পেয়ারা দামে চাষীর মুখে হাসি

মাঘ-ফাল্গুনে বর্ষা হয়নি বলে এবার পেয়ারা ফলন কম। অপরদিকে জৈষ্ঠ্য মাস থেকে প্রচুর বৃষ্টি হওয়াতে ছত্রাকজনিত ছিটপড়া রোগের (এনথ্রাক্সনোজ) আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে গড় ফলন কমেছে ৭ ভাগ। ফলন কমলেও বাজার দর দ্বিগুণের বেশি থাকায় চাষীরা খুশি।

একর প্রতি খরচের আড়াই থেকে তিনগুণ আয় হচ্ছে বলে দেনা শোধ করে এবার লাভের মুখ দেখতে পাবেন বলে জানান আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়নের পেয়ারা-আমড়া চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি নিত্যানন্দ সমদ্দার।

আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক তুষার কান্তি সমদ্দার জানান, কৃষকদের যে কোন সমস্যার সমাধানে মাঠ পর্যায়ের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের পাশে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় থেকে দেওয়া তথ্য অনুয়ায়ী, এ বছর পেয়ারার আবাদ প্রতি হেক্টরে ফলন ৮ মেট্রিক টন হিসেবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে ঝালকাঠীতে সাড়ে ৭ হাজার মে.টন, পটুয়াখালীতে ৭ হাজার ৩৫০ মে.টন, পিরোজপুরে ৬ হাজার ৮৯৪ মে.টন, বরিশালে ২ হাজার ১৩৫ মে.টন, ভোলায় এক হাজার ৯৯ মে.টন ও বরগুনাতে ৫৬০ মে.টন। সব মিলিয়ে ৬ জেলায় ২৫ হাজার ৫৩৮ মে.টন।

তবে শুরুতে অনাবৃষ্টিতে ফুল ঝড়ে যাওয়ায় ও ছিট পড়া রোগের প্রাদুর্ভাবে আবাদ হওয়া ২৮,৯৪ হেক্টর জমির মধ্যে ১৫৫ হেক্টরের ফলন ব্যাহত হয়েছে।

উৎপাদনের দিক থেকে এই হিসেব ৭ দশমিক ১ ভাগ বলে জানান অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়ের তথ্যদাতা উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শিউলী রাণী।

এ হিসেবে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ হাজার ৬২৬ মে.টন ফলন কম হবে। পাওয়া যাবে ২১ হাজার ৯১২ মে.টন বা ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৮০০ মণ পেয়ারা।

বরিশাল অঞ্চলে সর্বাধিক পেয়ারা উৎপাদন হয় স্বরূপকাঠি উপজেলাতে। এখানের কুড়িয়ানা গ্রামের পেয়ারা চাষী সুধীর মণ্ডল জানান, জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ থেকে ১০ আষাঢ় প্রথম ফলন পাওয়া যায়। প্রথম ভাগের পেয়ারা ২০ আষাঢ় পর্যন্ত হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি করতে পারেন। আর পুরো শ্রাবণ মাস জুড়ে ভড়া মৌসুম থাকায় তখন পেয়ারার দাম কমে গিয়ে কখনোবা মণ ৬০ টাকায় নেমে আসে। ওরপর ফলন কমে আসায় ফের পহেলা ভাদ্র থেকে পরবর্তী ২০ দিন প্রতি মণ পেয়ারা হাজার টাকা বা তারও বেশিতে বিক্রি করা যায়। ভড়া মৌসূমে ঢাকা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, হাইমচর, ফেনি থেকে ৩০ থেকে ৪০টি ট্রাক আসে আটঘর-কুড়িয়ানা বাজারে পেয়ারা কেনার জন্য।

এই চাষী আরও জানান, এবার ফুল আসার সময় বৃষ্টি হয়নি তাই ফলন কম হয়েছে। আবার গাছে পেয়ারা থাকা অবস্থায় জ্যৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় ছিটপড়া রোগ দেখা দিয়েছিল। তবে শুরুতেই কৃষি বিভাগ থেকে উপযুক্ত পরামর্শ পাওয়া গেলে এই রোগ সহজে নির্মূল করা যেত বলে মত প্রকাশ করেন এই চাষী।

চাষীদের এই অভিযোগের বিষয়ে স্বরূপকাঠি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রিফাত সিকদার জানান, তাদের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে থেকে চাষীদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। প্রথম দিকে ছিটপড়া রোগের বেশ প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও চাষীরা ছত্রাক দমনে সময়মত নইনটার্স, নিউভেন নামক ওষুধ ব্যবহার করায় বড় ধরণের ফলনহানি থেকে রক্ষা পেয়েছেন। এবারে তার উপজেলায় ছিট পড়া রোগে ৬শ’ ৫২ হেক্টর বাগানের মধ্যে ৩৫ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া আগামরা রোগও দেখা দিয়েছিল, তবে তা সামান্য। ধানের পরই পেয়ারা এই উপজেলার চাষীদের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল হওয়াতে বালাই রোধে কৃষি বিভাগ থেকে চাষীদের পরামর্শ, লিফলেট বিতরণ এবং প্রশিক্ষণ দেয়া হয় রীতিমতো।

আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়নের পেয়ারা-আমড়া চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি নিত্যানন্দ সমদ্দার জানান, এই এলাকায় পৌঁনে দু’শ’ বছর ধরে পেয়ারা আবাদ হচ্ছে। এখানের ৯৫ ভাগ চাষী পেয়ারা চাষের সঙ্গে জড়িত। নিচে ২০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৫ একরের বাগান রয়েছে। হার হিসেবে বড় বাগানের সংখ্যা হবে ৪০ ভাগ।

তিনি জানান, অনেক চাষী আছেন যারা মালিকের কাছ থেকে বাগান কিনে থাকেন। তার হিসেবে এক একর পেয়ারা বাগান পরিচর্যা বাবদ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। তাদের এলাকায় এবার ২০ ভাগ ফলন কম হলেও একর প্রতি ফলন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারছেন। দেনা শোধ করে লাভের মুখ দেখতে পারছেন চাষীরা।

আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক তুষার কান্তি সমদ্দার জানান, সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে পেয়ারা চাষীদের ন্যয্য মূল্য ও বাজারজাতের জন্য শস্য বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে সেল সেন্টার গড়ে তোলার। এখানে কৃষকদের সংগঠন থাকবে। এই সেন্টারে ফলন নিয়ে এসে গ্রেডিং করে প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে চাহিদার বাজারে পাঠাতে পারবেন।

বরিশাল অঞ্চলে পেয়ারা উৎপাদন টাকা অংকে হিসেব উল্লেখ করতে গিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, এ বছর ২১ হাজার ৯১২ মে.টন বা ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৮০০ মণ পেয়ারা উৎপাদন হবে। পেয়ারার চলমান ভড়া মৌুমে মণ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা দরে। শুরু আর শেষের দিকে এই দর হাজার টাকা ওঠে। উৎপাদন অনুসারে বিক্রির গড় হিসেবে সাড়ে ৩০০ টাকা মণ ধরলে মৌসুমে প্রায় ২০ কোটি টাকা আসে পেয়ারা থেকে। যার খুচরা বাজার মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ কোটি টাকার অধিক। তাই উৎপাদন বাড়াতে তারা স্থানীয় জাতের পাশাপাশি উচ্চ ফলনশীল জাতের পেয়ারা চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন চাষীদের।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর