নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই জন্যই চ্যালেঞ্জ

ফের আলোচনায় ভোটের রাজনীতি। না, এ ভোটে সরকার পাল্টাবে না। এমনকি রাজনীতিতে আসবে না কোনো পরিবর্তন। তারপরও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই শিবিরের জন্যই চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছে। এমনিতেই রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য। বিএনপি কেন, অন্য কোনো বিরোধীদেরও কোথাও পাওয়া যায় না। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের রাজনীতি। মাঠের রাজনীতি থেকে বহু আগেই আউট হয়ে গেছে বিএনপি। আর কখনো মাঠে ফিরতে পারবে কি-না সে প্রশ্নও উঠেছে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক আবহাওয়াও বিরাজ করছে। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির দুই প্রার্থীর মধ্যেই হবে ভোটের লড়াই। সেলিনা হায়াৎ আইভী দীর্ঘদিন ধরেই নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নাম। উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানেরও। বিশেষ করে সাত খুনের মামলায় তার শক্ত ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। দুই প্রধান প্রার্থীর কারও বিরুদ্ধে অস্ত্রবাজি-দখলবাজির তেমন কোনো অভিযোগ নেই। সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়নি। টুকটাক কিছু অভিযোগ এক প্রার্থী আরেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে তুলছেন। এটা রাজনীতির স্বাভাবিক চিত্রই। তবে এবারের নির্বাচন দুই প্রার্থীর ভাবমূর্তির জন্যও চ্যালেঞ্জের। ভোটের দিন তাদের সমর্থকরা কেন্দ্র দখল বা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন কি-না সেদিকে দৃষ্টি থাকবে পর্যবেক্ষকদের। কিংবা ভোটের আগের দিনগুলোতে পেশিশক্তির ব্যবহার কতটা হয় তাও হবে দেখার বিষয়। ভোটে না থাকলেও যথারীতি আলোচনায় রয়েছে ওসমান পরিবার। শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে, আইভীর প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন প্রকাশ করেছেন। ওদিকে, নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতারা শেষ পর্যন্ত ধানের শীষের পক্ষে কতটা ভূমিকা রাখেন তা দেখার জন্যও অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন শেষ পর্যন্ত দুই প্রার্থীর লড়াই ছাপিয়ে দুই জোটের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। প্রধান কারণ অবশ্যই, ব্যালটে নৌকা আর ধানের শীষ প্রতীক থাকা। গত দুই যুগ ধরে এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির চেনা দৃশ্য। নৌকা আর ধানের শীষের জমজমাট লড়াই। অবশ্য কখনও তারা প্রতিপক্ষকে ওয়াক ওভার দিয়েছেন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেমন ধানের শীষ ছিল না। আগামী নির্বাচনে থাকবে কি-না সে নিয়েও নানা প্রশ্ন। যদিও নির্বাচন কমিশন গঠনে এরইমধ্যে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া প্রস্তাব হাজির করেছেন। চলতি মাসেই নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক দলগুলোকে বঙ্গভবনে আলোচনার জন্য ডাকতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরইমধ্যে সংসদে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠন ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট যে সিদ্ধান্ত দেবেন তারা তা মেনে নেবেন। যদিও বাংলাদেশের ইতিহাসে সংলাপ সফল হওয়ার তেমন কোনো নজির নেই।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখনো বহুদূর। পাক্কা দুই বছর। তবে এরইমধ্যে প্রকাশ্যে-গোপনে নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা নানা মহল থেকেই বলা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের ভেতরে এক ধরনের নির্বাচনী প্রস্তুতি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। টেবিল ওয়ার্কও চলছে পুরোদমে। প্রকাশ্য না হলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে বিএনপির ভেতরেও। বিশেষ করে মামলা থাকায় প্রতিটি আসনে বিকল্প প্রার্থী ঠিক করতে কাজ করছে দলটি।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন দুই শিবিরের জন্যই তাদের জমিন পরীক্ষার সুযোগ নিয়ে এসেছে। যদিও একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভোট দিয়ে কোনো দলের জনপ্রিয়তা পুরো যাচাই করা যায় না। আর প্রতীকের বাইরে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভোটও নির্বাচনের জয়-পরাজয়কে প্রভাবিত করে। তারপরও নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতীকের একধরনের জনপ্রিয়তার পরীক্ষা। এ নিয়ে যখন নানা আলোচনা চলছে, তখন মার্কিনভিত্তিক জরিপ সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এখন যদি নির্বাচন হয় তাহলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পাবে ৩৮ শতাংশ ভোট। বিএনপি পাবে ৫ শতাংশ ভোট। জাতীয় পার্টি ১ শতাংশ ও জামায়াতে ইসলামী পাবে ২ শতাংশ ভোট। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পরিচালিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে আওয়ামী লীগ ৩৮ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৫ শতাংশ ভোট পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ জরিপ রিপোর্টকে হাস্যকর বলে অভিহিত করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে এ জরিপেরও একধরনের পরীক্ষা হয়ে যাবে।
রাজনীতিতে বহু কথা থাকে। তবে শেষ পর্যন্ত জনগণই শেষ কথা। যদিও কখনও কখনও জনগণের ক্ষমতা হাইজ্যাক হয়ে যায়। পাশের দেশ ভারতের তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার কথাই ধরুন না কেন। দুর্নীতির কারণে তিনি সমালোচিত ছিলেন। কখনও ছিলেন মসনদে, কখনও মসনদ হারা। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তামিলনাড়ুতে যে দৃশ্য দেখা গেছে, তা কেবল একজন তুমুল জনপ্রিয় নেতার কপালেই জোটে। জনগণের মধ্যে যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এই শোক, এই হাহাকার তারই প্রমাণ।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এরইমধ্যে দুই জোট তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। বিএনপির ক্ষেত্রেও তাই। ব্যক্তিগত ক্যারিশমা বনাম প্রতীক। প্রকাশ্য কোন্দল বনাম ভেতরগত দ্বন্দ্ব। জনমানসে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি- নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে পাওয়া যেতে পারে তার আভাস।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর