মাছে-ভাতে বাঙালির সুস্বাদু মাছে ভরপুর বাংলাদেশ

মোঃ জাকির হোসাইন:কেবল ভু-প্রকৃতিগত বৈচিত্রের কারনে নয়, অর্থনৈ্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রকৃতিক সৌ্ন্দর্য্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও হাওর এক বিরাট স্হান জুড়ে আছে ।হাওর মুলতঃ সাগর শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। উচ্চারণ বিকৃতিতে সাগর থেকে সায়র এবং সায়র থেকে হাওর হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। বর্ষাকালে বিশাল হাওর এলাকায় অথৈ জলরাশি দেখলে সাগরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। হাওর আর কিছু নয়,এটা অপেক্ষাকৃত বড় জলাভূমি।

শীতকালে যে প্রান্তর ফসলে পূর্ণ বা শুকনো মাঠ কিংবা বালুচর, বর্ষাকালে সেখানে এমন জলধারা যে চারদিক প্লাবিত করতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। শুধু পানির প্রবাহ নয় প্রচন্ড ঢেঊ আর দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি সাগরের বিশালত্বের কথাই মনে করিয়ে দেয় ।দ্বীপের মত গ্রামগুলি যেন ভেসে থাকে জলের বুকে। বর্ষাকালে যে হাওরের পাগল করা ঢেউয়ের দোলায় তিন বৈঠার নৌকা পাল উড়িয়ে চলার সময় উল্টিয়ে পড়তে যায়,শুষ্ক মৌসুমে সেখানে পানি থাকেনা এক ফোঁটা,যতদূর চোখ যায় শুধু ধানের সবুজ শীষ বা সোনারঙা ধানের সুবিপুল সমারোহ ।কোন বছর অকাল বন্যা হলে আবার এই বোর ফসল নষ্ট হয়ে যায়।বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে কখনো মাছের অভাব হয়নি। কারণ বাংলাদেশের নদীগুলো ছিল নানারকম সুস্বাদু মাছে ভরপুর। বাংলাদেশের মানুষের আমিষের চাহিদার সিংহ ভাগ পূরণ হয় নানা রকমের মাছ থেকে। কিন্তু এখন নদীগুলোর সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে নানা রকমের ছোট বড় মাছ। আবাদী জমিতে ব্যাপক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি নদীর পানিতে ফেলা, পুকুর, জলাশয় সম্পূর্ণ সেচে ফেলা, জলাশয়ের যেখানে সেখানে বাঁধ দেওয়া ইত্যাদি কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো এখন বিলুপ্ত প্রায়। সিলেটের হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার, শনির হাওড়সহ বেশকিছু হাওড় ও নদী মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর এই জায়গাগুলোতে মাছ ডিম ছাড়ে এবং ভরা বর্ষায় পানির সাথে ডিমগুলো ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জলাশয়ে। সম্প্রতি মৎস অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেটের হাওড়গুলোতে ১০৭ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৭ প্রজাতির মাছই বিলুপ্ত এবং আরও কয়েক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত প্রায়। অথচ সিলেট অঞ্চলের এসব হাওড় মাছের জন্য প্রসিদ্ধ।

ক্রমবর্ধমান মাছের চাহিদা পূরণে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি দেশীয় মাছের প্রজাতির সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্থানীয় কোনো প্রজাতি সেই স্থানের ঐতিহ্য। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা দেশীয় মাছগুলো নানারকম স্বাদ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ। আমাদের দেশের নদী নালা খাল বিল পুকুর ভর্তি ছিল পাঙাস, রুই, কাতল, শোল, টাকি, পুঁটি, খলসা, বোয়াল, চিতল, গজার, আইড়, পাবদা, কই, টেংরা, কাইক্কা, মলা, চেলা, চাপিলা, চান্দা, বাইম, ভাটা, রাণী মাছের মতো নানা প্রজাতির মাছ। কিন্তু এসব মাছের অধিকাংশই এখন আর দেখা যায় না। কিছু মাছ যেমন পাঙাস, রুই, কাতল, আঁইড় বাজারে দেখা গেলেও তা চাষ করা। অন্যদিকে এই মাছগুলোর জায়গা দখল করে নিয়েছে উচ্চ প্রজননশীল(হাইব্রিড) চাষ করা মাছ। বাজারে এখন অধিকাংশ স্থানজুড়ে থাকে তেলাপিয়া, সিলভার কার্প, আফ্রিকান মাগুর, থাই কই ইত্যাদি চাষ করা মাছ। যেহেতু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এসব মাছ চাষ করা হচ্ছে তাই এসব মাছকে খাওয়ানো হচ্ছে লেদার ফেক্টরির বর্জ্য, পোল্ট্রির বর্জ্য ইত্যাদি দিয়ে তৈরি কৃত্রিম খাবার। দ্রুত বড় হওয়ার জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে হরমন এবং তারপর এসব মাছ বিক্রির সময় দ্রুত পচন ঠেকাতে মাছের গায়ে মাখানো হচ্ছে ফরমালিন। ফলে এসব চাষ করা মাছ একদিকে যেমন অস্বাস্থ্যকর তেমনি বিস্বাদ। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা আমাদের দেশীয় মাছ যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টি গুণে ভরপুর। কিন্তু হাইব্রিড পদ্ধতিতে চাষ করা মাছের ভিড়ে আমাদের দেশীয় মাছের প্রজাতি যেভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে- আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এসব সুস্বাদু মাছ খাওয়া তো দূরের কথা, হয়তো মাছের সুন্দর সুন্দর নামগুলোও শুনতে পারবে না। শুধু আমাদের সম্মিলিত কিছু সচেতন পদক্ষেপ রক্ষা করতে পারে এসব প্রজাতিগুলোকে। যেমন- ডিমওয়ালা মাছ ধরা, কেনা, খাওয়া বন্ধ করতে হবে। অসময়ে মাছের পোনা ধরা বন্ধ করতে হবে। সেচের মাধ্যমে মৎস নিধন বন্ধ করতে হবে। মাছের নির্বিঘ্নে বড় হওয়া ও প্রজননের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি জমিতে বিশেষ করে জলাশয়ের আশেপাশের জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। নদী, খাল, জলাশয় দখল আইনত অপরাধ হলেও তা ঘটছে আইন, প্রশাসন ও জনসাধারণের চোখের সামনেই।

ওয়াসার হিসাব মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ৪৭টি খাল ছিল। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা শহরের পরিধি বাড়লেও খালের সংখ্যা কমে নেমেছে ২৬টি তে। এই ২৬টি খালের মধ্যে অধিকাংশ খালই দখল দূষণে জর্জরিত। ঠিক একই দশা হয়েছে শহরের চারপাশের নদীগুলোর। নদী, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয়কে দখল দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। দেশীয় মাছের প্রজাতি শুধু আমাদের দেশের অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করে না আমাদের ঐতিহ্যকেও সমৃদ্ধ করে। তাই এদের সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর