বাংলার দিঘি বাংলার জল

প্রাচীন ত্রিপুরার মহারাজা ধর্মমাণিক্য ধর্মসাগর দিঘি খনন করেন। দেশের প্রাচীন এই দিঘির আয়তন প্রায় ৯.৩৮১ হেক্টর। স্বচ্ছ চকচকে পরিস্কার পানির এই দিঘির চারপাশ পাকা করা। দিঘির জলে ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর সূর্যের আলো নেচে বেড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ছোট ছোট প্রদীপ ভাসছে। দিঘিটি যে কারও নজর কাড়বে। শুরুতে দিঘির মাঝখানে একটি মাটির ঢিবি ছিল। যদিও এর কারণ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। দিঘির পূর্ব পাড়ে কুমিল্লা স্টেডিয়াম। উত্তরে রয়েছে কুমিল্লা পৌরপার্ক। পার্কের বিভিন্ন জায়গায় সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বসার জায়গা। ফলে পর্যটকেরা চাইলে সেখানে বসে বিশ্রাম করতে পারবেন। এ ছাড়া যে কেউ চাইলে দিঘিতে রাখা নৌকায় ঘুরে বেড়াতে পারবেন। এ জন্য ঘণ্টাপ্রতি গুণতে হবে প্রায় একশ টাকা। দিঘির স্বচ্ছ পানিতে ভেসে ভেসে পার্কের সৌন্দর্য উপভোগ করতে মন্দ লাগবে না। শীতকালে এই দিঘির চারপাশে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটে।
যাবেন যেভাবে : ধর্মসাগর দিঘির অবস্থান কুমিল্লা জেলা শহরে। ঢাকা থেকে বাসে কিংবা ট্রেনে কুমিল্লা যাওয়া যায়। কুমিল্লা বাস টার্মিনাল থেকে দিঘিতে যেতে সময় লাগে প্রায় ১৫ মিনিট। ভালো কথা, কুমিল্লা গিয়ে খদ্দরের কাপড় না কিনলে পরে পস্তাতে হবে। আপনার সে আশাও  মিটবে এই ধর্মসাগর দিঘির পাড়েই। কারণ সেখানে কয়েকটি দোকান রয়েছে।

 

গঙ্গাসাগর দিঘি

কয়েকশ বছর আগের ঘটনা। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ঈশ্বরচন্দ্র মানিক বাহাদুর কুমিল্লায় কর আদায় করতে আসতেন। তখন এ অঞ্চলে এবং এর আশপাশে পানির সুব্যবস্থা ছিল না। এলাকায় পানির অভাব দেখে রাজা চিন্তিত হন। তখন তিনি দিঘি খনন করার কথা ভাবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। খনন করা হলো বিশাল দিঘি। শুধু টলটলে পানির দিঘি নয়, এর উত্তর পাশে রাজা একটি সান বাঁধানো ঘাটও তৈরি করে দিলেন। এর নাম রাখা হলো ‘গঙ্গাসাগরের ঘাট’। রাজা সময় পেলেই ঘাটে এসে বসতেন। শীতল হাওয়া রাজার বিক্ষিপ্ত মনকে শ্রান্ত করত। রাজা দিঘির নাম রাখলেন দেবী গঙ্গার নামানুসারে। দিঘির পাশে রাজা কর আদায়ের জন্য তফসিল কাচারি তৈরি করেছিলেন। যদিও এখন সেই কাচারিঘর নেই। এক সময় এই দিঘির পাশেই ছিল ত্রিপুরা ব্যাংক। এখন সেটিও নেই।
গঙ্গাসাগর দিঘি সর্বমোট ১৮ ধুন জায়গা নিয়ে বিস্তৃত। হিসাব মতে ৩০ শতাংশে এক কানি। ১৬ কানিতে ১ ধুন। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গঙ্গাসাগর দিঘি এখনও রয়েছে আপন মহিমায়। দিঘির পাশেই শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তাফা কামালের সমাধি। ফলে দিঘির স্বচ্ছ টলমলে পানি দেখার পাশাপাশি বীরশ্রেষ্ঠের মাজার ভ্রমণও ইতিহাসপিপাসুদের আগ্রহী করবে।

পাঠককে এই অবসরে জানিয়ে রাখি, রাজধানী ঢাকায়ও এই নামে একটি দিঘি রয়েছে। হ্যাঁ, চমকে ওঠার মতোই ব্যাপার বটে! যেখানে খাল-বিল-জলাশয় নেই, পুকুরগুলোও মৃতপ্রায়, সবেধন নীলমণি বুড়িগঙ্গা টিকে আছে কোনোমতে, সেখানে আস্ত একটা দিঘি! রাজধানীর এই দিঘির অবস্থান সবুজবাগ থানাধীন পশ্চিম রাজারবাগ এলাকায়। দিল্লির সম্রাট আকবর প্রধান সেনাপতি মানসিংকে ষোড়শ শতকের শেষ দিকে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন। তখন এ অঞ্চলে বারো ভূঁইয়াদের রাজত্ব। তাদের শায়েস্তা করতেই তাকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি এ দিঘি খনন করেন।

যাবেন যেভাবে : কমলাপুর থেকে ট্রেনে আসতে হবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া। সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘণ্টা। রেলস্টেশন থেকে দিঘি ১৫ মিনিটের পথ। অটোরিকশা বা রিকশা দিয়ে যাওয়া যাবে। পাঠককে জানিয়ে রাখি ঢাকা থেকে বাসে গেলে চলতি পথেই বাসের জানালা দিয়ে আশুগঞ্জ সার কারখানা দেখতে পাবেন।
দুর্গাসাগর দিঘি

রানী দুর্গাবতী ছিলেন রাজা শিব নারায়ণের স্ত্রী। রাজার মৃত্যুর পর রানী নিজেই রাজ্য পরিচালনার ভার নেন। প্রজাহিতৈষী হিসেবে রাজমাতা দুর্গাবতীর পরিচিতি ছিল। প্রজাদের সুবিধার্থে ১৮৭০ সালে তিনি রাজকোষ থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয় করে  একটি দিঘি খনন করেন। তার নামানুসারে দিঘির নামকরণ করা হয়। জনশ্রুতি আছে, পেছন ফিরে না তাকানোর প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী রাজমাতা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যতদূর হেঁটে যেতে পারবেন ততদূর পর্যন্ত তিনি দিঘি খনন করার ঘোষণা দেন। ৬১ কানি জমি অতিক্রম করার পর ঘোড়ার ডাকের শব্দে, আবার অনেকে বলেন রাজ কর্মচারীদের ঢাক বাজানোর শব্দে রানী দুর্গাবতী পেছন ফিরে তাকান। পরবর্তীতে সেই স্থানজুড়ে তিনি দিঘি খনন করেন।
সরকারী হিসাব অনুযায়ী দীঘিটি ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমিতে অবস্থিত। কালের বিবর্তন ধারায় দিঘিটি এখনও টিকে আছে। শীত মৌসুমে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এখানে নানা প্রজাতির পাখি আসে। তারা সাঁতার কাটে দিঘির স্বচ্ছ, স্ফটিক পানিতে।১৯৭৪ সালে দিঘিটি সংস্কার করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী দিঘির মাঝামাঝি অবকাশ যাপন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য  মাটির ঢিবি তৈরি করা হয়। দিঘির চারপাশে নারিকেল, সুপারি, শিশু, মেহগনি প্রভৃতি বৃক্ষরোপণ করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়। দিঘির চার পাশে চারটি সুদৃশ্য বাঁধানো ঘাট থাকলেও পূর্ব-দক্ষিণ  পাশের ঘাট দুটির অস্তিত্ব  বিলীন হয়ে গেছে। পশ্চিম পাড়ে ঘাটসংলগ্ন স্থানে রয়েছে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো। ইচ্ছা করলে ভ্রমণপিপাসুরা সেখানে রাত কাটাতে পারবেন।

অভয়ারণ্য হিসেবে দিঘির পাশে গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ পার্ক। দিঘির পাশ দিয়ে বনবিভাগের তদারকিতে গড়ে তোলা হয়েছে বৃক্ষের বাগান। দুর্গাসাগর দিঘিতে প্রতি বছর চৈত্র মাসে পূণ্যের উদ্দেশে জড়ো হন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। চৈত্র তিথিতে হয় স্নান উৎসব।

যাবেন যেভাবে : ঢাকা থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পরপর বরিশালের উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়। সময় লাগে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। আপনি চাইলে সদরঘাট থেকে লঞ্চেও যেতে পারেন। বরিশাল জেলা শহর থেকে মাত্র ১২ কি.মি. দূরে মধাবপাশা ইউনিয়ন। এখানেই দূর্গাসাগর দিঘির অবস্থান।

 

কমলা রানীর সাগরদিঘি

পল্লীকবি জসিমউদদীন এই দিঘি দেখতে এসে পাড়ে বসে লিখেছিলেন :
‘কমলা রানীর দীঘি ছিল এইখানে, ছোট ঢেউগুলি গলাগলি ধরি ছুটিত তাদের পানে।
আধেক কলসী জলেতে ডুবায়ে পল্লী বধূর দল, কমলা রানীর কাহিনী স্মরিতে আঁখি হত ছল ছল।’
রাজা পদ্মনাথের আমলে আনুমানিক ষোলোশ খ্রিস্টাব্দে ১৭৫ একর জায়গা নিয়ে এই দিঘি খনন করা হয়। কবির কাব্যের মতোই এই দিঘি নিয়ে নানা লোককথা শোনা যায়। যেমন কেউ বলেন, রাজা পদ্মনাথ সিংহের স্ত্রী ছিলেন কমলাবতী। তিনি রূপবতী এবং গুণবতী। রাজপুত্রের জন্মের পর হঠাৎ রাজ্যে দেখা দেয় পানির অভাব। রাজা পদ্মনাথ প্রজার দুর্দশা লাঘবে দিঘি খননের আদেশ দেন। কিন্তু দিঘি খনন শেষে দেখা গেল পানি উঠছে না। এতে রাজা চিন্তিত হন। প্রজারা ধরে নেয় রাজপুত্রের জন্মের সঙ্গে নিশ্চয়ই দিঘির পানি না ওঠার সম্পর্ক আছে। এর মধ্যে রাজা পুনরায় স্বপ্ন দেখেন দিঘিতে কমলাবতী আত্মদান করলেই পানি উঠবে।

রাজা এ স্বপ্ন না মানলেও রানী কমলাবতী পুত্র ও প্রজাদের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেন তিনি আত্মহুতি দেবেন। সে মোতাবেক সত্যি সত্যি একদিন তিনি দিঘিতে নামেন। সবাইকে অবাক করে তখন দেখা যায় রানী যত সামনে অগ্রসর হন দিঘির পানি ততো বাড়ে। এভাবে ধীরে ধীরে এক সময় রানী পানির নিচে তলিয়ে যান। শোনা যায়, সেই থেকে সাগরদিঘি কখনও আর শুকায়নি। এ ঘটনার পর সাগরদিঘির আরেক নাম হয় ‘কমলারানীর দিঘি’।

লোকের মুখে মুখে এ ধরনের গল্প উচ্চারিত হয়ে আসছে যুগে যুগে। বিশাল এ দিঘি দেখলে সাগরের মতো মনে হয়। তাই এটি ‘কমলারানীর সাগরদিঘি’ নামেও পরিচিত। লম্বালম্বি এই দিঘির এপাড় থেকে ওপাড়ের লোকজন দেখা দুষ্কর। দিঘির চারপাশে সারিবদ্ধ গাছ দিঘির রূপ যেন আরো মোহনীয় করে তুলেছে।

যাবেন যেভাবে : হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে এই দিঘির অবস্থান। হবিগঞ্জ শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ১৬ কি.মি.। ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে সরাসরি হবিগঞ্জ যাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। আরেকটি তথ্য, এই বানিয়াচং কিন্তু আমাদের দেশেরই শুধু নয়, এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম। সুতরাং সেখানে গেলে পুরো গ্রামটি ঘুরে দেখতে ভুলবেন না।
নীলসাগর দিঘি

বহু আগে এর নাম ছিল ‘বিরাট দিঘি’ বা ‘বিরনা দিঘি’। সেখান থেকে নামটি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে ‘বিন্না দিঘি’। এই নামের পেছনেও রয়েছে ইতিহাস। ঐতিহাসিকদের মতে, বিরাট নামক এক রাজা এই দিঘি খনন করেছিলেন। যারা ‘মহাভারত’ পড়েছেন তারা এই রাজার নাম শুনে থাকবেন। পঞ্চপান্ডব কৌরবদের চক্রান্তের শিকার হয়ে ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হয়। পান্ডবরা তখন অজ্ঞাতবাসের জন্য বিরাট রাজার রাজ্যে এই স্থানটিতে ছদ্মবেশে বাস করতে থাকে। পান্ডবদের তৃষ্ণা মেটাতেই রাজা বিরাট এই দিঘি খনন করেন।
আবার অনেকে বলেন,  রাজা বিরাটের সময় রাজ্যে অসংখ্য গরুর আস্তানা ছিল। গরুগুলোকে পানি খাওয়ানোর জন্য অষ্টম শতাব্দীতে তিনি এই দিঘি খনন করেন। স্বাধীনতার পর এ দিঘির নামকরণ করা হয় ‘নীলসাগর’।নীলসাগর দিঘিতে প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে সনাতন সম্প্রদায় বারুণী স্নান উৎসবের আয়োজন করে। এ ছাড়া পর্যটকদের সুবিধার্থে দিঘির পাশেই সরকারের অনুদানে নির্মিত একটি রেস্টহাউস এবং ছোট একটি পার্ক রয়েছে।

যাবেন যেভাবে : নীলফামারী জেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নে নীলসাগর দিঘির অবস্থান। ঢাকা থেকে ট্রেন এবং বাসযোগে নীলফামারী যাওয়া যায়। নীলফামারী থেকে গোড়গ্রামের দূরত্ব ১৪ কি.মি.। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই মূলত নীলসাগর বিখ্যাত।
রামসাগর

নামে সাগর হলেও এটি আসলে একটি দিঘি। দেশের অন্যান্য আর সব দিঘির মতোই এটিও তৈরি করেছিলেন রাজন্য বর্গের মানুষেরা। রাজা রামনাথ এই দিঘি খনন করেন প্রজাদের সেচ সুবিধা ও পানির সমস্যা দূরীকরণের জন্য। এই দিঘি এত বড় যে, পায়ে হেঁটে দিঘির চারপাশে একবার ঘুরে আসা প্রায় অসম্ভব। যে কারণে দিঘির পাশ ঘেঁষে ইটের রাস্তা রয়েছে। দিঘির চারপাশে হাজার ধরনের গাছ রয়েছে। নাম না জানা পাখির কলরব আপনাকে মুগ্ধ করবে। আপনি চাইলে দিঘির পাড়ে বসে একটু জিড়িয়ে নিতে পারেন। দিঘির জল ছুঁয়ে আসা শীতল হাওয়া আপনার মন জুড়িয়ে দেবে।
ইতিহাস বলছে, দিঘিটি খনন করতে তৎকালীন প্রায় ৩০ হাজার টাকা এবং ১৫ হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন হয়েছিল। এর চারদিকে সবুজ প্রান্তর। পাড়ভূমিসহ দিঘির মোট আয়তন ৪,৩৭,৪৯২ বর্গমিটার। জলভাগের দৈর্ঘ্য ১০৩১ মিটার, প্রস্থ ৩৬৪মিটার। গভীরতা গড়ে প্রায় ৯ মিটার। দিনাজপুর এমনিতেই দর্শণীয় স্থান। সেখানে কান্তজির মন্দির রয়েছে। সুতরাং দিনাজপুর গেলে একসঙ্গে অনেক কিছুই দেখা হয়ে যাবে। ভালো কথা, লিচুর সময় অর্থাৎ জৈষ্ঠ্য মাসে গেলে দিনাজপুরের লিচুর স্বাদও নিতে পারবেন।

যাবেন যেভাবে : দিনাজপুর শহরের কেন্দ্র থেকে ৮ কি.মি.  দক্ষিণে আউলিয়াপুর ইউনিয়নে এই দিঘির অবস্থান। ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাস এবং ট্রেনে দু’ভাবেই যাওয়া যায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর