দেশপ্রেমিক নেতার প্রতিকৃতি আবদুল জলিল

তোফায়েল আহমেদ: মোহাম্মদ আবদুল জলিল ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিবেদিতপ্রাণ একজন রাজনীতিবিদ। তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ২০০৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নওগাঁ-৫ আসন থেকে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে তিনি কয়েক বছর সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

আবদুল জলিল ১৯৩৯ সালের ২১ জানুয়ারি বর্তমান নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার চকপ্রাণ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ফয়েজউদ্দিন আহমেদ এবং মায়ের নাম জরিনা ফয়েজ। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। নওগাঁ কেডি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) শেষে ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর তিনি লন্ডনে লিংকনস ইন-এ আইন পড়তে শুরু করেছিলেন। তবে শেষ না করেই ‘৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন চলাকালে স্বদেশে ফিরে আসেন।

আবদুল জলিলের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে ছাত্রজীবনে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়ে। ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত কর্মী। তার অন্যতম পরিচয় ছিল ‘নওগাঁর জলিল’ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন ৭ নম্বর সেক্টরের প্রধান সংগঠক। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলে তিনি নওগাঁ তথা উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং শুরুর দিকেই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান। বালুরঘাটে আত্রাই নদীর পূর্বতীরে শ্মশান কালীমন্দিরের পাশে একটি বাড়িতে প্রথমে ছিলেন। পরে বাঙ্গালীপুর, মধুপুর, কামারপাড়া, প্যারিলাসহ ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করেন। ওই সব ক্যাম্প থেকে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের শিলিগুড়ি পানিঘাটায় পাঠানোর দায়িত্ব পালন করেন। নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এসব ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ পেয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু তাকে ‘উত্তরাঞ্চলের জেনারেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। নওগাঁ শহরের উত্তর-পশ্চিম পাশে আবদুল জলিল চত্বরে তার প্রচেষ্টায় নির্মিত ৭১ ফুট উঁচু ‘বিজয় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ’ মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে।

১৯৭৩-এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে তিনি নওগাঁ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল গঠিত হলে তাকে নওগাঁর গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। চার বছর কারাভোগের পর ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান। ১৯৮১ সালে তাকে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক করা হয়। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসন জারি করা হলে আবার গ্রেফতার হন। ১৯৮৩ সালে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে পরপর দু’বার তিনি নওগাঁ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো নওগাঁ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। আশির দশকে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সে সময় বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকায় নিয়মিত আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে তার কণ্ঠস্বর শোনা যেত। ১৯৯২ সালে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য করা হয়। ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে ১৯৯৮ সালে তাকে টেকনোক্র্যাট কোটায় বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০১ ও ২০০৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নওগাঁ সদর আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০২ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য।

২০০৭-এ ক্ষমতা দখলের পর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নবিদ্ধ সংস্কার-উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর মধ্যে একটি ছিল ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল দুই দলের দুই নেত্রীর অপসারণের মাধ্যমে জাতির বিরাজনীতিকরণ। এ সময় আওয়ামী লীগের যারা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রমকে সমর্থন দেননি, আবদুল জলিল তাদের একজন। ফলে তাকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা হয়। ২০০৯-এ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে তিনি সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং কাউন্সিলে তাকে উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করা হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে জলিল ভাই ছিলেন আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। আমি তাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। তিনি আমাকে ভীষণভাবে স্নেহ করতেন। ছাত্রজীবন থেকেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠতা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জলিল ভাই যখনই কলকাতায় আসতেন, আমার সঙ্গে মিলিত হতেন। আমি তখন মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান, থাকি ব্যারাকপুরে। আমরা বসে পরিকল্পনা করতাম, কীভাবে কী করা যায়। সেই দিনগুলো সত্যিকার অর্থেই আমাদের জীবনের সোনালি দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিনই ছিল আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধকালীন সেই দিনগুলোতে শ্রদ্ধেয় জলিল ভাই দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাকে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। তখন আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য দলের বাইরে একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করি। তখন উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন প্রিয় নেতা জলিল ভাই। প্রতি মাসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হতো। বঙ্গবন্ধু তাকে নির্দেশ দিতেন। উত্তরাঞ্চলে যখন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ব্যাপকভাবে থানা লুট, ফাঁড়ি লুট শুরু করেছিল, তখন অত্যন্ত দক্ষতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি কাজ করেছেন।

তার জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, তিনি ছিলেন অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী একজন মার্জিত মানুষ। তার আচার-আচরণ, চালচলন ছিল উঁচুস্তরের। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। দলের প্রত্যেক কর্মীকে তিনি পরিবারের সদস্যদের মতোই ভালোবাসতেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দু’বেলা দলীয় কার্যালয়ে যেতেন। এমনকি যখন ঢাকা শহরের বাইরে কেন্দ্রীয় সফরে যেতেন, ফেরার পর যত রাতই হোক, একবার আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে সংগঠনের কাজকর্ম কীভাবে চলছে, তা স্বচক্ষে দেখতেন। সাংগঠনিক দিকে তিনি দক্ষ ছিলেন।

দুর্ভাগ্য হলো, ২০০৭-এর ১/১১-এর পর তাকে গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। যখন তিনি অসুস্থ অবস্থায় ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, আমি স্বচক্ষে দেখেছি তার করুণ অবস্থা। মানসিক, শারীরিক সব দিক থেকেই ভেঙে পড়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যা এবং হৃদরোগে ভুগছিলেন। তার হৃৎপিণ্ডে তিন-তিনবার বাইপাস সার্জারি হয়েছিল। ২০১৩-এর ফেব্রুয়ারিতে নওগাঁয় অবস্থানকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে ঢাকায় এনে কিছুটা সুস্থ হলে ২৬ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ৪ মার্চ সোমবার তার হৃৎপিণ্ডে পুনর্বার অস্ত্রোপচার করা হয়। তিনি অস্ত্রোপচার চাইছিলেন না। পাঁচ ঘণ্টা স্থায়ী অস্ত্রোপচার সফল হয়। জ্ঞান ফেরায় কথাও বলেছিলেন। কিন্তু কিডনিতে ডায়ালাইসিসজনিত জটিলতায় ৬ মার্চ ভোর থেকে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং সংজ্ঞাহীন, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া অবস্থায় বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।

আবদুল জলিলের মরদেহের সঙ্গে আমি নওগাঁ গিয়েছিলাম। লাখো লোকের সমাবেশে সেখানে জানাজা হয়েছিল। আজ তার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যার প্রতি রইল আমার সমবেদনা। জলিল ভাই যখন ১৪ দলের সমন্বয়ক তখন আমরা প্রায়ই তার গুলশানের বাসভবনে মিলিত হতাম। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন এমন একজন সাধারণ সম্পাদক, যার তুলনা তিনি নিজেই। আমরা তাকে হারিয়েছি।

আমাদের দুর্ভাগ্য, মাত্র কিছুদিন আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি আমরা হারালাম সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। ২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের প্রিয় নেতা আবদুর রাজ্জাককে। রাজ্জাক ভাই একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। সুরঞ্জিত বাবু একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে আমরা এসে গেছি। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে অতীতের অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। জলিল ভাই সারাজীবন আমার স্মৃতিতে অম্লান ও অক্ষয় হয়ে থাকবেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন মহান নেতা ছিলেন।

tofailahmed69@gmail.com

আওয়ামী লীগ নেতা; বাণিজ্যমন্ত্রী

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর