বিএনপির তরুণরা কী করছে

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পাওয়া একজন নতুন সদস্য কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘এবারের কমিটিতে বেশিসংখ্যক তরুণ নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হিসেবে ম্যাডাম (খালেদা জিয়াকে এভাবেই সম্বোধন করেন তারা) বলেছেন যে, দলের সবকিছুই এখন তারেক রহমান দেখভাল করবেন। তাই তার সঙ্গে কাজ করতে পারে এমন নেতাদের উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এবারের কমিটিতে তরুণদের নেওয়া হয়েছে।’ জাতীয় কাউন্সিলের প্রায় সাড়ে চার মাসেরও বেশি সময় পর গেল বছরের ৬ আগস্ট বিএনপির এ কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে প্রবীণদের পাশাপাশি আশি ও নব্বই দশকের অনেক সাবেক ছাত্রদল নেতাসহ ব্যাপকসংখ্যক তরুণকে গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান দেওয়া হয়। ফলে তাদের ভাষায়, ‘তারুণ্যনির্ভর এই নতুন কমিটিকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে বিএনপি।’

বিএনপি গঠনের সময় থেকেই একটি কথা বলা হতো যে, তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাই সব কাজে প্রবীণদের পাশাপাশি তাদেরকে রাখতে হবে। সেই সময় থেকেই বিএনপির রাজনীতিতে তরুণদের প্রাধান্য দেখা যায়। মাঝখানে অবশ্য এ অবস্থা কিছুটা হোঁচট খায়। ’৯৩ সালের পর থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কাউন্সিল না হওয়ার কারণে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন হয়নি। অঙ্গ দলগুলোর একই অবস্থা ছিল। তাই সময়ের পরিক্রমায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তরুণদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি। তবে ২০০৯ সালে ৫ম জাতীয় কাউন্সিল থেকে বিএনপির নেতৃত্বে তরুণদের আবার নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অবশ্য এ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই সম্ভবত ২০০২ সালের আগস্টে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব নিয়োগ করা হয়। তখন তার বয়স ৪০-এরও নিচে। অবশ্য তার বাবা জিয়াউর রহমান যখন রাজনীতিতে নামেন, তখন তারও বয়স ৪০-এর কোটায়ই ছিল।

তারেক রহমান দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব নিয়েই প্রথমে যুবদলের বহুদিনের পুরনো নেতৃত্বে পরিবর্তন আনেন। যুবদলের দীর্ঘদিনের সভাপতি মির্জা আব্বাস ও সাধারণ সম্পাদক গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে সরিয়ে দিয়ে সেই দুটি পদে মনোনয়ন দেন

বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন বরকতউল্লাহ বুলু ও সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে। এভাবে তিনি বিএনপির জেলা কমিটিগুলোতেও প্রবীণদের সঙ্গে তরুণ নেতৃত্ব আনার চেষ্টা করেছিলেন। সব জায়গায় অবশ্য সফল হতে পারেননি সত্য, তবে দলে আজকে যে তরুণদের জয়গান গাওয়া হয় তা তারেক রহমানই আবার শুরু করেছিলেন।

তারেক রহমানের পর দলের দ্বিতীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব (গঠনতান্ত্রিকভাবে প্রথম) মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগমীরও বয়সে নবীন। তিনি এবারের কাউন্সিলে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবের দায়িত্ব পেলেন। গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপিতে যত মহাসচিব হয়েছেন, তাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল সবচেয়ে কম বয়সী তরুণ-যুবা। আর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন তরুণ বয়সের নেতা রাজশাহী বিশ্ববিবদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রুহুল কবির রিজভী। একই সঙ্গে যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসাংগঠনিক সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ পদেই তরুণ বয়সের নেতাদেরই অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। কমিটিতে স্থান পাওয়া আশি ও নব্বই দশকের সাবেক ছাত্রদলের তরুণ নেতাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাদেরকে বশ উচ্ছ্বসিত মনে হয়। তাদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, দীর্ঘদিন পর এবার দলে আশি ও নব্বই দশকের সাবেক ছাত্রদল নেতারা মূল্যায়িত হয়েছেন। তারা সবাই তরুণ।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতেও এবারে ছাত্রদলের সাবেক নেতা বয়সে তরুণ সালাহউদ্দিন আহমদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে থেকেই আছেন তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এই কমিটিতে নবীন-প্রবীণের যেমন সমন্বয় হয়েছে, তেমনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে নারী-তরুণীদেরও রাখা হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নেতৃত্ব বিকাশের লক্ষ্য হিসেবেই পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নারীদের জায়গা দিয়েছে বিএনপি। এটা অবশ্য ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল বলে উল্লেখ করেন তারা।

যেকোনো ধরনের সংগঠনে তরুণ নেতৃত্বের প্রয়োজন হয় কেন? তাহলে নেতৃত্ব কী সেই বিষয়টা আগে জানা থাকা চাই। নেতৃত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে অনেক তত্ত্ব ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান আলোচনায় সেই সব তত্ত্বের দিকে না গিয়ে নেতৃত্বের সার কথাটিই বলে দেই এবং তা হচ্ছে, ‘এটি এমন এক ধরনের প্রভাবের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি সমাজ বা গোষ্ঠী একটি লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিত হয়।’

বিশ্ব ইতিহাস এমনকি এই উপমহাদেশের ইতিহাসের দিকে যদি দৃষ্টি দেই তাহলে এটাই প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, ইতিহাসের মোড় ঘোরানো সব কাজ তরুণ নেতৃত্বের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এই যে, সমাজ বা সংগঠনে তরুণরাই চালকের ভূমিকা পালন করে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। এসব দৃষ্টিকোণ থেকেই মনে করা হয় যে, সংগঠন বা সমাজের গতিশীলতা পরিমাপ করা হয় সেই সংগঠন বা সমাজের নেতৃত্বে তরুণরা কেমন রয়েছে তা দেখে। অর্থাৎ প্রবীণদের সঙ্গে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তরুণরাই একদিন সমাজ বা সংগঠন পরিচালনা করবে। না হলে সমাজ বা সংগঠন উপযুক্ত-নেতৃেত্বর সমস্যায় পড়বে। এই জন্যই তরুণ নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। হালের মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস (১৯৫৫), অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা অকাল প্রয়াত স্টিভ জবস (১৯৫৫-২০১১), ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জোকার বার্গদের (১৯৮৪) বয়স তেমন বেশি নয়। অল্প বয়সেই তারা বিশ্বে আলোচনা ফেলে দিয়েছেন তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান দিয়ে। এ কারণেই প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিএনপিতে তরুণদের সমাগম দেখা যায়। পুরো এরশাদ আমলের ৯ বছরে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের ছাত্রসংসদে বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের মনোনীত প্যানেলই জয়লাভ করে। কিন্তু এরপরই বিএনপিতে ধস নামে তরুণ নেতৃত্বের।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ এ দিকটার প্রতি ইঙ্গিত করেই বলেছিলেন, দেশের তরুণ-তরুণী ও ছাত্রছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে বিএনপি তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। এ কারণেই কি না জানি না, দলটির এবারের কমিটিতে প্রবীণদের পাশাপাশি তরুণ-যুবা নেতৃত্বের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। এ নেতৃত্ব কি পারবে দলকে জয়মালা পরিয়ে দিতে? এমন জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির শীর্ষমহল দলের এসব তরুণ নেতাদের কতটুকু কাজে লাগাতে পারছে তার ওপরই নির্ভর করবে দলের বিজয়ের সোপান রচনায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর