খালেদার দুঃসময়, কাদেরের আকুতি

রাজনীতির গতি-প্রকৃতিটাই এমন সকালের সোনামাখা রোদ বুকে ডিগবাজি খাওয়ার সুখ শেষ করতে না করতেই মধ্য দুপুরে ঈশানকোণে মেঘ জমে ওঠে। আবার গোধূলিবেলায় পশ্চিমে লাল আভা ছড়িয়ে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্যের মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই আসে নতুন খবর। সকালে লিখতে ভাবি এক বিষয়ে, রাতে সেখানে হাজির হয় আরেক বিষয়। তাও ভালো এখন রাজনীতি অতীতের মতো ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ নয়, ঝড়ের পূর্বাভাসও নেই।

নিস্তরঙ্গ রাজনীতির পর্দার অন্তরালে চলছে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির অংশগ্রহণের পরিণতি কী হতে পারে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ। নানা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর বিস্তর আলাপ-আলোচনা, জল্পনা-কল্পনা। পর্দায় সরকার পক্ষ বা শাসকজোট একতরফাই দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন এলাকা সফর শুরু করেছেন। নবগঠিত নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের জন্য ভোটযুদ্ধে সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণের এবং দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আস্থা অর্জনের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছেন। বিএনপির ভাগ্যই নয়; আগামী জাতীয় নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্য কোন পরিণতির মুখোমুখি হবে— সেটি নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলাপ-আলোচনা, জল্পনা-কল্পনার মৃদুমন্দ ঢেউ উঠেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যিনি গুলশানের শত কোটি টাকার বাড়ি নিয়ে বেকায়দায় রয়েছেন, তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া আদালতে দণ্ডিত হলেও উচ্চ আদালতে আপিল করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সরকারের ওপর মহল থেকেও যেসব বক্তব্য আসছে তাতে বর্তমান রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার যে দুঃসময় চলছে তা যে সামনে আরও কঠিন ও জটিল রূপ নেবে, তারই ইঙ্গিত বহন করছে। বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনেই যদি নির্বাচন, তাহলে পাঁচ বছর পর কেন? সব মিলিয়েই সন্দেহ ঘনীভূতই হচ্ছে, জোরেশোরে প্রশ্ন বইছে, বিএনপি কী আবার নির্বাচনের বাইরে থাকার ফাঁদে পড়ছে? বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আদালতে দণ্ডিত হয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হচ্ছেন?

জিয়া অরফানেজ দুর্নীতি মামলার রায় আসন্ন। বিএনপি নেতা মওদুদই যেখানে দণ্ডিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন, সেখানে রাজনৈতিক মহলসহ নানা পর্যায়ে একই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার দলের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন দুঃসময় অতীতে আর কখনো আসেনি। তেমনি আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তার ও দলের জন্য কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। অনেকে মনে করছেন, বেগম খালেদা জিয়াই নন; ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেখানে বিএনপির আরও কিছু দায়িত্বশীল নেতা নানা ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল যে প্রত্যাশাই করুক না কেন তার বিপরীতে আদালত দ্বারা দণ্ডিত হয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হলে বা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে শাসকজোট বা সরকার সেটি লুফে নেবে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের জন্য যেখানে শনির রাহু আগ্রাসী সেখানে আওয়ামী লীগ বা তার মিত্র শক্তির জন্য অথবা মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার জন্য বৃহস্পতি তুঙ্গে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ডাক দিয়ে বিএনপি জোট বা খালেদা জিয়া কার্যত যে ওয়াক ওভার দিয়েছিলেন, সেখানে এক বিস্ময়কর, নজিরবিহীন অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন সংবিধানের দোহাই দিয়ে শেখ হাসিনা বা তার সরকার হজমই করেননি, শুরুতে যে হিসাবই থাকুক না কেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থনও আদায় করতে সফল হয়েছেন। জনমত কার অনুকূলে, একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ জাতীয় নির্বাচন হলে ব্যালট বিপ্লবে কে অভিষিক্ত হবেন, সেই প্রশ্নের চেয়েও বাস্তবতা হচ্ছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতি এখনো শেখ হাসিনা ও তার জোটের অনুকূলেই রয়েছে। ক্ষমতার রাজনীতির হাওয়া বইছে শেখ হাসিনার অনুকূলেই।

অন্যদিকে, ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিকূল-বৈরী রাজনৈতিক আবহাওয়ার মুখোমুখি বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। অনেকে মনে করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে, আন্দোলনের কৌশলের অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হতো তা শেখ হাসিনা বা তার সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াত। সেই রাজনৈতিক আবহাওয়া তাদের প্রতিকূলে বইত। সেই সময় আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থী এলাকায় যাওয়াই বন্ধ করেননি, অনেক নেতা দেশের বাইরে গিয়ে নিরাপদ অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। বিএনপি সেই ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হলে প্রশাসনের একটি বড় অংশ তাদের পক্ষেই অবস্থান নিত। কিন্তু বর্জন ও প্রতিরোধের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল প্রশাসনের অনেকেই রাতারাতি আওয়ামী লীগের আস্থা ও অনুকম্পা লাভের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন।

বিএনপির অনেকেই মনে করেছিলেন, অতীতে দলের হঠকারী, উগ্র কর্মসূচি ও ভ্রান্তনীতির কারণে যে সাংগঠনিক শক্তিক্ষয় ঘটেছে, নেতা-কর্মীরা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত যেভাবে মামলার জালে বন্দী হয়েছেন তাতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে গিয়ে বিএনপি তাই শক্তিশালী গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিতে সরে আসে। এই দাবিতে অর্জন কতটা হয়েছে-সেটি যত না বড় প্রশ্ন, তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে বঙ্গভবন গঠিত সার্চ কমিটির মধ্য দিয়ে যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশীদারিত্ব বিএনপিও গ্রহণ করেছে। রাজনৈতিক দরকষাকষির জায়গা থেকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রস্তাব দেওয়ার কথা বললেও বিএনপি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিবন্ধন রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও সংসদীয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনই তাদের জন্য বড় ইস্যু। কিন্তু বিএনপি চাইলেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে নির্দ্বিধায় অংশগ্রহণ করবে এবং প্রশাসনের একটি অংশ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়বে, অন্যদিকে ভোট লড়াইয়ে দলের জন্য বের হয়ে আসা নেতাকর্মী-সমর্থকদের আবেগ-উচ্ছ্বাসে সরকারি দলের ঘাম ঝরিয়ে ভোটযুদ্ধে আংশিক হলেও লাভবান হবে সেই সুযোগ শাসকরা বিএনপিকে দেবে না বলেই অনেকে বিশ্বাস করেন।

এখানে পর্দার অন্তরালে বিএনপি নেতৃত্ব হতাশাক্ষুব্ধই নন; বিষণ্নচিত্তে অসহায় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। বিএনপির তরুণ নেতৃত্বের প্রাণশক্তি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত ও আদালত কর্তৃক দণ্ডিত পলাতক আসামিই নন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও দলের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া চাইলেই সরকার প্রধান শেখ হাসিনা আলোচনা ও সমঝোতার জন্য গণভবনের দরজা খুলে দেবেন— এমনটি কেউ বিশ্বাস করেন না। কারণ জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি জোট এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেনি, যাতে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টির সীমানায় শেখ হাসিনা ও তার সরকার চাপের মুখে পড়েছেন। বরং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় সামনে নিয়ে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার জোট গভীর সংকট ও বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে।

কেউ কেউ মনে করেন, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী, একুশের গ্রেনেড হামলার বিচার না করার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এবং ১৫ আগস্টে জাতীয় শোক দিবসে জন্মদিনের কেক কাটার জন্য অনুতপ্ত হৃদয় নিয়ে ক্ষমা চান; যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন এবং তারেক রহমানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বন্ধ করার ঘোষণা দেন তাহলেই কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আনুষ্ঠানিক সংলাপ হতে পারে। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, বিএনপি চাইলেই সরকার সেই সুযোগ দিয়ে ঝুঁকির পথ গ্রহণ করবে না।

সরকার আন্তর্জাতিক মহলের সামনে তার মন্ত্রী, নেতা ও এমপি যাদের বিরুদ্ধে দুদকসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে আদালতে তা যেমন স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেবে, তেমনি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াসহ তার দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি চাইবে। ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হয়ে খালেদা জিয়াসহ দলের প্রভাবশালী নেতারা নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হলে বিএনপির বড় অংশটি তাদের নেত্রীকে ছাড়া নির্বাচনে আসতে চাইবে না। এক্ষেত্রে সংসদ ও ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে ছিটকে পড়া বিএনপির হতাশাক্ষুব্ধ একটি অংশকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে চাইবে। সরকারি দলের অনেকে মনে করেন, এই অংশটি শেষ পর্যন্ত ভোটে আসবে। আর এই পরিস্থিতি দেখা দিলে, মহাজোট সরকারের অংশীদার ও সংসদে যেমন খুশি তেমন সাজিয়ে রাখা বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনী ময়দানে নামিয়ে দেবে। সেই আলোকেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ জোট গঠনের মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন বলে অনেকেই মনে করেন। এক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগার বা ভোটের বাইরে রেখে সংবিধান ও আইন, বিধি বিধানের ধারায় জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়েই আসবে না, সংসদে এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি জোটকে বিরোধী দলে বসাবে। ইতিহাসের শোধের ধারায় বিএনপিকে রাজনৈতিক ধারার বাইরে ছুড়ে ফেলার পথটিই নেবে।

যদিও অনেকে মনে করেন, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দণ্ডিত করে কারাগার ও ভোটের বাইরে রাখলে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন, কিন্তু শাসক জোটের নেতারা মনে করেন এতে তাদের ভোটের ময়দানে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ বিএনপি শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার মতো শক্তি ও সামর্থ্য এখন রাখে না। খালেদা জিয়া দণ্ডিত হলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলবেন। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার বৃহস্পতি যখন তুঙ্গে, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার শনির রাহু ততটাই গভীর ও আগ্রাসী। পর্যবেক্ষকদের মতে, একুশের গ্রেনেড হামলা খালেদা জিয়া ও বিএনপির রাজনীতিকে যেমন অভিশপ্ত করেছিল, তেমনি ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া রাজনীতিতে নিঃস্ব করেছে। রাজনীতির গতিপথে শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় দাবার চাল ছিল, ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে বের করে আনা। সেখানে আদালতের আইনি লড়াই তাকে বিজয়ী করেছে। ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে বসে পরিচালিত রাজনীতি, কূটচাল খালেদা জিয়ার জন্য ছিল সুখকর। শেখ হাসিনার জন্য ছিল অজানা, দুর্বোধ্য। গুলশান কার্যালয়ের রাজনীতি খালেদা জিয়ার জন্য অনিরাপদ, শেখ হাসিনার জন্য পরিষ্কার।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাজনীতিতে হামেশাই মানুষের মনের কথা স্পষ্ট করে বলার জন্য প্রশংসিত হন। ওয়ান-ইলেভেনের কারাদহন ভোগ করা ওবায়দুল কাদের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কারাগারে বসেই ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন। তার চরিত্রে সারল্যতাও রয়েছে। মানুষের মনের ভাষা পাঠ করতে জানেন, বলতে জানেন। রাজনীতিবিদই নন, একজন লেখকও তিনি। পড়াশোনাও রয়েছে, আছে সাহিত্যের রসবোধ। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে তার উৎসাহ ও সক্রিয় ভূমিকাও রয়েছে। আমার লেখার বিষয় এসব নয়। সোমবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু ও কিশোর পরিষদের ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সততার অভাব রয়েছে। সততার ঘাটতি পূরণ করতে হলে সৎ মানুষদের রাজনীতিতে নিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেছেন, ভালো মানুষেরা রাজনীতিতে আসলেই; রাজনীতি ভালো হয়ে যাবে। ভালো মানুষেরা রাজনীতি না করে দূরে সরে গেলে খারাপ লোকেরা রাজনীতির মঞ্চ দখল করবে, এমপি-মন্ত্রী হবে। তারা দেশ চালাবে কিন্তু তাতে দেশের ভালো হবে না। তিনি আরও বলেছেন, রাজনীতির ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমে গেছে। দেশের রাজনীতিকে আমরা জনগণের সামনে আকর্ষণীয় করে তুলতে চাই। রাজনীতিতে সৎ, যোগ্য ও মেধাবীদের টেনে আনতে চাই আমরা। রাজনীতিতে যখন ভালো মানুষ আসবে এবং এমপি-মন্ত্রী হবে, তখন রাজনীতি জনগণের কাছে আকর্ষণীয় হবে। তিনি শিক্ষার্থীদের ভালো ও সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ার অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বইটিও পড়তে বলেন।

ওবায়দুল কাদের যে কথা বলেছেন, এদেশের মানুষের হৃদয় নিঃসৃত, অন্তহীন আকুতির কথা বলেছেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক মনস্ক কর্মী, সমর্থক ও মানুষ উত্তম চিন্তা করেন। দুর্নীতিগ্রস্ত, মতলববাজ, সুবিধাবাদীরা সংখ্যালঘু হলেও দেশজুড়ে তাদের তত্পরতা, সিন্ডিকেট এতটাই শক্ত ও সবল যে সৎ, আদর্শবান রাজনৈতিক কর্মী ও মানুষের পক্ষে তা ভেঙে উঠে আসা কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অসৎ, মতলববাজ, তদবিরবাজ, সন্ত্রাসী, আদর্শহীন শক্তিটি রাজনৈতিক ক্ষমতার ছায়ায়ই বাস করে না; অর্থনৈতিক খাতটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাজনৈতিক ক্ষমতার বাহন চড়ে তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটই গড়ে তোলেনি, বিত্তবৈভবেরও মালিক হয়ে গেছে। প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মন্ত্রী-এমপি ঘিরে তারা সব রাজনৈতিক ও নির্বাচনী কর্মযজ্ঞেই দুই হাতে যেমন খরচ করে; তেমনি ওই শক্তিসমূহ তাদের ওপরই নির্ভর করে। রাজনীতিকে বাণিজ্যিকীকরণের মধ্য দিয়ে বিনিয়োগ ও মুনাফা লাভের এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক বা প্রক্রিয়া তারা গড়ে তুলেছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অভিষিক্ত হয়েই নয়, তার আগে থেকেও ওবায়দুল কাদের অসৎ, সুবিধাবাদী, হাইব্রিড, গণবিরোধী রাজনীতির খলনায়কদের হটাতে বলে আসছেন। কিন্তু প্রশ্ন, তিনি কি তা পারছেন বা উদ্যোগ নিতে পেরেছেন? ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উত্খাত করা হলে দেখা গেছে বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে কোথাও অর্থবিত্তের চিহ্ন নেই। মন্ত্রী, এমপি-নেতাদের জীবনে কারা নির্যাতন, হুলিয়া নেমে এলেও ঘরে খাবার নেই। পরিবারের চলার মতো টাকা-পয়সা নেই। ওয়ান-ইলেভেনে দেশের ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের ওপর অন্যায় দমন নির্যাতন হলেও দেখা গেছে, অনেকে বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডের গাড়ি রাস্তায় ফেলে পালিয়েছেন।

শেখ হাসিনার সরকার উন্নয়নের মহাসড়কে উঠলেও শেয়ার কেলেঙ্কারির খলনায়করা শাস্তি ভোগ করেনি। ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়ে গেলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর্থিক খাতে না ঘটেছে সংস্কার, না ফিরেছে শৃঙ্খলা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়ে গেলে বিবেকের তাড়নায় আপাদমস্তক সৎ, ভদ্রলোক গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করে চলে গেলেও জড়িতদের কারও বিরুদ্ধে শাস্তি হয়নি। তদবিরবাজ, টেন্ডারবাজদের দৌরাত্ম্য রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। গরিবের কল্যাণে রাজনীতিতে আসা নেতা-মন্ত্রী, এমপিরা ব্যক্তিগতভাবে কে কতটা বিত্তশালী হয়েছেন? কারা মানুষের কল্যাণের পথ পরিহার করে বিত্তশালীদের তদবির করেন? ভোগ বিলাসের জীবনযাপনের সংস্কৃতিতে ডুবে গেছেন কারা? দেশের মানুষ তা জানে। আমাদের রাজনীতির গৌরবময় উত্তরাধিকারিত্ব কে কতটা বহন করছেন বুকে হাত দিয়ে সবাই বলতে পারবেন না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মহাকাব্যের যুগ অতীত হইয়া গিয়াছে। ’

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস লেখা হয়েছে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও কৃষকের বন্ধু শেরে বাংলা ফজলুল হকের নামে। তাদের রাজনীতি করে আসা একালের নেতা-মন্ত্রীরা কতটা তাদের সহজ সরল, সাদামাঠা, নিরাবরণ জীবনযাপন করেন? তাদের রাজনীতির ও ব্যক্তিজীবনের সব দিক খোলা বইয়ের মতো মানুষের সামনে উন্মুক্ত ছিল। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা হৃদয়ে কতটা রক্তক্ষরণ নিয়ে, বেদনার সঙ্গে বলেন, ‘আওয়ামী লীগারদের কেনা যায়, শেখ হাসিনাকে কেনা যায় না। ’ বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়ে আসা মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের অসংখ্য মন্ত্রী, এমপি, নেতা আজকে যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত তা গরিবের দল আওয়ামী লীগের চরিত্রকে ধারণ করে না। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এদেশের মানুষ মুগ্ধ হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, মন্ত্রী, এমপি অনুসরণ করেন না। চিন্তা, চেতনা ও হৃদয় দিয়ে পাঠ করেন না। অনেক মন্ত্রী তাদের পরিবার পরিজনকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করছেন। এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। অনেক সিনিয়র সৎ মন্ত্রী ভাই, ভাতিজা ও আত্মীয় পরিজনকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বসিয়ে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের যখন বিপর্যয় আসে, এদের তখন খুঁজেও পাওয়া যায় না। আদর্শিক কর্মীরাই দুঃসময়েরই মুখোমুখি হয়ে থাই পাহাড়ের মতো ভারী বোঝা কাঁধে নিয়ে টানে।

ইতিহাসের পরতে পরতে সবচেয়ে অগ্নিপরীক্ষা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাই দিয়েছে। আওয়ামী লীগের আদর্শিক লাখো নেতা-কর্মী দলের কাঠামোতে ঠাঁই পাচ্ছে না। নেতৃত্বে উঠে আসতে পারছে না। সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হলেও দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রভাবশালী মন্ত্রী নেতাদের কাছে তারা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাদের টাকা, হোন্ডা, গুণ্ডা হাতে নেই বলে তাদের কাছে টানা হয় না। দলের মাঠের নেতৃত্বে তাদের ঠাঁই হয় না। আওয়ামী লীগের আগামী জাতীয় নির্বাচনে ক্লিন ইমেজের একশ ভালো মানুষ দলের অভ্যন্তর থেকে কী খুঁজে আনা সম্ভব? দলের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে ক্ষমতার ছায়ায় থেকে রাতারাতি যারা বিত্তবৈভব গড়েছে, বিদেশে সম্পদ গড়েছে, টাকা পাচার করেছে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে মাঠের নেতৃত্ব থেকে কী দূরে সরানো সম্ভব? ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো দুই যুগ ধরে বন্ধ করে আদর্শিক তরুণ রাজনৈতিক কর্মী তৈরির প্রক্রিয়া রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনের দুয়ার কী খুলে দেওয়া সম্ভব? একজন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম মানুষের সামনে সৎ, সাহসী ইমেজ তৈরি করতে পেরেছেন জীবনে সুযোগ পেয়েছেন বলে। এই দলে অসংখ্য নারী ও পুরুষ কর্মী রয়েছেন যারা আদর্শবান, মুজিব অন্তপ্রাণ, শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কিন্তু তাদের মন্ত্রীদের দুয়ারে দুয়ারে, সরকারি কর্মকর্তাদের বারান্দায় দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে তদবির বাণিজ্য করতে দেখা যায় না। জীবন ও জীবিকার জন্য, পরিবার ও পরিজনের জন্য সৎ জীবনযাপন করে তাদের টিকে থাকতে হয়। তাদের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক দক্ষতা আছে। সমাজে ক্লিন ইমেজ আছে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন ছাত্রলীগের সভাপতি তখন যারা বিভিন্ন জেলা, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও নগরে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা এখন বাংলাদেশে অভিভাবকের পর্যায়ে রয়েছেন। তাদের একটি তালিকা করলেই আদর্শিক কর্মীদের চিত্র চোখের সামনে ভেসে আসবে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক যে বক্তব্য দিয়েছেন, হৃদয় দিয়ে তা বিশ্বাস করলে সেসব নেতা-কর্মীকে তৃণমূল থেকে তুলে এনে মাঠের নেতৃত্বে বসানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেন। সৃজনশীল, মেধাবী, আদর্শিক নারী-পুরুষের সমন্বয়ে দলকে সাজাতে পারলে আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রাজনৈতিক দল হিসেবেই নয়; এদেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের নেতৃত্বের মহিমায় একটি আদর্শিক, গণমুখী রাজনৈতিক দলের মডেল হতে পারে। আর তা না করা গেলে আজকের ক্ষমতাচ্যুত বিএনপিকে আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য যে উপহাস, বিদ্রূপ করা হচ্ছে- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা দুজনের নেতৃত্বে দুই দফা গণতন্ত্রের সংগ্রামে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটলেও এ কথা কি বলা যায় যে, দেশে এখন গণতন্ত্রের বসন্ত বইছে? একথা কি বলা যায়, উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ব্যাপক হারে থাকলেও সুশাসন নিশ্চিত হয়েছে?
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর