প্রধানমন্ত্রী, শাজাহান খান ও রাঙাকে বরখাস্ত করুন

পীর হাবিবুর রহমান

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনি নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানকে বরখাস্ত করুন। আমরা তার পদত্যাগ চাই। পদত্যাগ তিনি করবেন না। ক্ষমতার স্বাদ যারা একবার পায়, শত বির্তক, সমালোচনার ঝড়ে অবনত মস্তকে পদত্যাগ করতে পারে না। নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, আপনার আস্থা ও বিশ্বাসের মর্যাদাই শুধু খর্ব করেননি, তিনি মন্ত্রী হিসাবে বঙ্গভবনে যে শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন; তা ভঙ্গ করেছেন। শপথ ভঙ্গকারী, জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী, পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকা শাজাহান খান যত পারুন শ্রমিক রাজনীতি করুন। কিন্তু মন্ত্রী তিনি থাকতে পারেন না। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারি বাসভবনে বসবাস করে তিনি পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনে ঠেলে দিয়ে জনদুর্ভোগই সৃষ্টি করেননি, উগ্র, হটকারী, দায়িত্বহীন কাজ করেছেন। একজন দায়িত্বহীন মানুষ রাজনীতিতে যতই প্রভাবশালী হন না কেন, সরকারের মন্ত্রী তিনি থাকতে পারেন না। এর আগেও তিনি পরিবহন শ্রমিকদের উগ্রমূর্তির মধ্যমনি হয়েছিলেন।

বঙ্গভবনে শপথ নেয়ার আগে সারাদেশের শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ ফোরাম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি শপথ ভঙ্গ করে অনুরাগ বা রাগের বশবর্তী হয়ে আদালতের রায়কে অবজ্ঞা করে পরিবহন মালিক শ্রমিক যে ধর্মঘট অন্যায়ভাবে করেছে, তাতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। সোমবার দুপুরে খুলনা সার্কিট হাউজে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সেখানকার বিভাগীয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের বৈঠকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু রাতেই নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের সরকারি বাসভবনের বৈঠকে সেই সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। তার ইঙ্গিতেই গভীর রাতে ঘোষণা আসে, মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে লাগাতর পরিবহন ধর্মঘট। আকস্মিক এই ঘোষণায় চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি হয় মানুষ। সমালোচিত হয় সরকার।

সেই বৈঠকে বাস ও ট্রাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙাসহ প্রায় ৫০ জন মালিক শ্রমিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল যেখানে বলেছেন, আদালতের রায়ের জবাবে জনগণকে কষ্ট না দিয়ে আদলতেরই আশ্রয় নিন। সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যেখানে বলেছেন, ধর্মঘট অযৌক্তিক; প্রত্যাহার করা উচিত। সেখানে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, চালকেরা মৃত্যুদণ্ডাদেশ বা যাবজ্জীবনের মতো রায় মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। তিনি আরো বলেছেন, চালকরা ধর্মঘট করছেন না, তারা অবসরে গেছেন। রীতিমতো তিনি জনদুর্ভোগের মুখে তামাশা করেছেন।

দেশের সৃষ্টিশীল জগতের দুই কীর্তিমান সন্তান তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন। সেই সময় প্রতিবাদের ঝড় উঠলে গোটা দেশ বেদনাসিক্ত হয়ে উঠলে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই মামলায় ঘাতক চালক জমির উদ্দিনকে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে শাজাহান খান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারেননি। আদালাতের রায়কে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে তিনিও মেনে নেননি, পক্ষপাতিত্ব করেছেন। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রাগের বশবর্তী হয়েছেন। একজন শপথগ্রহণকারী মন্ত্রী দায়িত্বশীল নেতা হিসাবে এমনটি করতে পারেন না। শাজাহান খান যে অপরাধে অপরাধী একই অপরাধে অপরাধী পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙাও। গোটা দেশ জনদুর্ভোগের মুখোমুখি হয়ে এই দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে।

মালিক-শ্রমিকরা এই ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে আদালতের রায় পাল্টানোর যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে তার নেপথ্য শক্তির উৎস হচ্ছে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ও প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙা। দেশের সংবিধান, আইন, বিধি, বিধান, আদালতের রায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে নত হতে পারে না। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কয়েককোটি টাকার যে ক্ষতিপূরণ মামলা হয়েছিল সেটিও এখন উচ্চ আদালতে। সিলেটের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ইফতেখার হোসেন শামীম গ্রীন লাইনে সিলেট যাবার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। বেপোরোয়া চালকদের কারণে নিয়ত মানুষের জীবন রাস্তায় হুমকির মুখে। মৃত্যুর সঙ্গে পায়ে পায়ে বাস করা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বাংলাদেশের জরিপ অনুসারে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। এক বছরে ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। গত ৬ বছরে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের জীবন নিভে গেছে রাজপথে। কিন্তু এইসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। সিলেটেও গ্রীণ লাইনের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলা রয়েছে নিহতের পক্ষে। মালিকপক্ষ সেই ক্ষতিপূরণ দিতে চান না বলে, ঘাতক চালকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই পরিবহন ধর্মঘট ঘটিয়েছেন। এই ধর্মঘট যদি সরকার বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল ঘটাতো, তহালে ব্যাপক ধরপারকের মুখে সেই দলের নেতাদের এনে রিমান্ড ও জেলের ভাত খাওয়ানো হতো। এই ধর্মঘটের নেপথ্যে যারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে, তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা উচিত। দেশের আইন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খুনি চালকের পক্ষ হয়ে কোনো ধরণের প্রতিবাদ কর্মসূচী গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তারা লাইসেন্সপ্রাপ্ত খুনি নন যে, বেপোরোয়া গাড়ি চালিয়ে, গতিসীমা লংঘন করে মানুষের জীবন নিভিয়ে দেবেন। খুনি চালকদের পক্ষে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে পরিবহন ধর্মঘটের জড়িত থাকার অভিযোগে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ও প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙার পদত্যাগ এখন সময়ের দাবি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে, শপথভঙ্গকারী, গণমানুষের স্বার্থবিরোধী ও আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে পরিবহন ধর্মঘটকারীদের যুক্ত থাকার অপরাধে এদেরকে বরখাস্ত করুন। এতে সবার জন্যই অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ধর্মঘট শেষ হলেও এই নৈরাজ্য সৃষ্টির দায় তাদের নিতেই হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর