তিন নেতার কারণে ভরাডুবি না’গঞ্জ বিএনপির অভিযোগ : প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা -ফখরুল

স্থানীয় তিন প্রভাবশালী নেতার অসহযোগিতার কারণে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) মেয়র নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতে, তিন নেতা দলীয় মেয়র প্রার্থীকে সহযোগিতা করেননি। ফলে তাদের কেন্দ্রেই ধানের শীষের প্রার্থী নৌকার কাছে পরাজিত হয়েছেন। নেতারা মেয়র বাদ দিয়ে ব্যস্ত ছিলেন ভাই ও সন্তানের কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে। ফলে ওই এলাকায় কাউন্সিলর প্রার্থীরা মেয়রের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। স্থানীয় নেতারা বলেন, নিজেদের স্বার্থেই তিন নেতার কেউ দলীয় মেয়র প্রার্থীর জন্য সময় ব্যয় করেননি। তারা চান না নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নতুন কোনো নেতা বেরিয়ে আসুক। তারা দলের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে বিএনপির প্রার্থী দ্বিগুণেরও বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছেন।

নাসিক নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ফলাফল নিয়ে কাজ চলছে। এ ধরনের ফলের জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা দায়ী কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দলের কোনো নেতা যদি পরাজয়ের কারণ হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেন, অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার নাসিক নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী নিজের ভাই ও যুবদল নেতা মাসুদুল আলম খন্দকারের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়েছেন। ফলে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ১০,২২০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। কিন্তু মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন পেয়েছেন মাত্র ৫,৯৭৭ ভোট। এ প্রসঙ্গে তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, প্রার্থীর জয়ের জন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে। তবু ভোট কম হল কেন, তা খতিয়ে দেখা হবে।

সাবেক এমপি আবুল কালাম ব্যস্ত ছিলেন তার ছেলে ছাত্রদল নেতা আবুল কাউসার আশাকে কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে। ছেলে আশা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এ ওয়ার্ডে (বন্দরের ২৩নং ওয়ার্ড) আবুল কাউসার আশা ৪১০৫ ভোট পেলেও মেয়র পদে সাখাওয়াত পেয়েছেন ৩৮০০ ভোট।

সিদ্ধিরগঞ্জে সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন ব্যস্ত সময় পার করেছেন তার ছেলে গোলাম মোহাম্মদ সাদরিলের কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে। ৫নং ওয়ার্ডে গিয়াস উদ্দিনের ছেলে নির্বাচিত হয়েছেন। এ ওয়ার্ডে সাদরিল ২৭৯১ ভোট পেলেও ধানের শীষের সাখাওয়াত পেয়েছেন ২৮৮৫ ভোট। কিন্তু বাকি নয় ওয়ার্ডে বিএনপির মেয়র প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের নেতারা বলেন, ভোটের চিত্রই প্রমাণ করে তিন নেতা নির্বাচনে কার পক্ষে কাজ করেছেন। তারা যেহেতু কাউন্সিলর প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনতে পেরেছেন, চাইলে মেয়র প্রার্থীর জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন, যা দলের পক্ষে ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াতের পরাজয়ের জন্য জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ স্থানীয় কর্মীরা। ক্ষুব্ধ কর্মীরা বলেন, নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকির মুখে জেনেও বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের পক্ষে মনেপ্রাণে মাঠে নামেননি জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। প্রতিদিন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দিন থেকে রাত অবধি সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও শহর এলাকা চষে বেড়ালেও সেভাবে দেখা মেলেনি তৈমুরের। কেন্দ্রীয় নেতারা দলীয় কার্যালয় বা বিএনপি প্রার্থীর মিডিয়া কেন্দ্রে গেলেই ফটোসেশনে দেখা মিলেছে তার। কর্মী-সমর্থকরা অভিযোগ করেছেন, তৈমুর আলম খন্দকার নিজের ছোট ভাই ও মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের জন্য ১৩নং ওয়ার্ডে ব্যাপক গণসংযোগ করেন। অথচ নিজ দলের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে তেমন কোনো প্রচারই চালাননি। উল্টো অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম ও তার ভাই মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের নিজস্ব কর্মীদের আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিতেও দেখা গেছে।

এসব প্রসঙ্গে তৈমুর আলম খন্দকার যুগান্তরকে বলেন, আমাদের প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল ছিল। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অপরিচিত প্রার্থীকে মানুষ ভোট দিতে চান না। তাই সে কম ভোট পেয়েছে। নিজের নির্লিপ্ততার অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, সকাল থেকে আমি আমার দায়িত্বরত শহর এলাকাতে কাজ করেছি। আমার সব নেতাকর্মী প্রতিটি কেন্দ্রে কেন্দ্রে কাজ করছে। আমি এক বিন্দুও অলসতা দেখাইনি।

অপরদিকে বন্দরে বিশাল ভোটব্যাংক থাকলেও সেখানেও চরমভাবে পরাজিত হয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী। এ এলাকার সাবেক এমপি আবুল কালাম ও তার ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল দিন-রাত ব্যস্ত ছিলেন আবুল কালামের ছেলে ছাত্রদল নেতা আবুল কাউসার আশাকে নিয়ে। কাউসারের জন্য কাজ করায় তিনি নাসিকের কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়েছেন। বন্দরের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, শাসক দলের সঙ্গে গোপন সখ্যের কারণেই এমনটি ঘটেছে। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাইফুদ্দিন দুলালকে পরাজিত করতে তিন ডামি প্রার্থীকেও দাঁড় করানো হয়েছিল, যারা আওয়ামী ঘরানার। আবুল কালাম ও আতাউর রহমান মুকুল কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে প্রচারণায় ফটোসেশন করলেও গোপনে তারা শুধু আবুল কাউসার ও নৌকার জন্য কাজ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন কর্মীরা। আবুল কালামকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেনি।

এদিকে সিদ্ধিরগঞ্জের সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিনের ছেলে ৫নং ওয়ার্ডে গোলাম মোহাম্মদ সাদরিল কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছেন। এ ওয়ার্ডে বিএনপির মেয়র প্রার্থী কাউন্সিলরের চেয়ে কিছু ভোট বেশি পেয়েছেন। কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জের অপর ৯টি ওয়ার্ডেই পরাজয় ঘটেছে ধানের শীষের। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের কারণে ভোটের আগ পর্যন্ত একটু কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু ভোটের দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নিজ ওয়ার্ডেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় তাকে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জের সবগুলো কেন্দ্রেই বিএনপির নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে কাজ করছেন। সব কেন্দ্রে এজেন্ট, পোলিং এজেন্ট, সমর্থকরা ছিলেন। আমার ছেলে নির্বাচন করলেও দলের প্রার্থীর পক্ষেই আমি সরব ছিলাম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর