৪৫ বছরে পুলিশ: ব্যর্থতা অনেক, সাফল্যও কম না

বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে রক্তের সাগরে ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানি সেবা বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের উপর হামলে পড়ে, তখন প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পুলিশ বাহিনীই। ৪৫ বছর পরে এসে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে?

বাহিনীটির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, নানা সমালোচনা ও কিছু কর্মীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের পরও পুলিশের সাফল্য কম নয়।

ব্রিটিশ শাসনের প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে যে পুলিশের জন্ম, সে পুলিশ কালের স্রোতধারায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম দিতে রাখল ঐতিহাসিক ভূমিকা। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা রক্ষা করার যে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক প্রক্রিয়া সেখানেও রেখে চলেছে সাফল্যের স্বাক্ষর। কীভাবে, কিসের ছোঁয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ হয়ে উঠল একটি জাতির সামনে এগিয়ে চলার অন্যতম নিয়ামক? শুধুই কি সাফল্য গাঁথা? ব্যর্থতা নেই বাংলাদেশ পুলিশের? প্রশংসা যেমন আছে, সমালোচনা কি নেই সমানতালে?

স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ পুলিশ’নামে যাত্রা শুরু করা এই বাহিনীটি আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনের পাশাপাশি যান চলাচল নিয়ন্ত্রণেরও কাজ করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের পরাধীনতার বৃত্ত ভেদ করে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশ পুলিশের ট্রাডিশনাল চরিত্রে বিরাট পরিবর্তন এনেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে। শুধু আইন পালন আর অপরাধ প্রতিরোধ বা দমনই নয় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।

পুলিশ খারাপ, পুলিশ ভালো

এক লাখ ৯৪ হাজার ৯৩৮ জন পুলিশ সদস্য নিয়ে বর্তমানে পুলিশ কাজ করছে। নানা সময় অপরাধে জড়িয়ে পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। রয়েছে থানায় দুর্ব্যবহার, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, ঘুষ আদায়, বিচারবহির্ভুত হত্যাসহ নানা অভিযোগ। আবার তদন্তে ব্যর্থতা, ইচ্ছাকৃত বিলম্বের অভিযোগও কম না।

২০০৬ সালে পুলিশের সে সময়ের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী আনোয়ারার বিরুদ্ধে শিশু পাচারের অভিযোগ উঠে। ছয়টি শিশুসহ তারা আটকও হন। পরে ছয় বছর পর তাদের কারাদণ্ড হয়। আনিসুর রহমান জামিনে বের হয়ে পলাতক আছেন।

২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে থানায় নিয়ে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগ উঠে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলালউদ্দিনের বিরুদ্ধে। পরে তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়।

২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তাঁতীবাজার থেকে ব্যবসায়ীন নয়শ গ্রাম স্বর্ণ ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠে বনানী থানার উপপরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম ও তার দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে।

নানা অভিযোগে গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার কারণে পুলিশের প্রায় ৭৬ হাজার সদস্যদেরকে বিভিন্ন মেয়াদি সাজা ভোগ করতে হয়েছে। এক হিসাবে দেখা গেছে পুলিশের অর্ধেক সদস্যই কোনো না কোনো সাজা পেয়েছেন।

তবে পুলিশ মাত্রই জনবিরোধী-এ কথা বলার সুযোগ নেই। চলতি বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর জিম্মিদের মুক্ত করার চেষ্টায় এগিয়ে গিয়ে প্রাণ দেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন খান। ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দুই পুলিশ সদস্য প্রণ দিয়ে ঠেকিয়ে দেন ঈদগাহ ময়দানে জঙ্গি হামলার চেষ্টা।

নানা সময় মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে প্রশংসিতও হয়েছে পুলিশ। গত ১১ ডিসেম্বর কক্সবাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এক শিশুকে বুকে নিয়ে পুলিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা শের আলীর কান্না ছুঁয়েছে সবাইকে।

গত ৪৫ বছরে পুলিশের মূল্যায়ন করতে বলা হলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর পুলিশ আবার পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাদেরকে কখনও জনগণের বন্ধু হিসেবে পাওয়া যায়নি। বৃট্রিশরা যেভাবে পুলিশকে ব্যবহার করেছে এখন শাসকরা কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশকে সেইভাবেই ব্যবহার করছে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপরাধ) হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পুলিশ এখন অনেক আধুনিক। পুলিশের অনেক ভাল ভাল কর্মকর্তারা আসছেন। তবে এত বড় বাহিনী প্রায় দুই লাখের মত সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভুলত্রুটি তো থাকতে পারেই ‘

আর পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এস এম নূরুল হুদা বলেন, ‘পুলিশের কাজ খুবই কঠিন। তাদের ওপর রাজনৈতিক চাপের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে পুলিশকে একতরফাভাবে দোষারোপ করলে লাভ হবে না। পুলিশ এখন পর্যন্ত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি।’

জঙ্গি নির্মূলে সাফল্য

গত এক দশকে জঙ্গিবাদ দমন এবং নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

নানা নামে বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে কাজ করছে বাংলদেশ পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশে ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি (বিশেষ অস্ত্র ও কার্যপদ্ধতি) ঢাকা মহানগর পুলিশ ইউনিটের একটি অভিজাত শাখা। জঙ্গি দমনের সোয়াত বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ ইউনিটের গোয়েন্দা শাখার অধীনে সোয়াত কাজ করে। সোয়াত ইউনিটের সদস্যরা অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম ব্যবহার করেন। এদের দেশে এবং বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জরুরি প্রয়োজন এবং সংকট ব্যবস্থাপনা, জঙ্গি দমন সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ, জিম্মি উদ্ধার ইত্যাদি অপরাধ মোকাবিলায় সোয়াত সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে এতিরোধ যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল পুলিশই। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ করে সেদিন গণহত্যাও চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।

স্বাধীনতা যুদ্ধে এক হাজার ২৬২ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হন। ঝিনাইদহের তৎকালীন সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিব নগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।

পুলিশের বিশেষ শাখাগুলো

২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের নিরাপত্তায় সুরক্ষা ব্যাটালিয়ন নামে পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রাথমিক ভাবে দুটি প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন দিয়ে এই বাহিনী যাত্রা শুরু হয়।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) : বাহিনীর একটি এলিট ইউনিট ধরা হয় একে। একটি নারী ব্যাটেলিয়নসহ মোট ১১টি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন আছে। একজন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক এর প্রধান।

বিমানবন্দর সশস্ত্র পুলিশ (এএপি): এপিবিএনের একটি বিশেষায়িত ইউনিট এটি। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য বিমানবন্দর এলাকার মধ্যে নিয়োজিত আছে। বর্তমানে অষ্টম এপিবিএন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকার নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত।

র‌্যাব: সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত হয় এই শাখা। পুলিশ সদর দপ্তরের অধীনে পরিচালিত এই বাহিনী ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ গঠিত হয়।

পুলিশের পাশাপাশি সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, আনসার ও সিভিল প্রশাসনের সদস্যদের নিয়ে র‌্যাব গঠিত হয়। এই বাহিনীর অন্যতম সাফল্য হল জঙ্গি দমন বিশেষত জামাআতুল মুজাহিদিন (জেএমবি) রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠার আগেই তাদের সমস্ত নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দেয় র‌্যাব।

নৌ পুলিশ: সামুদ্রিক অঞ্চলের নিরাপত্তা ও সীমান্তবর্তী সামুদ্রিক অঞ্চলের নিরাপত্তায় পুলিশের এই শাখার সদস্যরা দায়িত্বপালন করে থাকেন। এছাড়া নৌপরিবহন সমূহে।

পর্যটন পুলিশ : কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণরত স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু হয় এই শাখার। এর কলেবর বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় এর নিরাপত্তা বিধান কার্যক্রমের আওতায় আনার পরিকল্পনা আছে।

পুলিশ অভ্যন্তরীণ ওভারসাইট (পিআইও): পুলিশ কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নজরদারি করতে ও তাদের উপর গোয়েদা কার্যক্রম পরিচালনা করতে এই বিশেষায়িত বিভাগ কাজ করে। ২০০৭ সালে এই বিভাগটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন সহকারী মহা পুলিশ পরিদর্শক এই বিভাগের প্রধান এবং তিনি সরাসরি মহাপুলিশ পরিদর্শকের কাছে রিপোর্ট করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর