আমি বিজয় দেখেছি

স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত চরমপত্রের জনক সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল লিখেছিলেন “আমি বিজয় দেখেছি”। আমাদের অনেকেরই দুর্ভাগ্য হয়তো, আমরা বিজয় দেখিনি। যুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মই এখন জনসংখ্যার বড় অংশ। ৪৫ বছর দীর্ঘ সময়, আর আমাদের গড় আয়ু নব্বুই দশকেও ৫৭ ছিল। তাই আমাদের ইতিহাস পড়ে, জেনে, বুঝে বিজয় অনুভব করতে হয়। ইতিহাস আমাদের যা শেখায় তাই শিখি, কেন কখন কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ এদেশে আবশ্যম্ভাবী হয়ে গিয়েছিল তা সত্য মিথ্যা কিছুটা আমরা জানি। জাতির জনকের স্বপরিবারে নির্মম হ্ত্যাকাণ্ডের পর ইতিহাস পাল্টে ফেলা হয়। দীর্ঘদিন প্রজন্ম সেই ভুল ইতিহাস পড়ে বড় হয়েছে। তবুও ৩০ লক্ষ শহীদ, গাজী, ২ লক্ষ বীরাঙ্গনার ইতিহাস কম বেশি সবাই জেনেছে।

আজকে দেশের বাইরে যারা থাকি, তাদের প্রায়ই মনে হয় দেশ বোধহয় খোদ হাবিয়া দোজখের চুল্লি। চরম উদ্বেগে যখন স্বজন পরিজনদের কাছে জিজ্ঞেস করি, তারা একই সঙ্গে হতাশার তপ্ত লাভা উগড়ে দেন, আবার সেই সাথে অভয় বাণীও শোনান “এর মধ্যেও তো সবাই আছে, আমরাও আছি, সব ঠিক হয়ে যাবে” । খুব পরস্পর বিরোধী শোনায়, কিন্তু আমার বাবা খুব মজার একটা কথা বলেন। ১৯৭১ এর সেই রক্তঝরা দিনগুলিতেও সবকিছুই চলেছে। কারফিউ দিচ্ছে, উঠে গেলে মানুষ বাইরে যাচ্ছে। বোম্বিং হলে সেলে লুকাচ্ছে। মানুষ মরছে, পাকবাহিনীর জিপ এসে আচমকা ধরে নিয়ে নেই করে যাচ্ছে ৫/৬ টা মাসুম বাচ্চা পেছনে ফেলে যাওয়া সংসারের প্রধান পুরুষকে। কিন্তু জীবন থেমে থাকেনি।

খুব অবিশ্বাস্য লাগে, কিন্তু যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছেও হয়। যেমন, এই জুলাইতে গুলশান হলি আর্টিজান নির্মম হ্ত্যাকাণ্ডের পর দেশে যেন ১৪৪ ধারা, আত্মা হাতে নিয়ে দেশে গিয়ে খুব তো অন্যরকম কিছু পেলাম না তো! হ্যা শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, ঘন জমায়েতের জায়গায় খুব বিধি নিষেধ, কিন্তু এসব স্বস্তিই দিচ্ছিল। মনে হয়েছে, এভাবে করেও যদি মানুষগুলির জান হেফাজতে থাকে! আর মানুষও যেন গা সওয়া। গাধার পিঠে নাকি ১টা বস্তা দিলেও যেমন হাঁটে, ১০টা দিলেও তেমনি হেঁটে যায়। তেমন কিছুই।

পেছনে ফিরে দেখি একাত্তরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সোজা হয়ে দাঁড়াতে সময় নেয়, মানুষের স্বজন হারানোর মানসিক, অর্থ সামাজিক ক্ষত, অঙ্গহানি সারতে সময় নেয়। সারে না বীরাঙ্গনাদের সম্ভ্রম হারানোর যাবজ্জীবন সামাজিক কারাগারের বন্দিদশা, সর্বস্ব হারানো গ্লানি, নিজগৃহে বনবাস। জাতির জনকের সন্মানিত পদবীর উত্তরীয় গলায় ঝুলিয়ে তাদের জীবনের একচুল পরিবর্তন হয়নি তা অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহীমের “আমি বীরাঙ্গনা বলছি” পড়ে মাত্র পাঁচজন তুলনামূলক ভাগ্যবতীর জবানিতে আন্দাজ করা যায়। এমন সামাজিক মূল্যবোধের দেশে মেয়েদের তৈরি পোশাক রপ্তানির শ্রমবাজারের মাধ্যমে অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ভূমিকাতেই আমি যেন সবচেয়ে বড় বিজয় দেখি।

আরো কিছু ক্ষত রেখে যায় চিরস্থায়ী ক্ষতি। আমার নানা, মরহুম অধ্যক্ষ ফজলুল করিমকে পাকিস্তানি আর্মি সিলেটের শেখঘাট কলোনির বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করার অভিযোগে। আমার নানী তার স্কুলপড়ুয়া ৪ ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছিলেন। রাত জেগে আল- কোরানের বিশেষ খতম পড়তেন, যা সিজদাতে পড়তে হয়। সেই সুরা তার মুখস্থ ছিল না। রাতে বাতি জ্বালানো যাবে না বলে কুপির আলো জ্বেলে মোড়ায় সিজদা দিয়ে নিচে আয়াত রেখে দেড় ঘন্টা ধরে পড়তেন সেই আয়াত। মাস দেড়েক পর দৈব উপায়ে নানা মুক্ত হয়েছিলেন, সারাদেহে ক্ষত । আর নানীর চোখে চিরদিনের জন্য জ্যোতি কমে গিয়েছিল।

আরেক মামা গেলেন যুদ্ধে, সারা পিঠে ছররা গুলি গেঁথে গিয়েছিল । মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখাতে যাননি কোনোদিন, রক্তে সীসা ছড়িয়ে গেলে চিরদিনের জন্য মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যান। আমি কোনোদিনই তাকে বদ্ধ ঘরের বাইরে দেখিনি । জানালা দিয়ে আধো অন্ধকারে চুল দাড়ির জঙ্গলে অতীতের এক তুমুল সুদর্শন নবীন যুবকের একাকী মধ্য বয়স দেখেছি। বিহারীদের হাতে জবাই হয়েছিলেন নানির সমবয়সী তিন মামা, একসাথে। রক্তমাখা জিপ শুধু ধানক্ষেতের পাশে পাওয়া গিয়েছিল। দেশের বাড়িতে আটা-চালের সরবরাহ নিয়ে যাচ্ছিলেন।

এসব লিখতে বা মনে করতে ভালো লাগে না, সব পরিবারেই এমন ইতিহাস আছেই। যাদের নেই তারা ভাগ্যবান, আর কেউ বেঁচেছিলেন হানাদারের দোসর হবার কৃপায়, যারা ক্ষেপে যান এসব পড়ে। কী লাভ লোক ক্ষেপিয়ে, সবাই এখন এর তার উপর ক্ষেপে থাকে। আজ অমুক কাল তমুক সমীকরণের কোপানলে পড়তে হয়।

আজ অনেকেই বলেন , মাত্র ৯ মাসে প্রি-ম্যাচিওরড ডেলিভারির এক দেশ পেয়ে আমরা কেউ এর প্রসব যন্ত্রণা বুঝলাম না। কথাটা কি ঠিক? ৯ মাসে রক্তক্ষয়ের পরিমাণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এখনো বিশ্বের ইতিহাসে নির্মমতম হ্ত্যাযজ্ঞের নাম। হিসাব ছিল যুদ্ধ দুই বছর আর কিছু মাস গেলে আমরা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতাম, যদি না ভারত এই যুদ্ধে সহায়তা না করতো। সেই রক্তঋণ আজো শোধ শেষ হয় না, যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে কি হতো?

ডুয়েলিটিতে পড়ি যখন আজকে “বাংলাদেশ প্যারাডক্স” দেখি। মাহাথির মোহাম্মদের ৩০ বছরের একনায়কতন্ত্রে “মালয়েশিয়া মডেল” অনুকরণীয় বলে প্রচলিত, কিন্তু যারা মালয়েশিয়া থাকেন তারা বলেন দুর্নীতির অভিনব গল্প। আমরাও দেখি দেশে সবক্ষেত্রে অসন্তুষ্টি, উন্নয়নের স্ক্রিনসেভার দিয়ে বিপুল অনিয়ম অপচয় স্যুয়ারেজের জলের মত বয়ে যাচ্ছে, আর বিশ্ব বলে বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নমুখি প্রতিশ্রতিশীল এক দেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেমন অন্য সব দেশে টেরোরিস্টের আস্তানা খুঁজে পায়, টেরোরিস্ট আক্রমণের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে, উদ্বেগ জানায়। আমরা টের পাই সেই উদ্বেগের তর্জমা কি আর শানে নজুল কি। সরকার সিরিয়া ইরাক, আফগানিস্তান হবার ভয়ে শঙ্কিত হয়। আর সেই মার্কিন মুল্লুকেই সবচেয়ে বড় টেরোরিস্ট আক্রমণ ঘটে যায়, তখন সর্ষের ভেতর ভূতের সম্রাটকে দেখে “সত্যিই সেলুকাস” আওড়ানো ছাড়া কিছুই করার থাকে না।

কাশবন দূর থেকে অনেক ঘনই দেখা যায়, এর ফাঁপা ভেতরটা ভেতরে যে যায় সেই দেখে। আজকে বিজয়ের তর্জমাটা যখন খুঁজি তখন পুরানো ব্যথার দাওয়াইতে নিত্য নতুন জখমে নজর ঘোরানোর মুক্তি চাই। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আজ বিজয় দিবস মানে রাতভর কান ফাটানো মাইকিং, ভোরে তোপধ্বনি, রাস্তা, পত্রিকা, ফেসবুকে লাল-সবুজের সমারোহ। যুদ্ধপূর্ব প্রজন্মের কাছে হতাশ-শ্বাস, “এই দেখতে দেশ স্বাধীন হয়েছে! ” পুরাতন বচন “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন”, আমরা কঠিনেরেই ভালোবেসে জন্ম নিয়েছি, বেড়ে উঠেছি প্রতিদিন শত শত কাঠিন্য পেরিয়ে । কিন্ত “খারাপ হয়েছে, হচ্ছে” মানুষ নিতে পারে, খারাপের অজানা আশঙ্কা নিতে পারেনা। আমরা এই আশঙ্কার মুক্তি চাই।

স্বয়ং সরকার প্রধান কয়েকদফা নিশ্চিত মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে ফিরে এসেছেন , তাঁর চেয়ে মৃত্যুকে এতোবার এতো কাছ থেকে দেখা আর কে ভাল জানেন? অর্থনীতিতে “ল অব ডিমিনিশিং রিটার্ন” বলে একটা টার্ম আছে, কখন পণ্যের লাভ বিনিয়োগের চেয়ে কমে যায়, যার সরল কারণ অতিপ্রিয় জিনিসও প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণে বাধ্য হলে একসময় গ্রহিতা সেটা উগড়ে দেয়। আমরা সেই উগড়ে দেয়ার সর্বোচ্চ ধাপে যেখানে আমাদের মতামতের, ভাল মন্দের কোনো ধার না ধেরে একাধারে একমুখি শাসন গেলানো হচ্ছে। সবক্ষেত্রে লাভার মত উগড়ে দেবার অবস্থায়। আজ ১৬কোটি জনতা ধনে, মানে, শিক্ষায়, প্রাণে সর্বত্র এই বিচার-বিবেচনাহীনতা উগড়ে সুস্থ জীবন চায়- এটাই আমাদের জন্য এখন একমাত্র বিজয়, আর সব কিছুই ফিকে, ক্লিশে।
আজ আমরা সেই বিজয়টাই দেখতে চাই। এবং বলতে চাই, হ্যা ,“ আমি বিজয় দেখেছি” !

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর