হাওরাঞ্চলে”আভুরা সড়ক” দিয়ে সৌভাগ্যের চাকা ঘুরে ভাগ্যলী ফিরে আসবে ড. নিয়াজ পাশা

মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আঃ হামিদ গতকাল বুধবার (২৮.০৫.১৪) কিশোরগঞ্জের ইটনা , মিটামইন ও অষ্টগ্রামে নির্মাণাধীন তাঁর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ’আভুরা সড়ক, ভুরা বা ডুবা সড়ক’ সহ বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন। এ সময় যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রাষ্ট্রপতির সাথে ছিলেন। বিভিন্ন সময় তিনি তাঁর এ স্বপ্নের কথা প্রকাশ করেছেন। তাঁর স্বপটি হচ্ছে মরার আগে তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকা হতে ডাইরেক্ট বাসে চড়ে ঢাকা আসতে চান। এ জন্যে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। (দৈ. প্রথম আলো, ১৬ মে ২০১১)। স্বপ্নের এ বাস্তবায়ন দেখতেই তার এ সফর। তার উদ্যোগেই ইটনা মিটামইন, চামড়াঘাট ও কিশোরগঞ্জ হয়ে ঢাকা ’আভুরা সড়ক’ টি নির্মিত হচ্ছে। অপর সড়কটি হবে অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর হয়ে ঢাকা। এ উন্নয়ন কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে প্রাণ উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যাচ্ছে- হাওরে। এখানে উল্লেখ্য যে, ”আভুরা সড়ক” হচ্ছে হাওরে, বর্ষায় যে সড়ক ডুবে যাবে না। আর ’ডুবা সড়ক বা ভুরা সড়ক’ হচ্ছে যে সড়ক পানিতে তলিয়ে যাবে। আবার শুষ্ক মৌসুমে চলাচল উপযোগী থাকবে।

মহামাণ্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আঃ হামিদ এর নিবাচনী এলাকাটি হচ্ছে হাওরের নিচু/গভীর/তলা হিসাবে পরিচিত, যেখানে বছরের ছ’মাস থাকে পানির নিচে, বাকী ছ’মাস হচ্ছে শুস্ক মেীসুম। যেখান থেকে তিনি সাত বার এম.পি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ”বর্ষায় নাও আর শুস্কে/সুদিনে দু’পাও” অবস্থা হচ্ছে হাওরাঞ্চলে চলাচলের একমাত্র ব্যবস্থা। হাওরে বলতে গেলে নাই কোন পাকা রাস্তা। পায়ে হাটা মেঠো পথও যেখানে বিধ্বস্থ। ওখানে এমনও উপজেলা রয়েছে যেখানে এক কিলো মিটার পথও পাকা রাস্তা নাই। ইট নাই যেখানে তার নাম হচ্ছে-ইটনা। এ নাম থেকেই হাওরোঞ্চলের সার্বিক অবস্থা বোঝা যায়। তবে বর্তমানে উন্নয়নের হাওয়া হাওরেও লেগেছে।

যুগ যুগ ধরে হাওরবাসি উন্নয়ন কার্যক্রম হতে বঞ্চিত , উপেক্ষিত। তারপরও হাওরবাসি বিরূপ পরিবেশে সাহসী, সংগ্রামী ও স্বাধীনতার শক্তির ও প্রগতির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ। স্বাধীনতাত্তোর প্রত্যেকটি সাধারন নিবাৃচনে হাওরবাসি তার প্রমাণ রেখেছে। ফলস্রুতিতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্টিত বিপরীত শক্তির কাছ হতে পেয়েছে অবহেলা আর বঞ্চনা । ’ভাটির শার্দুল’ হিসাবে খ্যাত এডভোকেট আঃ হামিদ আর জননেতা মরহুম আঃ সামাদ আজাদের উদ্যোগে স্বাধীনতাত্তোর প্রতিষ্টিত ’হাওর উন্নয়ন বোড’ কিছু কর্যক্রমের শুরু করলেও পরবর্তিতে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আওয়ামীলীগের গত টার্মের সরকারের সময় হাওর উন্নয়ন বোর্ড পুনঃগঠন এবং হাওরের জন্য যুগান্তর সৃষ্টিকারি ” ডুবা সড়ক” নির্মাণ উন্নয়ন কার্যক্রমের শুভ সূচনা করেছিল। এ ’ডুবা সড়ক” নির্মিত হওয়ায় হাওরের অনেক অধিবাসি প্রথমবারের মতো বাস্তবে যান্ত্রিক যান বা রিকসা দর্শন করেছেন। এরফলে যোগাযোগ, ফসল রা ও পরিবহনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হযেছে। আর বর্তমানে এ সরকারের আরেকটা পদপে হচ্ছে হাওরে ’আভুরা সড়ক” নির্মাণ। আঃ হামিদ সাহেবের স্বপ্নের এ ’আভুরা ও ভুরা সড়ক’ কার্যক্রমেরও দ্রুত বাস্তবায়ন, বিস্তার ও সম্প্রসারণ দরকার। টেকসই স্থায়িত্বের জন্য নির্মাণ কাজের গুণগত মান অবশ্যই বজায় রাখতে হ্েব।

সায়র সম হাওরের টলটলায়মান ভরা বর্ষার পানি ভেদ করে, পানির উপর ভেসে বেড়ানো ’পানাস সাপে’র মতো ”আভুরা সড়ক” টিকে থাকবে। স্রোতের অনুকুলে, হাওরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর সমান্তরালে, উত্তর দণি মূখী এ সড়ক হবে পানির মাঝে, পানির সাথে সহবান্ধবসম। অনেকটা পানির অনুকুলে,স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ না করে নির্মিত হবে এ সড়ক। উন্নয়নের পূর্বসূত্র হচ্ছে বিদ্যূত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। হাওরের বুকে একে বেকে চলা এ ”ডুবা ও আভুরা’ সড়ক হবে হাওরাঞ্চলের উনন্নয়ন কার্যক্রমের শুভ সূচনার মেরুদন্ড ও রোডম্যাপ । আর গভীরভাবে খননকৃত নদীগুলো হবে দেহনালীর শিরা, উপ-শিরা সম।

”আভুরা সড়ক ”শুধু যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাবে এমনটা আমি মনে করি না। শুধু হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত স্বভাবিক কৃষি পণ্য ও মৎস্য সম্পদের সহজ পরিবহণই নিশ্চিত করবে না। এর ন্যায্য মূল্য ও টাটকা বাজারজাতও নিশ্চিত করবে। এ সড়ক হবে হাওরাঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রমের রোডম্যাপ। এ সড়ককে কেন্দ্র করে হাওরাঞ্চলের সার্বিক জীবন যাত্রার চিত্র বদলে যাবে। তাঁেদর আয়, রোজগার, জীবন ধারণ ও কর্মসংস্থান সব কিছুই বৃদ্ধি পাবে। লাঘব হবে অভাব, অনটন। আমরা সবাই জানি, হাওরাঞ্চলে এক একটা গ্রাম হচ্ছে দ্বীপসম। নতুন গ্রাম সৃজন সেখানে ব্যয় সাপ্যে ও অনেকটা দুরহ, কষ্টসাধ্য ব্যাপার। গ্রাম সৃজন যত না সহজ তারচেয়েও কঠিণ হাওরের উদাম, টর্পেডো ভীম, ভাসমান মাইন এর মতো শক্তিমান দৈত্যসম ঢেউ থেকে একে রা করা। এ জন্যে হাওরের ’ভিটে মাটি’ ঢাকার মাটি থেকেও দামী, মহা মূল্যবান। ফলে এ সড়ককে কেন্দ্র করে নতুন বসতি স্থাপনের হিড়িক পড়ে যাবে। এর দু’ধারে জন বসতি গড়ে উঠবে। এ জনবসতিকে কেন্দ্র করে এর দু’ধারে গড়ে উঠবে নতুন সবুজ তরতাজা ফলজ-বনজ বৃরাজি। সবচেয়ে বড় আয় বর্ধনকারি কার্যক্রম হবে এ সড়কের দু’ধারে গড়ে উঠা মৎস্য, ডেইরি- পোল্ট্রি খামার ও ফলজ বাগান সৃজন। মাছ চাষও করা যাবে। আমরা জানি, এক কেজি মাছের দাম, এক কেজি ধানের চেয়ে প্রায় দশ গুণ বেশী। ফল-মূলের দামও অনেক বেশী। আমার স্বপ্ন হচ্ছে, আল্লাহ’র অপার দান, হাওরের অব্যবহৃত এ মিঠা পানি হয়ে উঠবে সোনা উৎপাদনকারি, সোনার ডিম পারা হাঁস। পরশ পাথরসম ’সোনাজল’। বিরাট লাভজনক, বিশাল এ কর্মযজ্ঞকে কেন্দ্র করে বহুমূখী ও বিভিন্ন কর্মেেত্রর অপূর্ব ও অপার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

”আভুরা সড়ক ”নিমির্তি হলে সমগ্র হাওরাঞ্চলের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন সাধিত হবে। এক ফসলা অনেক জমি দু ফসলী বা তিন ফসলী জমিতে পরিণত হবে। শুধু ধান চাষের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিভিন্নমূখী ক্যাশ ক্রপের প্রসার ঘটবে। যা অত্যন্ত লাভজনক ফসল। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। নৌ র্দুঘটনা কমবে, আইন শৃংখলা রক্ষা সহজ হবে, এবং অফিস আদালত, শিা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা গড়ে উঠবে। শিার প্রসারের সাথে জীবন যাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটবে। গাছ পালা, বৃরাজি ও পশু পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এ সড়ক হাওরের অনেক লুপ্তপ্রায় প্রাণি, জৈব বৈচিত্রের আশ্রয়স্থলে পরিণত হবে। এ সড়কের মাধ্যমে হাওরে বিদ্যুত ব্যবস্থার সঞ্চালন সহজ হবে। সহজ নৌ ও সড়ক পথের ভাল যোগাযোগের জন্য হাওরে স্থাপিত হবে- ইপিজেড বা শিল্পাঞ্চল। সৌর বিদ্যূত উৎপাদন স্থাপনা প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে। ফলে শিল্প কারখানার প্রসার ঘটবে। এ সড়কের ফলে মৎস্য চাষ বা প্রাকৃতিক কারনে অনেক জলাধার ও উচু ভিটা ভূমির সৃষ্টি হবে। যা হতে শুস্ক মৌসুমে পানির অভাব অনেকটা নিবারণ করা যাবে এবং বর্ষায় আশ্রয় স্থল হিসাবে কাজ করবে। এ অভুরা সড়ক আমাদের ”টিপাইমুখ বাঁধ” এর আগ্রাসন হতেও রা করবে। এ সড়কের কারনে আরেকটা আকর্ষণীয় এবং লাভজনক ব্যবসার প্রসার ঘটবে। তা হচ্ছে পর্যটন ও নির্মল বিনোদনের।। সারা হাওর-ভাটি বাংলাই পর্যটনের লীলা ভূমিতে পরিণত হবে। হাওরে অতি চির পরিচিত বর্ষার ছ’মাস বেকার জীবনের চির অবসান ঘটবে কর্মচাঞ্চলের মাধ্যমে। বর্ষায় অভাবী, কর্মহীন বেকার হাওরবাসির অন্যত্র অভিকাসি হওয়া রোধ হয়ে বিপরীত ঘটনাই ওখানে ঘটবে। রঙ বেরঙের ডিঙ্গা/নৌকায় চড়ে সওদাগরগণ ব্যবসা বাণিজ্য, বিনোদনের জন্য বা কাজের জন্য বিপুল জনসমাগম ঘটবে। হাওরের ভূমি আর জল প্রকৃত অর্থেই সোনায় পরিণত হবে।

সাগরসম সায়র, হাওরের বুক চিড়ে ”আভুরা সড়ক” নির্মাণ সম্ভব কিনা প্রশ্ন উঠতে পারে। এর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে। উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশেই এ রকম পরিবেশে এ ধরণের সড়ক রয়েছে। চলন বিলের বুক চিড়ে ঢাকা রাজশাহী সড়কই এর বড় উদাহরণ। লাভ তির হিসাবে ”আভুরা সড়ক” হাওরবাসির জর্ন্য আর্শিবাদ হিসাবে বিবেচিত হবে। তারপরেও ”আভুরা সড়ক ”নির্মিত হলে কিছু অসুবিধারও সৃষ্টি হতে পারে। কোথাও পানির ও স্বভাবিক নৌ চলাচলে বিঘœ ঘটবে। কোথাও আবার জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে হাওরে বর্ষায় পানির উচ্চতা, স্ফীতি ও স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে স্বাভাবিক কৃষি ও মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে রোগ বালাই বৃদ্ধি পেতে পারে। মাছের স্বভাবিক চলাচল বাঁধাগ্রস্থ হযে মাইগ্রেশন ও প্রজনন কার্যক্রমে বিঘœ ঘটতে পারে। ” সোনাজল” হতে উৎপাদিত ”কাঁচা সোনা” প্রতিনিয়ত বৈরী প্রকৃতির সাথে সংগ্রামী হাওরবাসির জীবনকে স্থবির/ অলস করে দিতে পারে। জমিতে জলজ আগাছা বৃদ্ধি পাবে। জৈব বৈচিত্রের পরিবর্তনও ঘটতে পারে। পানির গুণা-গুণের পরিবর্তন হতে পারে। সতর্কতা হিসাবে নদী নালাগুলো গভীরভাবে খনন করে পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা সচল রাখতে পারলে এগুলো ওভারকাম করা যাবে। সড়কে পর্যাপ্ত পরিমাণে কালভার্ট, পুল থাকতে হবে। এগুলোর উপর সড়কের সফলতা নির্ভর করবে।

আগামী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ও খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করছে দেশের অব্যবহৃত উপকুলীয় দণিাঞ্চল এবং উত্তর পূবাঞ্চলে অবস্থিত হাওরাঞ্চলের সম্ভাবনার সৎ ব্যবহারের উপর। আগামী দিনের খাদ্য ভান্ডার হাওর এলাকা নিয়ে ভাবার সময় এসছে। হাওরাঞ্চলে বিনোয়োগ রিটার্ণ দেবে শত গুণে। ”আভুরা সড়ক” দিয়ে সৌভাগ্যের চাকা ঘুরে ভাগ্যলী হাওরে ফিরে আসবে এ আশা আমরা করতে পারি।

ড. নিয়াজ পাশা, কৃষি প্রকৌশলী, কৃষি সাংবাদিক ও হাওর ভূমিপুত্র। সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার, সার্ক কৃষি কেন্দ্র, ফার্ম গেট, ঢাকা-১২১৫।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর