রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বর্ণনা শুনেছে রাখাইন কমিশন

মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছে নির্যাতনের বর্ণনা শুনেছেন রাখাইন রাজ্যের সংকট নিরসনে মিয়ানমার সরকার গঠিত রাখাইন অ্যাডভাইজরি কমিশনের সদস্যরা। দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি এ কমিশনকে নিয়োগ দেন। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা বস্তিতে এসে পৌঁছান রোববার বেলা পৌনে ১২টার দিকে। কমিশনের সদস্যরা হলেন- মিয়ানমার নাগরিক উইন ম্রা ও আই লুইন এবং লেবাননের নাগরিক ঘাসান সালামে।

বালুখালী রোহিঙ্গা বস্তিতে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কমিশনের কাছে জানিয়েছেন মিয়ানমার সরকারের সামরিক জান্তার নির্যাতন সইতে না পেরে তারা এ দেশে পালিয়ে আসেন। ওখানকার সেনারা মানুষকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। মা-বোনকে ধরে নিয়ে গণধর্ষণ করে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা নতুন আসা রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন বিষয় খোঁজখবর নেন। প্রতিনিধি দলের টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা বস্তি পরিদর্শনেরও কথা রয়েছে। সেখানে অবস্থান করা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের কাহিনীও শুনবেন তারা। এরপর প্রতিনিধি দলের আজ কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পরে ঢাকায় গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করবে কমিশন।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল মঙ্গলবার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঢাকায় বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস (বিস) প্রাঙ্গণে সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের সমস্যা সম্পর্কে জানা এবং সমাধানের সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে রাখাইন কমিশন গঠন করেছেন। যৌথভাবে এ কমিশন গঠনে যুক্ত হয়েছে কফি আনান ফাউন্ডেশন। ৯ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশনের প্রধান জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। তবে কফি আনান এ সফরে ঢাকায় আসেননি।

চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাখাইন কমিশন তাদের প্রতিবেদন মিয়ানমার সরকারের কাছে পেশ করবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করে রাখাইন কমিশন স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন দেবে বলে জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি নিয়েও সুপারিশ পেশ করা রাখাইন কমিশনের আওতাভুক্ত। বাংলাদেশ সফরকালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সম্পর্কে তাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ চাইতে পারে কমিশন, এমন কথা থাকলেও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কমিশন সদস্যরা কী কথা বলছেন তা গণমাধ্যমকে জানানো হয়নি।

রোহিঙ্গারা পরম্পরায় রাখাইন রাজ্যে বসবাস করলেও এখন পর্যন্ত তারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পায়নি। সে কারণে তারা নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। সংকটের সমাধান তাই নাগরিকত্বের মধ্যেই নিহিত বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। নাগরিকত্বের মতো সমস্যার মূল বিষয় নিষ্পত্তি না করলে রোহিঙ্গারা উগ্রবাদের মতো বিপথগামী হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশেষ দূত (র‌্যাপোটিয়ার) ইয়াংহি লি। তিনি কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানবেন। ইয়াংহি লি এরই মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য সফর করেছেন। এরই মধ্যে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের ‘ফ্যাক্ট ফাউন্ডিং মিশন’ বাংলাদেশ সফর করে গেছে। এ মিশনের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনকে তাদের বক্তব্য দিতে হবে। এ ছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত নরডিক রাষ্ট্রদূতরা কক্সবাজার সফর করে বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেন্স ব্ল–ম বার্নিকাট।

গত বছরের ৯ অক্টোবর সীমান্ত চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলায় মিয়ানমারের নয়জন ‘বর্ডার গার্ড পুলিশ’ (বিজিপি) সদস্য নিহত হওয়ার জের ধরে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে। এ অভিযানে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৬ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা আগে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজার ও তার আশপাশে ঝুপড়ি ঘর তুলে অবৈধভাবে বাস করছেন। প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। কুতুপালং, বালুখালী, নয়াপাড়া রোহিঙ্গা বস্তি ছাড়াও এসব রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। নিয়ন্ত্রণহীন এসব রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আইনশৃংখলা বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনীও বেকায়দায় রয়েছে এসব রোহিঙ্গাদের কারণে এমন অভিযোগ বিভিন্ন মহলের।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর