স্কুল এখন শেফালিদেরও প্রিয়

আমরা কয়েকজন ময়মনসিংহ থেকে গফরগাঁও যাচ্ছিলাম। পথে দেখলাম মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। সত্যিই দৃশ্যটা খুবই আনন্দের। এ মেয়েদের হাত ধরেই তো ভবিষ্যতে গড়ে উঠবে অনেক আলোকিত পরিবার আর আলোকিত মানুষ। তবে পাশেই আরেকটা ছোটো মেয়েকে ছাগল চরাতে দেখে মনটা খারাপ হয় আমাদের। সে কেন স্কুলে যায় না? কৌতূহল হলো তার বিষয়ে জানার। গাড়ি থামিয়ে গেলাম তার কাছে। নাম জিজ্ঞেস করতেই জানালো তার নাম শেফালি। কিন্তু সে স্কুলে যায় না শুনে অবাক হই। স্কুলে যায় না কেন সে বিষয়ে প্রশ্ন করতেই বললো, তার বাবা নেই। মা মানুষের বাসায় কাজ করে। তার মা বলে স্কুলে গেলে ভাত জুটবে কীভাবে, বাড়ির কাজ কে করবে, সংসারে যে করুণ অবস্থা! ছোটো মেয়েটা যে বয়সে পড়ালেখা করার কথা, সে বয়সে সে থালাবাসন ধোয়, ছাগল চরায়, চুলা জ্বালায়।

বিষয়টা সত্যিই পীড়াদায়ক। আমরা ছোটো মেয়েটাকে বোঝালাম, সে যদি বিদ্যালয়ে যায় তাহলে টাকা পাবে, খাবার পাবে এবং অনেকগুলো স›ুদর সুন্দর ছবিতে পূর্ণ বইও পাবে। তার মা যেন কাছের শিক্ষা অফিসে গিয়ে খোঁজ নেয়। শুনে সে খুশি হলো, মনে আশা জাগালো। সে প্রতিশ্রুতিও দিল, মাকে ঘরে ফিরে বলবে তাকে যেন পড়ার সুযোগ করে দেয়। স্কুল তার প্রিয় একটি জায়গা।

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার পূরণে দরিদ্র সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য সরকার নানা সহায়তা দিচ্ছে। শেফালির মতো অনেকেই এসব সহায়তা সম্পর্কে অবগত নয়। এটা যেমন অনেক শিশুর ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে তেমনি সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত ফল লাভে বাধার সৃষ্টি করছে। আমাদের সকলেরই উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা।

যেসব পরিবার সন্তানদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে উপার্জনের জন্য অথবা মা-বাবার কাজে সহায়তার জন্য স্কুলে পাঠান না অথবা প্রাথমিক শিক্ষার পাঁচ বছর মেয়াদি চক্র শেষ করান না তাদের জন্য বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র শিশুদের মাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এতে সরকারের ব্যয় হবে তিন হাজার ৬৭ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ৩০ লক্ষ শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। একই পরিবারের একাধিক সন্তান থাকলে দেওয়া হবে ২৫০ টাকা করে। ২০০২ সাল থেকে এ উপবৃত্তি চালু হয়েছে।

বইয়ের প্রতি শিশুদের আকৃষ্ট করতে বর্তমানে চার রঙের নতুন বই সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে সকল শ্রেণিতে শতভাগ নতুন বই প্রদান করা হচ্ছে। প্রতি বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যপুস্তক উৎসব আয়োজন করে সারাদেশে ২ কোটিরও অধিক শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় উচ্চ মাধ্যমিক উপবৃত্তি প্রকল্পের আওতায় ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ১৫২ কোটি ৯৭ লক্ষ ৩৯ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিমাসে একজন ছাত্রীকে ৩০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।

স্কুল বহির্ভূত, ঝরে পড়া এবং শহরের কর্মজীবী শিশুদের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশের সুবিধাবঞ্চিত এবং ঝরে পড়া দরিদ্র শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে দেশের নির্বাচিত ১৪৮টি উপজেলায় ১১৪০.২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে “রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (জঙঝঈ) (২য় পর্যায়)’’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ২১,৩৬১টি শিখন কেন্দ্রের মাধ্যমে ৭০. ১৫ লক্ষ শিশু পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে শিশুদেরকে ১ম থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত মাথাপিছু ৮০ টাকা হারে এবং ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত মাথাপিছু ১০০ টাকা হারে শিক্ষা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ১ম থেকে ৩য় শ্রেণি এবং ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শিক্ষা উপকরণ বাবদ প্রতিবছর যথাক্রমে ২০০ টাকা এবং ৩০০ টাকা হারে আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে।

শিশুদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় দরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের শিক্ষা লাভের সহায়তা হিসেবে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছর থেকে উপবৃত্তি কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরে ৬০০, উচ্চ মাধ্যমিকে ৭০০ এবং উচ্চতর স্তরে ১২০০ টাকা হিসেবে ৪১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা প্রদান করা হচ্ছে।

অর্থের অভাবে আমাদের দেশে এখন অনেক দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদেরও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ২০১২ এর আওতায় প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টে সিডমানি হিসেবে প্রাপ্ত ১০০০ কোটি টাকার এফডিআর ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন উপবৃত্তি প্রদান সংক্রান্ত ৫টি প্রকল্পের মেয়াদ শেষে তা প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের অর্থায়নে পরিচালিত হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম সুশিক্ষিত, আত্মপ্রত্যয়ী ও বিজ্ঞানমনস্ক জনগোষ্ঠী তৈরি করতে বর্তমান সরকার শিক্ষাখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। ফলে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সুযোগ বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।

সরকারের একার পক্ষে এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা সহায়তা নিশ্চিত করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ কার্যক্রমে বেসরকারি সংস্থা ও সমাজের বিত্তশালীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ইতোমধ্যে অনেকে সরকারের সাথে এ কাজে অংশীদার হয়েছে, তবে আরও অংশগ্রহণ প্রয়োজন, কারণ যেতে হবে বহুদূর ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর