মধুবালার ডাক লাগবনি লন বাবা, গাঁজা

‘এই বাবা আছে। গাঞ্জা আছে। নিয়া যান। ক’টা দিমু। ক’টাকার দিমু। লন। এই কালা মামা। সোনা ভাইয়া। এই চশমা ভাই। লাল শার্ট। এই চিকনা। লাগবো নি। বাবা না গাঁজা। এভাবে প্রকাশ্য ডেকে ডেকে পণ্য বিক্রির মতো বিক্রি করছে মাদক বিক্রেতাদের। বিক্রেতাদের মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। তরুণী থেকে বৃদ্ধা, যুবক থেকে প্রৌঢ় সবাই স্বতঃস্ফূর্ত। কাওরান বাজার ও তেজগাঁও রেল লাইনে প্রতিদিন মাদকের পসরা সাজিয়ে এমন প্রতিযোগিতায় নামে শতাধিক মাদক বিক্রেতা। কাপড়ের ব্যাগে গাঁজার পুঁটলি। হাত বা বুকে গুঁজে রাখা কৌটায় ইয়াবা ট্যাবলেট। বাসায় অন্যান্য মাদক।
গত সোমবার এমন শতাধিক বিক্রেতার মাদকের পসরা দেখা গেছে সেখানে। তবে স্বাভাবিক পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের চেয়ে এখানে রয়েছে কিছুটা ভিন্নতা। সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতাদের চেয়ে মাদকের রাজ্যে উভয়ের হৃদ্যতা বা ঘনিষ্ঠতাও একটু বেশি। তড়িৎ কাজকারবার। সম্বোধনে আছে ঠমক-চমক। দাম দর ঠিক ঠাক। ক্রেতার টাকাও আগে থেকে গুণা থাকে। শুধু পকেট থেকে বের করে দেয়া। ৩০, ৫০ ও ১০০ টাকা এগিয়ে দিতেই ক্রেতার হাতে গুঁজে দেয়া হচ্ছে গাঁজার ছোট, মাঝারি ও বড় পুরিয়া। ১০০ ও ২৮০ টাকা এগিয়ে দিতেই হাতে চলে আসছে ছোট ও বড় আকারের একটি করে ইয়াবা ট্যাবলেট। বেশি ক্রয়ে টাকাগুণে নেয়ার সময়টুকুই কেবল অপেক্ষা। এরপরই নিজে পথ ধরছে ক্রেতা। দর কষাকষিও কদাচিৎ। দর কষাকষি বা টাকা কম দিলে ক্রেতাদের হজম করতে হয় মেয়েলি কণ্ঠের গালাগালি। মুখের ওপর ছুড়ে মারা হয় টাকা। অবশ্য বেশি কেনায় ১০-২০ টাকা বলে কয়ে কম দিতেও দেখা গেছে।
মাদক বিক্রেতা ১৬ বছরের তরুণী মধুবালা বলেন, আগে কমলাপুর রেল স্টেশনে পসরা সাজিয়ে ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করতাম। বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে করি। থাকিও এখানকার বস্তিতে।
সোমবার বেলা ১১টা। কাওরান বাজারের পাইকারি মাছ বাজার সংলগ্ন গলি দিয়ে রেল লাইনে উঠতেই দেখা গেল পাশাপাশি দু’টি বেঞ্চ পাতা। একটি জলছাপের আল্পনার কাপড়ের থলে সামনে নিয়ে বসে আছে আলতা-প্রসাধনী মাখা কিশোরী মধুবালা। সামনে কাপড়ের ব্যাগ। নিচে মাদুর পেতে বসে আছে আরো দু’তরুণী। লায়লা ও শিউলি। তাদের সামনেও কাপড়ের ব্যাগ। তিনজনের ব্যাগ ভর্তি কাগজে মোড়ানো গাঁজার পুঁটলি। বুকে গুঁজানো ছোট কৌটায় লাল রংয়ের ইয়াবা। চোখে চোখ পড়তেই নিয়া যান। কটা দিমু।
ষোড়শী মধুবালা। সোমবার ছিল চাঁদপুরের এই কন্যার বিয়ের তৃতীয় দিন। হাতে-পায়ে আলতা। মুখে লেগে আছে মেকআপের জরি। স্বামী সিএনজি চালক রনি বেরিয়ে গেছে গাড়ি নিয়ে। আর সকালেই প্রতিদিনের মতো ব্যবসার পসরা সাজিয়ে মধুবালা রেল লাইনের ধারে। অন্য মাদকেও ঘাটতি নেই। চাইলেই বাসা থেকে এনে দিতে প্রস্তুত। তার পাশে একটি কাঠ ও পলিথিন পেতে বসা লায়লা ও শিউলি। অন্তঃসত্ত্ব্বা লায়লা দু’পা ছড়িয়ে বসেছে। দু’পায়ের মাঝখানে রাখা কাপড়ের পুটলির মধ্যে গাঁজা। আর শিউলির পুঁটলির মুখটা অর্ধেক ডাকা। কোলে শিশু পুত্রকে নিয়েই চলছে তার ব্যবসা।
বেলা ১১টার পর এক কিশোর রেললাইন ধরে কাছে আসতেই মধুবালার ডাক ‘গাঞ্জা না বাবা’। মাঝখানে বসা শিউলী তার দিকে তাকিয়েই বললো ‘লাগবো না তার’। মিনিট খানেক পর লুঙ্গি পরা এক লোক দেখেই মধুবালা ডাক দেন, ‘এই লুঙ্গি। নিয়া যান।’ কিন্তু লুঙ্গি পরা লোকটি এগিয়ে যায় লায়লীর কাছে। ‘ছোট একটা দেন’ বলে লায়লীর হাতে টাকা তুলে দিতেই সে হাতে গুঁজে দিলেন এক পুরিয়া গাঁজা। ছোট পুরিয়াগুলো বিক্রি হচ্ছিল ৩০ টাকায়। ২০ টাকায়ও পাওয়া যায়। উত্তর দিক থেকে হাতে বস্তাসহ ময়লা পোশাকে এলো শিশু টোকাই। মুখে কোনো কথা নেই। এগিয়ে দিল ১০০ টাকার নোট। লাইলী তুলে দিল একটি ছোট্ট লালচে ইয়াবা টেবলেট। বেশ কয়েক গজ দূরে গিয়েই সে তা সেবনে বসে পড়লো। লাইলী ‘এই চশমা’ বলে অন্য একজনকে ডাক দিলো। মনে হলো জিন্স ও গেঞ্জি পরা লোকটির সম্মানে লেগেছে। সে তার কাছে নয়, প্রথমে থাকা মধুবালার কাছ থেকেই নিল গাঁজা। পরে আসা লোকটিও তার কাছ থেকেই ৩০০ টাকার নোট দিয়ে তিনটি ইয়াবা ট্যাবলেট কিনলো। এরই মধ্যে কমলাপুর থেকে ধেয়ে এলো একটি ট্রেন। তখন এই মাদক বিক্রেতারাই স্বেচ্ছাসেবী। লাইনের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকা লোকদের সরে যেতে হাঁকডাক। ট্রেন পাশ দিয়ে যেতেই পেছনের বাসার চালা থেকে নেমে মাটি পর্যন্ত ঝুলন্ত ত্রিপলের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো মধুবালা ও শিউলী। ধুলবালি থেকে রক্ষার জন্যই ওই চেষ্টা। ট্রেন যেতেই আবার বেরিয়ে পড়লো তারা।
বেলা ১২টার পর ক্রেতার সমাগম বাড়তে দেখা যায়। আধঘণ্টা পর্যন্ত সাধারণ চোখে পথচারী বলে মনে হওয়াদের অর্ধেকের বেশি লোকই গাঁজা ও ইয়াবা কিনে নিলো। পাইকারিতেও কিনলো কয়েকজন। আবদুর রহিম নামে এক লোক এসে চাইলো ১২টি গাঁজার পুরিয়া। কিন্তু সে দিল ১০টার দাম। কারণ জানতে চাইলে লাইলী বললো ‘নিয়মিত কাস্টমার। তাই দু’টা ফ্রি’। দুপুরে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলো সাদিয়া। সে শিউলির বোন। মধুবালার পাশে সে মাটিতে তক্তা পেতে বসলো। তার ব্যাগ থেকে বের হলো কাগজের বান্ডেল ও অন্তত এক কেজি গাঁজার পলিথিন। তার নিচে পুঁটলি। ছোট পুঁটলি ৩০ টাকার হলেও সে ২০ টাকায়ও নতুন পুঁটলি বানিয়ে দিচ্ছিল। তখন চারজনের মধ্যে তার বিক্রিই বেশি হচ্ছিল। দুপুরের পর লাঠিতে ভর দিয়ে এলো এক ভিক্ষুক। নাম শুক্কুর মিয়া। ভিক্ষার পাশাপাশি তার ক্ষুদ্র মাদক ব্যবসা। তিনটি ইয়াবা নিল। তারপর ২০ ও ৫০ টাকার নোটের সঙ্গে দিল অনেকগুলো পাঁচ ও দুই টাকার নোট। দিতেই তা ছুড়ে মারলো সাদিয়া। বললো, ‘ভাঙতি টাকা এখানে চলে না। তা তুই জানস না। দে, আমার বাবা ফেরত দে।’ শুক্কুর বলে, ‘আজ টাকা বদলির দোকানটি খোলা না থাকায় এনেছি। আজ নেয় না বোন।’ কিছুতেই নিবে না সে। অগত্যা সে ভাঙতি টাকা দিয়ে নোট বদলে আনার জন্য একটি দোকানে দিকে চললো।
সাদিয়া বলেন, চোখ-মুখ দেখলেই বুঝতে পারি কারা নেশা করে। তাদের চলাফেরায়ও বুঝা যায়। বলেন, এই রেললাইনে শতাধিক নারী ও পুরুষ মাদক বেচা কেনা করে। রাত দিন ২৪ ঘণ্টাই খোলা মাদকের হাট। মাদক কিনে এখানে সেবনের ব্যবস্থাও আছে বাসাগুলোতে। বসরা পুলিশকে ম্যানেজ করে। ধরা পড়লে ছাড়িয়ে আনে। পুলিশকে ম্যানেজ করে বা লুকোচুরি মাধ্যমেই চলে এই প্রকাশ্য মাদক বেচা-কেনা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর