ছাগল-ভেড়ার ওজন বৃদ্ধির হার দ্বিগুণেরও বেশি

দেশে ছাগল ও ভেড়ার উৎপাদন প্রতিদিনই বাড়ছে। শুধু উৎপাদনই বাড়ছে না। আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা উন্নত জাতের ছাগল ও ভেড়ার উৎপাদনে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সহযোগিতা করছে। এই উন্নত জাত আসার আগে আমাদের দেশে সাধারণত একটি ছাগল বা ভেড়ার ওজন ১০ থেকে ১৫ কেজির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু উন্নত জাত আসার ফলে এখন ৫০/৬০ কেজি ওজনের ছাগল ও ভেড়া উৎপাদন হচ্ছে আমাদের দেশে। উন্নত জাতের ছাগল/ভেড়ার পাঁঠা উৎপাদনের কারণে বাচ্চার মৃত্যুহার ১০ থেকে ৩ ভাগে নেমে এসেছে। তাছাড়া জন্মের সময় এসব বাচ্চার ওজনও বাড়ছে প্রায় দ্বিগুণ। আগে যেখানে একটি ছাগল বা ভেড়ার বাচ্চার জন্ম ওজন ছিল প্রায় ৭০০-৮০০ গ্রাম; বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৬০০-২০০০ গ্রাম পর্যন্ত হচ্ছে। আগে বাচ্চার দৈহিক ওজন বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৫০-৬০ গ্রাম, বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৯০-১১০ গ্রাম পর্যন্ত হচ্ছে।

ভেড়া ও ছাগলের খামার করে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এছাড়া গরিব মানুষের সঞ্চয়ের একমাত্র পথ হলো ছাগল ভেড়া পালন, যা বিক্রি করে অনেকে স্বাবলম্বী হন, অনেকে দুর্দিন বা দুঃসময় পার করেন। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত যুবক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ছাগল ও ভেড়া চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তারা এ সম্পর্কিত বিভিন্ন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করছেন। শিখছেন ছাগল-ভেড়া পালনের নতুন নতুন কৌশল। ছাগল-ভেড়া পালন এখন আর সেকালের পদ্ধতিতে নেই। এখন অনেক উন্নত পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। শিক্ষিত যুবকরা সেসব পদ্ধতি শিখে বদলাচ্ছেন নিজেদের ভাগ্য। হাজারো যুবকের এমন উদ্যোগের ফলে দেশে প্রতিদিনই ছাগল-ভেড়ার উৎপাদন বাড়ছে।

বর্তমানে দেশে ২ কোটি ৫৪ লাখ ছাগল ও ৩২ লাখ ভেড়া রয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হক। তিনি বলেন, ৫/৬ বছর আগেও দেশে ছাগল-ভেড়ার উৎপাদন ছিল এর অর্ধেক। আগামী ৫ বছরে উৎপাদর এর দ্বিগুণ হবে বলে তিনি আশা করেন।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগে ভেড়া পালন হতো মূলত কুষ্টিয়া, যশোর ও রাজশাহী অঞ্চলে। এখন পার্বত্য অঞ্চল, হাওর ও উপকূলীয় এলাকায়ও বিস্তৃত হয়েছে ভেড়ার খামার। প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব বিবেচনায় সরকারও ভেড়া পালনে উৎসাহ জোগাচ্ছে। এজন্য চালু করা হয়েছে একটি প্রকল্পও।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, বিশ্বে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে চতুর্থ অবস্থানে ভেড়া। বিদেশের বাজারে ভেড়ার মাংসের রয়েছে বেশ চাহিদা, যদিও দেশে আমিষের উৎস হিসেবে এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি প্রাণীটি। শুধু আমিষের চাহিদা পূরণ নয়, পশম রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎসও হতে পারে ভেড়া।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ৬৪ জেলার ৪৮০টি উপজেলায় ভেড়া পালন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে ১২৮টি কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং খামারের উন্নয়ন করা হয়েছে। এছাড়া ভেড়া উৎপাদন বাড়াতে গবেষণা কার্যক্রমও জোরদার করেছে মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার ভেড়ার জাত চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ পরিবেশে ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেড়া উৎপাদন বাড়াতে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের যমুনা ও বরেন্দ্র অববাহিকায় দেশি ভেড়ার জাত উন্নয়ন, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও ব্যবস্থাপনা এবং কমিউনিটিভিত্তিক ভেড়া পালন এবং ভেড়া থেকে উৎপাদিত পশমের ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য তৈরির বিষয়ে ছয়টি গবেষণা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব বিষয়ে ১৫ জন বিজ্ঞানীকে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সমাজভিত্তিক ও বাণিজ্যিক খামারে দেশি ভেড়ার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ (কম্পোনেন্ট এ, গবেষণা-২য় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় উপকেন্দ্রগুলোতে পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রচলিত ব্যবস্থাপনায় ভেড়া পালন করায় খামারিরা খুব বেশি লাভবান হন না। কারণ ভেড়ার বাচ্চার জন্ম ওজন কম, ওজন বৃদ্ধির হার কম এবং পুষ্টিহীনতার কারণে মৃত্যুহার বেশি। এসব সমস্যা সামনে রেখে খামারিদের মাঝে উৎকৃষ্ট মানের পাঁঠা বিতরণের জন্য বিএলআরআই’র ছাগল ও ভেড়া উৎপাদন গবেষণা খামারে সুনির্দিষ্ট ব্যাপস্থাপনায় প্রজনন পাঁঠা প্রস্তুত করা হয়। প্রস্তুতকৃত পাঁঠাগুলো প্রজনন বৈশিষ্ট্য নিরূপণের মাধ্যমে নির্বাচিত উৎকৃষ্ট মানের পাঁঠাগুলো চাহিদা অনুযায়ী নওগাঁ সদর, মহাদেবপুর, গাইবান্ধা সদর, গোবিন্দগঞ্জ, সিলেট সদর, বালাগঞ্জ, ভূয়াপুর, নাক্ষাইংছড়ি ইত্যাদি উপকেন্দ্রে বিতরণ করা হয়। এ পর্যন্ত ৫৫টি ভেড়ার পাঁঠা উপকেন্দ্রে বিতরণ করা হয়েছে। প্রকল্পের নিদের্শনা অনুযায়ী খামারিরা সমাজভিত্তিকভাবে পাঁঠাগুলোকে প্রজনন কাজে ব্যবহার করে। প্রতিটি উপকেন্দ্রে কর্মরত বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. তালুকদার নুরুন্নাহার উৎকৃষ্টমানের ছাগল ও ভেড়ার পাঁঠা উৎপাদন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে জাগো নিউজকে বলেন, গবেষণা করে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, উৎকৃষ্ট মানের পাঁঠা দ্বারা প্রজননের মাধ্যমে কৌলিক গুণাগুণ সম্পন্ন বাচ্চা উৎপাদন হয়। যাদের জন্ম ওজন বেশি, বাচ্চা মৃত্যুহার কম, দৈহিক ওজন বৃদ্ধির হার বেশি। পূর্বে যেখানে ভেড়ার বাচ্চার জন্ম ওজন ছিল প্রায় ৭০০-৮০০ গ্রাম; বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৬০০-২০০০ গ্রাম পর্যন্ত হচ্ছে। আগে বাচ্চার দৈহিক ওজন বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৫০-৬০ গ্রাম; বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৯০-১১০ গ্রাম পর্যন্ত হচ্ছে। এছাড়া বাচ্চার মৃত্যু ১০ ভাগ থেকে কমে প্রায় ৩ ভাগ হয়েছে।

তিনি বলেন, আন্তঃপ্রজনন রোধের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর সমাজভিত্তিক খামারিদের মাঝে পাঁঠা রোটেশন করা হয়। পর্যবেক্ষণে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মাঠ পর্যায়ে ভেড়ার জাত উন্নয়নের জন্য উৎকৃষ্ট মানের পাঁঠার কোনো বিকল্প নেই। প্রকল্পের আওতাধীন উপকেন্দ্রগুলোতে পরিচালিত গবেষণা কার্যক্রমের ফলাফল সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হলে একদিকে যেমন জাত উন্নয়নের মাধ্যমে ভেড়া উৎপাদনে দেশ এগিয়ে যাবে, অন্যদিকে খামারিরা আর্থিকভাবে আরও বেশি লাভবান হবেন। ফলে বেকারত্ব হ্রাস, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর মতায়ন এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর