মাশরাফির বলা দুই-তিনটা কথা

সময়টা, প্রায় ৪ বছর আগে হওয়ার কথা। তখন চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টে কাজ করতাম। বরাবরই, প্রচুর কফি খাই, ফাঁক পেলেই কফি কর্নারে একটু সময় কাটিয়ে আসি। একদিন কফিতে চুমুক দিচ্ছি, সাথে আমার কলিগ, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুম, হঠাৎ দেখি, মাসুম অনেকটা চিৎকার করে বলে উঠলেন, স্যার, দেখেন দেখেন, মাশরাফি! তাকিয়ে দেখি, উনি উনার স্ত্রীকে নিয়ে বসে আছেন আমাদের একটু দূরেরাখা চেয়ারগুলোর একটিতে। সেসময় উনি কী কারণে যেন টিমের বাইরে ছিলেন। উনাকে আগে থেকে খুব ভালোবাসতাম। উনার পেশাদারিত্ব, সত্য কথাটি সরাসরি বলার সাহস, সরলতা, কাজের প্রতি অসীম ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করতো। আমি কাছে গিয়ে হ্যান্ডশেক করলাম। এমন সহজভাবে অতো বড় একজন মানুষ আমার সাথে কথা বলবেন, সেটাই ভাবতে পারিনি। উনি বয়সে আমার ঠিক এক বছর ২৮ দিনের বড়। মাসুম উনাকে জিজ্ঞেস করলেন, “মাশরাফি ভাই, আপনাকে আবার কবে মাঠে দেখবো?” উনি বলেছিলেন, “আসলে আমার কিছু সমস্যা আছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলেই আমি আবারও খেলতে পারবো।” আমাকে দেখিয়ে মাসুম বললেন, “উনি আমাদের এয়ারপোর্টের এসি স্যার, আপনার ভক্ত।” আমাকে জড়িয়ে ধরে উনি বলেছিলেন, “আপনি তো অনেক ব্যস্ত মানুষ, আমি আপনার সময় নষ্ট করছি নাতো?” আমি বুঝতে পারছিলাম না, মাশরাফি এমন প্রশ্ন করলে উত্তরে কী বলতে হয়। বড় মানুষের সামনে গেলে আমি তেমন কোনো কথা বলতে পারি না—চুপচাপ উনাকে দেখি, উনার কথা শুনি। উনি কক্সবাজার যাবেন, আমাকে একটা গাড়ি ঠিক করে দিতে অনুরোধ করলেন। উনার জন্য একটা গাড়ি এয়ারপোর্টে থাকার কথা, সেটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো বোধহয়। আমি যে সরকারি মাইক্রোটা ব্যবহার করতাম, সেটাকেই তেলের খরচ দিয়ে উনার সাথে পাঠিয়ে দিলাম। মাশরাফির সেদিনের অমন সহজ ব্যবহারের রেশ এখনো আমার মাথায় আছে, কোনোদিনই সে রেশ মুছে যাবে না। জীবনে যে কয়েকবার কারো সাথে কথা বলে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি, সেদিনেরটা ছিল সেগুলোর মধ্যে একটি।

আমার একটা সমস্যা আছে। যাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করি, কোনোভাবে তার সামনে পড়লে, আমি ঠিকমতো কথাই বলতে পারি না, উনার সাথে সেলফি নেয়া কিংবা অটোগ্রাফ নেয়া তো অনেক পরের কথা! সেদিনও নিইনি, কিছুই না, না সেলফি, না অটোগ্রাফ—শুধুই একরাশ মুগ্ধতা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। মাসুম সেলফি, অটোগ্রাফ নিচ্ছিলেন, আমি শুধুই তাকিয়েছিলাম। তবু, মাশরাফি আমার হৃদয়ে আছেন, থাকবেন। অমন সহজ মানুষ দেখলেই কী যে ভীষণ ভাল লাগে! চোখের অমন শান্তি সবার ক্ষেত্রে আসে না।

প্রিয় মানুষ, শুভ জন্মদিন। এভাবেই বেঁচে থাকুন আমাদের হৃদয়ে। আর, প্লিজ প্লিজ প্লিজ, একটু নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন।

উনার কিছু কথা শেয়ার করলাম, যেগুলো আমার ভাল লাগে:

# আমি কখনোই আমার জীবনে কোনোকিছুর জন্য পরিকল্পনা করিনি—পরীক্ষার জন্যও না, অথবা কোনো অনুষ্ঠানের কাপড় কেনার জন্যও না। আমি সবসময়, শেষ মুহূর্তে যেটি সঠিক বলে মনে হয়েছে, সেটি করেছি। তাই, যখন আমি দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পেলাম, তখন আমি সবসময় যেটি করতাম, সেটিই করেছি। আমি সাফল্য, ব্যর্থতা, ভবিষ্যৎ অথবা অতীতের জন্য কখনোই চিন্তা করিনি। এগুলো নিয়ে আমি কখনোই ভাবিনি। (আমি নিজেও, এ দর্শনটা হুবহু মেনে চলি।)

# আজ কিছু কথা পরিষ্কার করে বলি। আমরা সবাইকে বিনোদন দেই। আমরা প্রকৃত অর্থে বীর নই। আমাদের সত্যিকার বীর হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। আমরা দেশের জন্য কোনো কিছু বিসর্জন দিইনি, মুক্তিযোদ্ধারা দিয়েছেন। আমাকে ভুল বুঝবেন না—ক্রিকেট কিন্তু জীবনের সবকিছু নয়। আমরা শুধুমাত্র চেষ্টা করি আমাদের দেশের মানুষকে খুশি করতে। (এমন অকপট কথা বলতেও অনেক সৎসাহস লাগে।)

# আমি বলি, এই যারা ক্রিকেটে, দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি একদিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটা দিন রাস্তায় থুতু না ফেলত বা একটা দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই এনার্জি, ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটা দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো। (আপনি এতো সুন্দর করে ভাবতে পারেন, আমরা পারি না, তাইতো, সহজ কাজটাই করার জন্য বেছে নিই—নিজেরা নোংরা থাকা, চারপাশটাকে নোংরা রাখা।)

এই পোস্টটা লেখার সময় যে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাটা কাজ করেছে, তার খোঁজ আপনি কোনোদিনই পাবেন না, তবে জেনে রাখবেন, আপনি যখন মাঠে নামেন, তখন আমরা আপনার দিকে তাকিয়ে থাকি—শুধু একজন খেলোয়াড় মাশরাফির দিকে নয়, একজন ভালোমানুষ মাশরাফির দিকেও—পরম মমতায় আর নির্ভরতায়।
ভাল থাকবেন। অনেক ভালোবাসি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর