শারদীয় দুর্গোৎসব : উৎসব সবার

দুর্গাপূজা ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ব বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। দুর্গাপূজার প্রধান আবেদন হলো দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। অর্থাৎ সকল অশুভ শক্তি নির্মূল করার জন্যই পৃথিবীতে প্রতিবছর দুই বার দেবী দুর্গার আগমন হয়। প্রাচীনকাল থেকেই বছরের চৈত্র মাসে বসন্তকালে বাসন্তী নামে পৃথিবীতে মা দুর্গা আবির্ভূত হন যা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসন্তীপূজা হিসাবে পরিচিত। রাক্ষস রাজা রাবণ রামচন্দ্রকে যুদ্ধে পরাভূত করার জন্য কৌশল হিসেবে তার সহধর্মিণী সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যায়। রামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধারের জন্য শরৎকালে অকাল বোধনের মাধ্যমে মা দুর্গাকে আবাহন করেন। তখন থেকেই শরৎকালে এই শারদীয় পূজার প্রচলন শুরু হয়। ভক্তরা বাসন্তী মায়ের আরাধনা করেন সকলের প্রাণীর দুঃখ- দৈনতা, অভাব-অনটন, সকল রোগ মুক্তি, অন্যায় অবিচার, অত্যাচার দূর করে, মানুষের তথা দেশের সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তিময় জীবনের আশায়। শারদীয় উৎসবের উদ্দেশ্য একই তবে বাসন্তীপূজার তুলনায় শারদীয় সার্বজনীনতা ও উৎসবের ব্যাপকতা অনেক বেশি। শরতের শিশিরভেজা শিউলি-শেফালি ফুলের গন্ধ, কাশফুলের শুভ্রতা, আকাশজুড়ে শরতের সাদা মেঘ সবাই যেন মা দুর্গার আগমনবার্তা নিয়ে আসে ভক্তদের মধ্যে। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় দেবীকে বরণ করে নেয়ার আয়োজন। ইতিহাসে কথিত আছে প্রায় দুই শত বছর আগে রাজশাহীর রাজা কংস নারায়ণ প্রথম শরৎকালে দুর্গোৎসব শুরু করেছিলেন। অতীতে রাজা-জমিদাররাই এ পূজা করে থাকতেন। মাসব্যাপী এ উৎসবের আমেজ ঐ অঞ্চলের সকল জনগণ উপভোগ করতেন। যেহেতু দুর্গাপূজা, উৎসবের আঙ্গিকে একটি ব্যয়বহুল পূজা, সেহেতু প্রথমে শুধু রাজা ও জমিদাররাই এই আয়োজন করতেন। দুর্গাপূজা পরবর্তী পর্যায়ে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে সর্বজনীন পূজা হিসেবে প্রচলিত হয়। আজ দুর্গাপূজার সর্বজনীনতা সকালের কাছে ব্যাপক ভাবে সমাদৃত এবং জনপ্রিয়। তাই শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার প্রায় দুই মাস আগে থেকে পূজার প্রস্তুতি চলে বিভিন্ন মন্দির, আশ্রম, সংগঠন, শহরে বন্দরে, উপজেলা ও জেলা শহরে। বিশেষ করে বিভিন্ন সংগঠনগুলো মা দুর্গা তার সন্তান লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক এবং স্বামী ভগবান মহেশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে মর্ত্যে আগমন করেন। অসুর শক্তিকে নিধনের প্রতীকী মূর্তিতে আমরা মা দুর্গাকে মহিষাসুর বধ করার দৃশ্যে দেখতে পাই। কে কত সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এই নিয়ে বিভিন্ন পূজামণ্ডপের আয়োজকদের মধ্যে শুরু হয় তুমুল প্রতিযোগিতা। প্রতিমার মৃৎশিল্পীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা শুরু হয় কে কত সুন্দর ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করে আয়োজকদের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পারে। ধর্মীয়ভাবে প্রচলিত আছে যে মা দুর্গা এ সময় তার স্বামী সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়িতে আসেন, তাতে ব্যাপক আয়োজন হবে বৈকি! বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পূজা বেড়েই চলছে। স্বাধীনতার পর সারা বাংলাদেশের পূজার সংখ্যা ছিল চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পূজার সংখ্যা ব্যাপক ভাবে বেড়ে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছর দেশব্যাপী প্রায় ঊনত্রিশ হাজার পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পূজার সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ হলো স্বাধীনতায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মূল্যবোধগুলোর অন্যতম হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে একে একে পবিত্র সংবিধান থেকে মুছে ফেলতে পরবর্তী সরকারগুলো নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে অন্য চিন্তায় অর্থাৎ পাকিস্তানি ভাব ধারায় দেশ পরিচালনা করা হয় দীর্ঘ একুশ বছর। বর্তমান সরকার ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতার অন্যতম মূল্যবোধ ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করে দেশ পরিচালনা করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারলো না। তারপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে বিজয়ী হওয়ার পর থেকে সাত বছর যাবৎ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার পরিচালনার মাধ্যমে স্বাধীনতার মূল্যবোধগুলোকে ধারণ করে দেশ পরিচালনায় এক যুগান্তকারী উন্নয়নের ভূমিকা রাখছে বলেই সকল ধর্মের মানুষ নির্বিঘেœ ও স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করে যাচ্ছে, আর তারই সঙ্গে বেড়ে চলছে পূজার সংখ্যা। আরেকটি বড় কারণ হলো ধর্ম যার যার রাষ্ট্র আমাদের সবার, এটাকে মূল ভিত্তি হিসেবে ধারণ করে আজ জনপ্রিয় সেøাগান হলো ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। এই সেøাগান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশ্বাসের সঙ্গে বলেন বলেই আজ এ স্লোগান সর্বমহল এমনকি রাজনীতিবিদদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করছে। মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী হিসেবে প্রতি বছর ভক্তবৃন্দের সামনে আবির্ভূত হন। তিনি দশভুজা হিসেবেও পরিচিত। তিনি দশ হাতে সকল অপশক্তি থেকে মানুষকে মুক্তি দেবেন এবং মানব কল্যাণে আমাদের সকল ধরনের অগ্রযাত্রা প্রতিষ্ঠা হবে- এই কামনা ও বাসনা নিয়েই এই বছর মাকে বরণ করে নেবে দেশের সব ভক্ত। পঞ্জিকামতে এ বছর মা দুর্গা ঘোটকে চড়ে পৃথিবীতে আসবেন এবং ঘোটকে চড়েই স্বর্গলোকে ফিরে যাবেন। মা দুর্গার পৃথিবীতে ঘোটকে চড়ে আসা শুভ নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা। তাই মার কাছে সব ভক্তের বিশেষ প্রার্থনা সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশের মানুষদের যেন রক্ষা করেন। মা দুর্গার চরণে আরো প্রার্থনা সন্ত্রাসবাদ- জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করে বাংলাদেশ যেন ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী, সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে পরিচিতি লাভ করে। ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যবিত্তের বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে স্থান করে নিয়ে ২০৪১ সালে যেন বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন হবে। যত বাধা বিপত্তি আসুক, মা দুর্গা অবশ্যই ভক্তদের প্রার্থনা শুনবেন।
লেখক : সাংবাদিক ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক প্রেস মিনিস্টার।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর