নন্দিত এক ‘নগর’

নগর না গ্রাম ঠাওরানো কঠিন। মনে হলো, গ্রামটি দুই পায়ে হাঁটছে—চীনা ভাষায় যাকে বলে ওয়াকিং অন টু লেগস।
গ্রামে পা রাখতেই পুরোদস্তুর নগরীর ঠাটবাট যেমন চোখে পড়ল, তেমনি সনাতন গ্রামের আবহ টের পেতে কষ্ট হয় না। এমন একটি গ্রাম মানিকনগর নিয়ে আমাদের বর্তমান নিবন্ধের অবতারণা। অভীষ্ট গ্রাম ঢাকা থেকে ১৮৪ কিমি পশ্চিমে ঐতিহাসিক মুজিবনগর থেকে এক কিমি উত্তরে। অন্য এক কারণে কথিত গ্রামটি বিশেষ নজর কাড়ে—এটি মুজিবনগরের সন্নিকটে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এক গ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা এখানে এসে ক্যাম্প বসালে ভীতসন্ত্রস্ত সব মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। পুরো ৯ মাস এই গ্রাম ছিল মানুষশূন্য—খানসেনাদের পদভারে প্রকম্পিত। তারপর একদিন কালরাত শেষে সূর্য উঠে এবং পালিয়ে যাওয়া সব মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করে। তারা এবার নতুনভাবে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের যুদ্ধে, তবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও অশিক্ষা-কুশিক্ষার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। বস্তুত দীর্ঘ চার দশক শেষে বিবর্তনের ধারায় বর্তমান অবস্থা জানার জন্যই আমাদের মানিকনগর যাওয়া।

দুই.

ফোর হুইলার জিপটি মেহেরপুর সদর থেকে এই গ্রামের আদি অধিবাসী দোয়াজউদ্দিন মাস্টারের (৭০) বাড়ির গেটে গিয়ে থামে। প্রশস্ত পাকা রাস্তার পাশে ছিমছাম একটা বাড়ি। অপেক্ষমাণ দোয়াজ মাস্টার একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন বৈদ্যনাথতলা (এখন মুজিবনগর) সংগ্রাম কমিটির সভাপতি। সুদূর পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়ায় কৃষি খামারের প্রশিক্ষক হিসেবে দুই বছর কাজ করেছেন। দুই বিঘা জমি নিয়ে তাঁর বাড়ির সামনে দোতলা দালান ভাড়া দিয়েছেন আর নিজে থাকেন ঠিক পেছনে একতলা দালানে। বসতভিটায় আম, কাঁঠাল, লিচুসমেত ফলমূলের বাগান। রাস্তার অপর পাশে আছে একসময় বাংলাদেশের প্রথম গ্রামীণ দারিদ্র্য অধ্যয়ন প্রকল্পের জন্য ভাড়া নেওয়া বাড়িটা—এখন অন্য অফিসের জন্য ব্যবহার হয়। রেহমান সোবহান, হোসেন জিল্লুর ও মাহবুব হোসেন পরিদর্শন করেছেন এই গ্রাম—বললেন, দোয়াজ মাস্টার।

তিন.

কুশল বিনিময় শেষে প্রথমেই গ্রামের নামকরণ নিয়ে কথা ওঠে। অবিভক্ত নদীয়া জেলার (১৯৪৭) মেহেরপুর মহকুমার বাগোয়ান ইউনিয়নের অন্তর্গত মেহেরপুর-মুজিবনগর প্রধান সড়কের উভয় পাশে অবস্থিত গ্রাম। সরস্বতী খালটি গ্রামটির ঠিক পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম দিকে বেষ্টন করে আছে। মাঝখান দিয়ে প্রশস্ত পাকা প্রধান সড়ক। বিরলভাবে গ্রামের ভেতর দিয়ে হেরিং বোন রাস্তার মাধ্যমে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে। সরস্বতী খালটি পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার জলঙ্গী নদীর সঙ্গে যুক্ত এবং একসময় সারা বছর নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা ছিল। জনশ্রুতি আছে যে ‘মানিক’ নামে এক ব্যক্তি নৌকাযোগে এই অঞ্চলে বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি বেচাকেনা করতে আসতেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে তিন দিনব্যাপী এখানে একটা বিরাট হাট বসত এবং সেই হাটে সরস্বতী খালে নৌকাযোগে নিত্যব্যবহার্য বহু মালামাল আনা-নেওয়া হতো। কালক্রমে বর্তমানের মানিকনগরে জনবসতি গড়া শুরু হয় এবং মানিকের নামানুসারে গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘মানিকনগর’। ভারত বিভাগের পর ওই বৈদ্যনাথতলার হাট ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে মানিকনগর গ্রামের উত্তরে ওই হাট এক দিনের জন্য বসা শুরু হয়। বর্তমানে প্রধান সড়কের উভয় পাশে বিরাট বাজার গড়ে উঠেছে। এই বাজার ও হাটকেন্দ্রে মানিকনগর গ্রামের বহু লোক জড়িত, বাজারের পাশেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

আলোচনার এক ফাঁকে দোয়াজ মাস্টার গ্রামের ভেতর নিয়ে গেলেন। কখনো গাড়িতে বসে, কখনো পায়ে হেঁটে গ্রাম দেখছি। বুঝতে পারলাম যে অন্তত খানার সংখ্যার দিক থেকে মানিকনগর একটা বড় গ্রাম। শুমারি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মোট খানার সংখ্যা ৪৫৯, খানাপ্রতি সদস্য মাত্র চার, যা বাংলাদেশের গড়ের চেয়ে কম। অথচ ১৯৮৮ সালে এই গ্রামে খানার আকার ছিল প্রায় সাত। খানা সদস্যদের শ্রেণীকরণ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো— বাসরত সদস্যদের বড় একটা অংশ (প্রায় ৩৭ শতাংশ) সন্তান-সন্ততি এক-চতুর্থাংশ খানা প্রধান ও প্রায় সমানুপাতে স্বামী-স্ত্রী। অন্য আত্মীয়স্বজন মিলে খানার মোট সদস্যের ১৬ শতাংশ। মানিকনগর গ্রামের যত পরিবার আছে তার দুই-তৃতীয়াংশ নিউক্লিয়ার পরিবার এবং এক-তৃতীয়াংশ যৌথ বা বিস্তৃত পরিবার। দুই দশক আগের চিত্র ছিল ঠিক বিপরীত। সময় বদলায় আর সবাই আলাদা থাকার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। আধুনিকতার অনুপ্রবেশ চিরায়ত যৌথ পরিবার ভেঙে দেয়—শুধু এই দেশ নয়, সর্বত্র। শোনা কথা, সময়ের বিবর্তনে যৌথ পরিবার ভাঙছে এবং একক পরিবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। খানার আকার হ্রাস পাচ্ছে মূলত জন্মহার পড়ন্ত বলে। পরিবারগুলোয় প্রজনন হার দেখার জন্য শিশু অনুপাতের দিকে থাকতে হয়, যার নিমিত্তে বলা যায় শিশু-মহিলা অনুপাত প্রায় ২৭, ১৯৮৮ সালের ৭৫-এর বিপরীতে। তা ছাড়া ০-১৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর অনুপাত প্রায় ২৯ শতাংশ, বিশেষত পাঁচ বছরের নিচে শিশুর অনুপাত প্রায় ১০ শতাংশ, যা ১৯৮৮ সালে ছিল এর দ্বিগুণ। মোটকথা ১০ বছর বয়স পর্যন্ত জনগোষ্ঠী প্রায় এক-পঞ্চমাংশ; মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৬ থেকে ৬০ বছর)। ওর্যাল হিস্ট্রি থেকে জানা যায়, সময়ের বিবর্তনে শিশু ও কিশোর বয়সীদের অনুপাত হ্রাস পাচ্ছে ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা পুরো দেশের জনমিতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন মাত্র।

একসময় এই গ্রামের মহিলারা খুব দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করত; কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ছোটখাটো ফ্যাক্টরিতে অথবা এনজিও ও মুজিবনগর উপজেলা অফিসে বিভিন্ন প্রকার কাজ করায় কোনো মহিলা বেকার আছে বলে শোনা যায় না। আর তাই বোধ হয় মোট কর্মজীবীর মধ্যে মহিলাদের হিসসা গড়পড়তা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এর ফলে মহিলাদের ক্ষমতায়ন বেড়েছে, বেড়েছে শিশুদের শিক্ষার হার, স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদি। তবে হারানোর বেদনাও কিছুটা আছে। হাডুডু খেলায় সাবেক কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল যেই গ্রাম, সেই গ্রামে এখন হাডুডু খেলা আর হয় না। ঐতিহ্যগত সামাজিক বন্ধন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

চার.

সব মিলিয়ে মানিকনগর মনো হলো নন্দিত এক নগর, যে নগরের উপাখ্যান তুলে ধরা হলো। শহরের সব সুবিধা এখানে আছে, তবে নেই পরিবেশদূষণ আর যানজট। নেই সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি সব দিক থেকেই অপেক্ষাকৃত এগিয়ে রয়েছে গ্রামটি। একসময়ের অশিক্ষা থেকে এখন সাক্ষরতার হার প্রায় ৮০ শতাংশ। ফসল বিন্যাসে এসেছে বৈচিত্র্য। অবকাঠামোগত দিক থেকে বাংলাদেশের তুলনামূলক একটা উন্নত গ্রাম। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে প্রচুর বিস্তৃত কিন্তু বাহন হিসেবে আধুনিক যান আছে কিন্তু নৌকা নেই। মানিকনগর কয়েক দশক আগের গ্রাম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন—এই গ্রাম সেই গ্রাম নেই। গ্রামটি দুই পায়ে হাঁটছে—চীনা ভাষায় যাকে বলে ওয়াকিং অন টু লেগস। একদিকে রয়েছে শহুরে সেবা ও সংস্কৃতি, অন্যদিকে কৃষিনির্ভর জীবন-জীবিকা। খুব কম গ্রাম আছে, যেটা কৃষির ওপর এত নির্ভরশীল আবার শহরের মতো সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন। শুধু ধানকে ঘিরে নয়, দিন দিন বাড়ছে অন্য ফসলের চাষ, যেমন—গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, পাট ইত্যাদি। কয়েক দশক আগে ধান চাষ কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও ইদানীং ফসল বহুমুখীকরণের চিন্তা একটা আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে বটে। তবে ফসল বিন্যাস ঘটছে বাজারের ইঙ্গিতে এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বাড়ছে ফলন ও উৎপাদন।

পাঁচ.

কিন্তু সব ভালো যে কখনো কখনো ভালো হয় না। মাঝেমধ্যে আকাশে মেঘ জমে। বেশি উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষক পড়ে যায় বিপাকে। এটা অর্থনীতির তত্ত্বের কথা যে পণ্যের জোগান বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপও হতে পারে। যেমন—জোগান চাহিদার তুলনায় বেশি হলে পণ্যের দাম পড়ে যায়। তাই সরবরাহ বৃদ্ধি সুখবর নয়, যদি কৃষক তার ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। মানিকনগর গ্রামের কৃষক অনেকটা সেদিকেই ইঙ্গিত করে জানালেন, হিমাগারের অভাবে পেঁয়াজের মতো পচনশীল দ্রব্য ধরে রাখতে পারছেন না। বেশি উৎপাদন করেও কপাল পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। মানিকনগর গ্রামবাসী হয়তো জানে না যে এমনতরো পরিস্থিতি পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই।

যখন ভাবছি এই গল্প শেষ করব কী দিয়ে, তখন পত্রিকার ছোট একটা শিরোনাম বড় একটা ধাক্কা দিল। ছবি দেখে আর খবরটি পড়ে চোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো অবস্থা—রংপুরের সাতমাথায় হাইওয়ের ওপর কৃষক উৎপাদিত গোল আলু ছিটিয়ে পুরো রাস্তার যান চলাচল বন্ধ করে রেখেছে। দুঃখজনক এই সংবাদের আনন্দগত দিকটা হচ্ছে, কয়েক বছর আগে ফ্রান্সের কৃষকরা ঠিক এমনিভাবে প্রতিবাদ দেখিয়েছিল। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিবাদের কৌশলও দেশ থেকে দেশান্তরে যায়। যা হোক, পত্রিকায় ছাপা ছবিটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ—রাস্তায় ছিটানো গোল আলুর মধ্যে একজন কৃষক বসে আছেন; খুব উদ্বিগ্ন সেই কৃষকের ডান হাত মাথার ওপর আর বাঁ হাতে ধরা একটা পোস্টারে লেখা “৩০০ কেজি=একটা ‘লুঙ্গি’। কৃষক বাঁচবে কিভাবে?” (দি ডেইলি স্টার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। বলে নেওয়া প্রয়োজন যে এই অভিযোগ শুধু মানিকনগরে নয়—দিনাজপুর, জয়পুরহাটসহ সর্বত্র। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে না পেরে কৃষক ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এক বিঘা জমিতে গোল আলু উৎপাদন খরচ প্রায় ১৪ হাজার টাকা। যেখানে উৎপাদন খরচ ছয় টাকা, সেখানে গোল আলুর দাম কেজিপ্রতি মাত্র ১-১.৫ টাকা। আলুর ন্যায্য দাম না পেয়ে আলুথালু কৃষক মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছে; প্রায় তেমন একটা অবস্থা এখানকার পেঁয়াজ নিয়ে। হে গরিবের বন্ধু রাজনীতিবিদ! আপনি কি কৃষকের কান্না শুনতে পান? তার পরও জীবনসংগ্রাম থেমে নেই মানিকনগর কিংবা অন্য কোথাও।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর