁটুর বয়সী কোনো নেতা বা পাতিনেতা অথবা সেনাবাহিনীর কোনো কোনো কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে এমনও বলতে শুনেছি যে মুজিব ‘বিট্রে’ করেছেন।

সত্তরের নির্বাচনের পর এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে শেখ মুজিবের পেছনে জনগণের ম্যান্ডেট আছে এবং তিনি পাকিস্তানে সরকার গঠন করবেন। তার মানে, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ভুট্টোকে বিরোধী দলের নেতা হয়েই থাকতে হবে। ভুট্টোর পক্ষে এটা হজম করা ছিল প্রায় অসম্ভব। অথচ দেখুন, মুজিব সম্পর্কে ভুট্টো কী বলেছেন:

আমি একাত্তরের জানুয়ারিতে যখন ঢাকা গেলাম, তখন আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোভাবে জানতে এবং বুঝতে পেরেছি। তাঁকে আমার মনে হলো অসম্ভব বিনয়ী। যে বিষয়গুলো সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে, সেসব নিয়ে তিনি যুক্তিসহকারে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলেন। যেসব ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট ধারণা নেই, সেই বিষয়গুলো তিনি অল্প কথায় সেরে ফেলেন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল ভাসা ভাসা এবং তিনি কিছু মৌলিক বিষয়কে খুব সহজ চোখে দেখতেন। আমার ধারণা ভুল হতে পারে, যদিও মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত কোনো পূর্বসংস্কার নেই। (সূত্র: জুলফিকার আলী ভুট্টো, দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি)।

শেখ মুজিবের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ব্যাপারটি ভুট্টো অস্বীকার করেছেন। তাঁর আপত্তি ছিল শেখ মুজিবের ‘ছয় দফা’ নিয়ে।
ভুট্টো মনে করতেন, ছয় দফা হলো ‘পাকিস্তানের গলার ফাঁস’। এটা হলো সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তানকে ভাঙার একটা ফর্মুলা। ভুট্টোর এই উপলব্ধি শেখ মুজিবকে বুঝতে এবং মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে। যাঁরা বলেন, মুজিব ছয় দফাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং ‘এক দফায়’ যেতে চাননি, তাঁরা ভুলে যান যে ছয় দফা ছিল এমন একটা প্রস্তাব, যা আজ হোক কিংবা কাল, বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করবে।

ভুট্টো এমনও বলেছেন যে মুজিব মাঝে মাঝে এমন ধারণা দিতে চাইতেন, যেন তিনি নমনীয় হলেই বা কী, তাঁর দলের চরমপন্থীরা এটা মেনে নেবে না। ভুট্টো জানতেন, মুজিবের মতো একজন নেতা কখনোই ‘গুটিকয়েক ছাত্রনেতা বা পিছু পিছু হাঁটা চরমপন্থীর কথায় চলার লোক নন।’ ঘটনাপরম্পরায় আমরা এখন বুঝতে ও জানতে পারি যে শেখ মুজিবের অনেকগুলো হাত ছিল। এক হাতে তিনি প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছেন, অন্য হাত দিয়ে তিনি রণহুংকার দিয়েছেন। তিনি একেকজনকে দিয়ে একেকটা কাজ করিয়েছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই হয়তো নিজেকে ভেবেছেন মূলধারা, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবতা হলো, সব ধারণা, প্রক্রিয়া ও শক্তির উৎস ছিলেন শেখ মুজিব নিজেই।

শেখ মুজিবের সঙ্গে ভুট্টোর যে মতপার্থক্য ছিল, ভুট্টোর মতে, তা ছিল নীতিগত। এটা ছিল ন্যায্যতার প্রশ্নে লড়াই। ভুট্টো মনে করতেন, মুজিবের কাছে ন্যায্যতা হলো বাংলার স্বাধীনতা, আর তাঁর কাছে হলো পাকিস্তান টিকিয়ে রাখা; মুজিব মনে করতেন, ছয় দফা হলো জনগণের সম্পত্তি, ভুট্টোর কাছে জনগণের সম্পদ হলো পাকিস্তান। ‘সুতরাং আমাদের মতাদর্শ ছিল সাংঘর্ষিক’—এটাই ভুট্টোর উপলব্ধি।

ওই সময়ের ঘটনাপঞ্জি নিয়ে শেখ মুজিব কোনো বই লেখেননি। বিচ্ছিন্ন কিছু বক্তৃতা, কথোপকথন এবং সাক্ষাৎকারে তাঁর মতামতের একটা প্রতিফলন আমরা পাই। একটা কথা আছে, তুমি কেমন মানুষ, এটা বোঝার জন্য সবচেয়ে ভালো নির্ণায়ক হলো তোমার সম্পর্কে তোমার শত্রু কী বলে। শেখ মুজিব সম্পর্কে ভুট্টোর মূল্যায়ন থেকে আমরা মুজিব-চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাই। এই ধারণা কিন্তু ইতিবাচক। মুজিব পাকিস্তান রাখতে চাননি, তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর