কৌশলী হতে গিয়ে কি যাত্রার কুশীলব হব? পীর হাবিবুর রহমান

আমার একজন অতি প্রিয় মানুষ বলেছেন, কৌশলী হতে। রাজনীতিতে সাফল্য তার হাতের মুঠোয়। আমার প্রতি তার অগাধ স্নেহ অভিভূত ও মুগ্ধ করে। এই কথাটি আমাকে আত্মার বাঁধনে বাধা আরেকজন মানুষ বলেছিলেন। তিনি ব্যাবসায় পা দিয়ে সাফল্য তালুবন্দি করেছেন। দুজনেই উচ্চশিক্ষিত মেধাবী ও সৃজনশীল। দুজন দুই প্রজন্মের। শেষের জন আমাকে ভালবাসেন কিনা জানিনা। তবে অপছন্দ করেন না, অকল্যাণ চাননা এটা বুঝি। তার প্রতি আমার অগাধ সম্মান ও ভালবাসা রয়েছে।
প্রথমজনকে আমি বলেছিলাম, কৌশলী আপনাকে না হয় হতে হয়। ক্ষমতার পথ বড় পিচ্ছিল। শেষেরজনকে বলেছিলাম, আত্মমর্যাদার সঙ্গে টাকা কামানো বড় কঠিন। তাই কৌশলী হয়ে পথ চলেন। দুজনকেই বলেছি, আপনারা কৌশলী থাকুন। কিন্তু আমি যে বয়সে ক্ষমতার মোহ গ্রাস করে, রাজনীতির পথ টানে সে বয়সে মোহ ত্যাগ করে বর্তমান পেশার তারে জীবনকে জড়িয়েছি। যে বয়সে বিত্ত-বৈভব বিলাসী জীবন টানে সেই বয়সে আমি বেশি কিছু চাইনি। স্বচ্ছল জীবনের বেশি কিছু চাইনি। কিন্তু চেয়েছি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে। হাত খুলে লেখার স্বাধীনতা, কণ্ঠ ছেড়ে বলার অধিকার। এ আমার রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মুক্তচিন্তার অধিকার। এ আমাদের জীবন দান করা গণতন্ত্রের সংগ্রামে অর্জিত অধিকার। এ কারো করুণা বা অনুকম্পার ফসল নয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কবি বেনজামিন মলয়সে মানুষের জন্য লিখতে গিয়ে দণ্ডিত হয়ে জীবন দিয়েছেন। দেশে দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছে মানুষের পাশাপাশি লেখক সাংবাদিকদের আত্মহুতি দানের মধ্য দিয়ে। সেখানে আমরা এত হিসেব করে চলি তারপরও ছেলেবেলা থেকেই শুনতে হয়েছে বাড়াবাড়ি-পাগলামি বলে ছুড়ে দেয়া তিরস্কার। অর্ধেক জীবন পার করে এসে শুনতে হয় কৌশলী হতে। বিত্তশালীদের তদ্বিরবাজ রাজনীতিবিদ কিংবা অন্য কোন কেউ কোথায় পথ আগলে রাখেন, কোথায় কে ক্ষতি করে বসেন, তাই উদ্বিগ্ন অতি আপনজনরা কাছে টেনে বলেন, কৌশলী হতে। কৌশলী হতে হতে একজন মানুষ আর মানুষ থাকে কী? নাকি নির্জীব ডামি হয়ে বাস করে সমাজে?
সাহসী মানুষ ও লেখক আহমদ ছফা মৃত্যুর আগে এক আড্ডায় বলেছিলেন, যে সমাজ কিছু পাগল (প্রথাবিরোধী মানুষ) কে ধারণ করতে পারেনা, সে সমাজ বসবাস অনুপযোগী। আমি নিজেও বিশ্বাস করি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের নীতি হবে শতফুল ফুটতে দেওয়ার, শতমত ও পথ লালন করার। আমার মতামত আমি বলব, তোমার মতামত তুমি বলবে। এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র। সেই কোন যুগে ইউরোপের বাস্তবসম্মত দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল মুক্ত চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন বলেই আজকের বৃটেনকে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাতৃগর্ভ বলা হয়।
কৌশলী হতে গিয়ে কি যাত্রার কুশীলব হব?সম্প্রতি শেষ হওয়া সংসদ নির্বাচনে ১৯১ জন নারী বিজয়ী হয়েছেন। সেখানে আমাদের জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনী টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনের একটি টাফ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছেন লেবার দলের মনোনয়নে। ডুবন্ত তরীতে উঠে টিউলিপ জিতে গেছেন সেই আসন থেকে যেখান থেকে একদিন অস্কারবিজয়ী অভিনেত্রী গ্ল্যান্ডা জ্যাকসন বিজয়ী হয়েছিলেন অল্প ভোটের ব্যবধানে এবং তিনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। এই নির্বাচনে বাঙালি অধ্যুষিত বেথনালগ্রিন-বো আসন থেকে দ্বিতীয় বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন রোশনারা আলী। আরেক বাংলাদেশি সন্তান রুপা হকও জিতেছেন। এ আমাদের গৌরবের। টিউলিপের ভাই রেদওয়ান সিদ্দিক ববির একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন সেই কিংবদন্তী সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট যিনি স্বাধীনতা উত্তর বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। ববি সেখানে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে মেধার সঙ্গে নেতৃত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে আলোকিত হচ্ছেন- এটাই রাজনীতির ভবিষ্যত গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বৃটেনে এই রাজনীতি একদিনে আসেনি। নারীর ভোটাধিকারের জন্য আজকের বৃটিশ পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরেই এক ইংলিশ তরুণী আত্মহুতি দিয়েছিলেন। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করব সেখানে মানুষের জন্য স্বাধীন চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া যেমন আনন্দের নয়, তেমনি কৌশলের আশ্রয় নিয়ে আপষকামিতার চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া কতটা গ্লানি ও বেদনার বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের প্রথাবিরোধী লেখক অরুন্ধতি রায় লিখতে না পারলে বুঝতে পারতেন। কিন্তু সরকারকে নয়, রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন মানুষের অধিকার প্রশ্নে।
কৌশলী হতে গিয়ে কি যাত্রার কুশীলব হব?মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘাতক চক্র যদি স্বাধীন দেশে বসবাস ও রাজনীতির অধিকার পেয়ে থাকে, বঙ্গবন্ধুর খুনীরা যদি কূটনৈতিক চাকরি থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার পায়, সেখানে একজন দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরিন কেন অধিকার নিয়ে তার মাতৃভূমিতে বসবাস করতে পারবে না? একটি গণতান্ত্রিক সমাজে নাস্তিক-আস্তিক, ডান-বাম সবার বসবাসের অধিকার রয়েছে। সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করলে, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে প্রচলিত আইনে বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। দাউদ হায়দারের বিতর্কিত লেখা কিংবা তসলিমা নাসরিনের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা লেখার সঙ্গে আমি একমত নই; কিন্তু তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নিজ আবাসভূমিতে স্বাধীনভাবে বিচরণের পক্ষে। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত করা যেমন আমার কাম্য নয়, তেমনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কারো জীবন হরণ, হত্যা, খুন সমর্থনযেগ্য তো নয়ই; রাষ্ট্রকে সেখানে মানুষের জান-মাল রক্ষার পাশাপাশি মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি।
কৌশলী হতে গিয়ে কি যাত্রার কুশীলব হব?দেশের মেধাবী সন্তানরা ব্লগার হয়ে মুক্তচিন্তার চর্চার কারণে একে একে খুন হচ্ছে। রাজীবের রক্তের দাগ মুছতে না মুছতেই অভিজিতের মতো বিজ্ঞান মনস্ক প্রকৌশলী তরুণকে একুশের বই মেলার রাতে টিএসসির পাশে ঘাতকেরা খুন করে চলে গেছে। ঘাতক ধরা পড়েনি। সেই রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতে তেজগাঁয়ে ব্লগার বাবু খুন হয়েছে। পুলিশ ধরেনি, ঘাতককে ঝাপটে ধরেছিল হিজড়ারা। এখনো রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিনের রহস্যজনক অন্তর্ধানের দু’মাস পর রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা রচনা স্থল মেঘালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শিলংয়ের মানসিক হাসপাতালে সন্ধান লাভের আনন্দময় খবর ছড়িয়ে পড়ার আগেই সাত সকালে সিলেটে বাড়ির সামনে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের মুখে দাঁড়িয়ে আমি কি লিখতে কৌশলের আশ্রয় নিতে গিয়ে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের সঙ্গে আপস করব? প্রশাসনের ব্যর্থতা আঙ্গুল তুলে দেখাব না? আপসকামী নির্জীব মানুষের মতো চুপ করে বসে থাকব। উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুজে পড়ে থাকব। কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের – ‘এই মৃত্যু উপাত্যকা আমার দেশ নয়’- কবিতার পংক্তিগুলো কি আমি চিৎকার করে উচ্চরণ করতে পারবনা? যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়/ আমি তাকে ঘৃণা করি/ যে ভাই এখনো নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে/ আমি তাকে ঘৃণা করি/ যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি/ প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায়না/ আমি তাকে ঘৃণা করি।
আমি কি তবে কৌশলী হতে গিয়ে যাত্রার কুশীলব হব? আমি কি ভাই হারা বোন ও সন্তান হারা মায়ের ক্রন্দন শুনতে পাবনা? আমি কি বেমালুম ভুলে যাব- জনারণ্যে পহেলা বৈশাখের অপরাহ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী লাঞ্ছনার লোমহর্ষক ঘটনা? ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিবাদ মিছিল থেকে চুলের মুঠি ধরে বুটের লাথি দেওয়া পুলিশের চেহারা আমি কি ভুলে যাব?
গণতন্ত্রের সংগ্রামে আমার মিছিল থেকে হারিয়েছিল সেলিম-দেলোয়ার, মতিহারের শাহজাহান সিরাজ। ঘুমোবার আগে কি তবে তাদের মুখোচ্ছবি মনে করতে নেই? ক্ষমতার দাম্ভিকতায় যারা হেঁটে যায়, সাধারণকে শাসায় কপালে তোলা লাল চোখে তাকায়, আমি কি তাদের দেখে মাথা নিচু করে সরে দাঁড়াব?
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর