শেখ হাসিনা যা জানতেন, খালেদা জিয়া তা জানতেন না

পীর হাবিবুর রহমান।।

সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা জানতেন তৎকালীন বিরেধীদলের নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জানতেন না। শেখ হাসিনা জানতেন তিনি গণভবনে নৈশ্যভোজে খালেদা জিয়াকে দাওয়াত করলেও তিনি যাবেন না। তাই সেইদিন গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে বসা নেতাদের অনেকে চুপ খাকলেও তোফায়েল আহমেদ এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন, বিএনপির নেত্রী বৈঠকে চলে আসলে তিনি কিছু আদায় করে নিয়ে যাবেন। একই সঙ্গে পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলেই যাবে। কিন্তু সেদিন খালেদা জিয়া বুঝেন নি। ঐ বৈঠকে গেলেই তার নির্বাচনে আসার পথ খুলে যেত। ঐ বৈঠকে গেলেই নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের রদবদল যেমন ঘটাতে পারতেন; তেমনি ভোটযুদ্ধে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সম্মানজনক আসন নিয়ে বিরোধীদলের নেতার পদটি লাভ করতেন।

peer-habibবিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার পরিকল্পনা বহু আগের ছিলো। গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত রিপোর্ট নির্বাচনের ৩ বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছিলো সেটি ততই দৃশ্যমান হচ্ছিল। নির্বাচনের সময় বিএনপি সেই ফাঁদেই পা দিয়ে নিজেদের বাইরে রেখে সরকারের ইচ্ছে পূরণ করেছিল। সরকারি দল ও বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে আলাপকরে জানা যায়, বিএনপির অভ্যন্তরে একটি শক্তি শুরু থেকেই বেগম খালেদা জিয়াকে বিভ্রান্ত পথে নিয়ে যাচ্ছে এবং তার খেসারত এখন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে দল ও তার নেতাকর্মীকে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বেগম খালেদা জিয়াকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং খালেদা জিয়ার তীর্যক বক্তব্য হজম করেছেন। এমনকি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্তবর্তীকালীন সরকারে বিএনপির কয়েকজনকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হবে। বিএনপির অভ্যন্তরে শক্তিশালী একটি শক্তি যেতে দেয়নি। এই শক্তি খালেদা জিয়াকে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর ঢাকা সফরকালে সৌজন্য সাক্ষাতে যেতে তো দেয়ই নি, উল্টো শিবিরের হরতালের দোহাই দিয়ে বৈঠকের বিষয়টি বাতিল করেছিল। বিএনপি এতটাই বিভ্রান্ত হয়েছিল, দলের নেতাদের কোনো মতামতই গুরুত্ব দেয়া হয়নি। একদিকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে সাড়া দেয়নি, আবার সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসার প্রস্তাব দিয়ে নানা জায়গায় দৌঁড়ঝাপ করেছে। সরকার যখন নির্বাচন সম্পন্ন করতে যাচ্ছে, বিএনপির তখনো ঘুম ভাঙেনি। তারা তারানকোকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল।

বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা যেভাবে ব্যালট বিপ্লবে বিশাল ভোট নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, তাতে নেতাকর্মীরা শুধু সংগঠিতই হননি জনমতও বিএনপির অনুকূলে ছিল। সরকারি দলেরও অনেকে মনে করেন, সেই ভোটযুদ্ধে বিএনপি অংশ নিলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এমন আলাপ আলোচনা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের প্রথম দিন আগত বিভিন্ন নেতাদের মধ্যে উঠলে বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীও এই মত দেন।

ভোটযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ না নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক দল ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরও ভোট বর্জন ও প্রতিরোধের সহিংস কর্মসূচীতে জামায়াতকে নিয়ে গিয়ে বিএনপি যে ফাঁদে পরেছিল, সেটিকে এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক বছর পর হঠাৎ করে নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই আরেক দফা ৩ মাসের হরতাল, লাগাতর অবরোধ, জ্বালাও, পোড়াও, পেট্রোলবোমার কর্মসূচীতে গিয়ে সেই ফাঁদকে আরো গভীরে নিয়ে যায়। এতে করে বিএনপির নেতাকর্মীরা এত মামলা, কারাদহন ও পলাতক জীবনের বিপর্যয়ে পরেন যে কার্যত বিএনপির কোমড় ভেঙ্গে যায়। সরকার বিরোধী জনমত থাকার পরও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত আর দল নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। সরকারও সেই সুযোগটা নিয়ে বিএনপিকে দমন নীতিতে ফেলে ঘরোয়া রাজনীতিতে ঠেলে দিয়েছে।

সরকার, বিরোধী দল ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন, দলের অভ্যন্তরে থাকা শক্তিশালী অংশটি খালেদা জিয়া এবং বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারাই দলকে হটকারী, বিভ্রান্ত রাজনৈতিক পথে টেনে নিয়েছে। আর তার চরম মাসুল দিচ্ছেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। চড়া মূল্য দিচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যখন ক্ষমতার ছায়ায় থেকে উৎসব ও দাম্ভিকতা নিয়ে দলের রাজনীতি করছেন, সেখানে বিএনপিকে দুর্বল অসহায় চেহারা নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। এখন বিএনপি শেখ হাসিনার অন্তবর্তী সরকারের অধীনেই নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের রদবদল ঘটিয়ে নির্বাচন চায়।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, রাজনীতিতে উত্থান, পতন, কঠিন পরিস্থিতি বিএনপির জন্য ওয়ান-ইলেভেন থেকেই এসেছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক জীবনেও শুধু উত্থানই আসে নাই। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কঠনি বিপর্যয় আর সংকট অতিক্রম করেছে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে। ওয়ান ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগই পায়নি, সিটি নির্বাচনে অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করে জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে লড়বার সুযোগ পেয়েছিল। এতে পরাজিত হলেও রাজনীতিতে মর্যাদাকর শক্তিশালী আসনেই থাকতো।

কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও আন্তজার্তিকভাবে শেখ হাসিনা বিনা প্রতিদ্বন্ধিতা, ভোটারবিহীন, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন সংবিধানের দোহাই দিয়ে পার করলেও এখন কার্যত দেশে বিদেশে সবাই তা কবুল করেছেন এবং সরকার মেয়াদ শেষে নির্বাচন দেয়ার কথা বলছেন। সবমিলিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে যে সুসময় অতিক্রম করছে তা দলের রাজনৈতিক ইতিহাসে কখনো আসেনি। শেখ হাসিনার বৃহস্পতিও এখন তুঙ্গে। বিশ্বের প্রভাবশালী নেতাদের সারিতে তার জায়গা। ভারতই নয়, চীন, রাশিয়াও বন্ধু শক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও দিয়ে গেছেন স্বীকৃতি।

সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সম্মেলনে বিএনপি দাওয়াত পেয়ে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ মুহুর্তে গণতন্ত্রহীন পরিবেশ, তাদের প্রতি সরকারের আচরণের দোহায় দিয়ে আর যায়নি। এটিও দলের অভ্যন্তরে সেই শক্তি নাকচ করিয়েছে। এই সম্মেলনে না গিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কিন্ত গেলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক জায়গায় থাকতো। যেমন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃ্ত্বকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা যা জানেন, খালেদা জিয়া তা বুঝতে পারেন না। খালেদা জিয়া একের পর এক দলের একটি শক্তির কারণে ফাঁদে পা দেন আর রাজনৈতিক লোকসান গুনেন। শেখ হাসিনা জানেন খালেদা জিয়া ফাঁদে পড়েছেন, কিন্তু বিএনপি নেত্রী তা বুঝেন না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর