ছয় দফা : স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা তোফায়েল আহমেদ

আজ ঐতিহাসিক ৭ জুন। ১৯৬৬-এর এই দিনে বাংলার গণমানুষ স্বাধিকার ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী হরতাল পালন করেছিল। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান এ দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতিকে গোলামির শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত করার জন্য যে ষড়যন্ত্র করেছিল, তার বিপরীতে বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ‘৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের এক কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্দনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি সংবলিত বাঙালির ‘ম্যাগনাকার্টা’ খ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা দাবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ও ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে ছয় দফা অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ছয় দফা দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ছয় দফা প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট উপ-কমিটি গঠন করা হয় এবং তারই নামে পুস্তিকাটি মুদ্রিত হয়। একই বছরের মার্চের ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এদিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। ছয় দফা কর্মসূচি দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে আমাদের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ছয় দফা এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বাংলার প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই এই পুস্তিকা সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল। ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ বস্তুত, ছয় দফা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর।

ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে ‘৬৬-এর মার্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সেদিনের সেই কাউন্সিল সভায় আগত ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে। ছয় দফার ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করে। ছয় দফা কর্মসূচি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ছয় দফার ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা পরবর্তীকালে ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল। আওয়ামী লীগের এ কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন, যা ‘৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ‘৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে। কাউন্সিলের সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস নেই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়, এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ।’ স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলব। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।’ ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে। বঙ্গবন্ধু জানতেন ছয় দফাই কেবল বাঙালির স্বাধিকার তথা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ পাঞ্জাবিরা ছয় দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালির রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে, যা পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। কী ছিল ছয় দফাতে-

১নং দফাতে বলা হয়েছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফেডারেল রাষ্ট্র; সংসদীয় পদ্ধতির সরকার; সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং এর ভিত্তিতে সরাসরি ভোটে নির্বাচন। ২নং দফাতে ফেডারেল সরকারে দুটো বিষয় ন্যস্ত থাকবে, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র; অন্য সব বিষয় ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে। ৩নং দফাতে দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা দুই অঞ্চলে প্রবর্তন অথবা একক মুদ্রা। কিন্তু সেক্ষেত্রে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধে শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকতে হবে। পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ রাখতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হবে। ৪নং দফাতে ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে করারোপ ও রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। ফেডারেল কেন্দ্রের হাতে এরকম কোনো ক্ষমতা থাকবে না। তবে কেন্দ্র তার নিজ ব্যয় বা চাহিদা মেটানোর জন্য প্রদেশগুলোর করের একটা অংশ পাবে। ৫নং দফায় দেশের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য দুটি পৃথক বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রার হিসাব রাখা; এ দেশের অর্জিত বৈদেশিক বিনিময় মুদ্রা এ দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে; ফেডারেল সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন দুই অঞ্চল কর্তৃক সমান হারে অথবা নির্ধারণযোগ্য অনুপাতে দুই অঞ্চল কর্তৃক মেটানো হবে; দেশজ পণ্য দেশের দুই অঞ্চলের মধ্যে শুল্কমুক্তভাবে অবাধে চলাচল করবে; সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে ফেডারেশনভুক্ত ইউনিটের সরকারগুলো বিদেশে বাণিজ্য মিশন খোলা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করবে। সর্বশেষ ৬নং দফাতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি সামরিক বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে। ছয় দফার মূল বিষয়বস্তু ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ছয় দফার পক্ষে জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের কারণ হচ্ছে, এই দাবিগুলো প্রকৃতপক্ষে শুধু বাংলা নয়, তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষেরও দীর্ঘকালের দাবি।

বাংলার মানুষের মুক্তিসনদ ছয় দফা ঘোষণার পর জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু তার সফরসঙ্গীসহ উত্তরাঞ্চলে যান ‘৬৬-এর ৭ এপ্রিল। ওই দিন পাবনায় এক বিরাট জনসমাবেশে তিনি বক্তৃতা করেন। অতঃপর ৮ তারিখ বগুড়া, ৯ তারিখ রংপুর, ১০ তারিখ দিনাজপুর, ১১ তারিখ রাজশাহী, ১৪ তারিখ ফরিদপুর, ১৫ তারিখ কুষ্টিয়া, ১৬ তারিখ যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনায় বিশাল সব জনসভায় ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বক্তৃতা করেন। এভাবে সারা দেশে ৩৫ দিনে মোট ৩২টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। ঝটিকা সফরে ছয় দফার সপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে নির্মম গ্রেফতার-নির্যাতন। প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক জেলা থেকে জারিকৃত ওয়ারেন্টবলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এপ্রিলের ১৭ তারিখ রাত ৪টায় খুলনায় এক জনসভায় ভাষণদান শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার জারিকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারাবলে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস থেকে তিনি জামিন পান। এরপর সেদিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেফতার, পুনরায় জামিনের আবেদন, ২৩ তারিখ জামিন লাভ। ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেফতার, ২৫ এপ্রিল জামিন। এভাবেই আইয়ুবের দমননীতি চলতে থাকে। একই বছরের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক-জনতার এক বিরাট সমাবেশে শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং পাটের মালায় ভূষিত করে। ভাষণদান শেষে রাত ১টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২(১) ‘ক’ ধারাবলে তাকেসহ তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। ছয় দফা কর্মসূচিকে অপরাধ গণ্য করে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এরপর দেশরক্ষা আইনের আওতায় চলতে থাকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর অব্যাহত গ্রেফতার-নির্যাতন। সামরিক সরকারের এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ছয় দফার প্রতি মানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। কয়েক সহস্র শ্রমিক এদিনে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে এবং পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ করে। এর পরপরই দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ীভাবে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৭ জুন হরতাল আহ্বান করা হয়। ৭ জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা যেন অগি্নগর্ভ। বিক্ষুব্ধ মানুষ সেদিন স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। শেখ ফজলুল হক মণি, আমাদের প্রিয় মণি ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা যারা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছিলাম- সর্বজনাব সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে- আমরা সেদিন হরতাল কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার স্মৃতিপটে এখনো ভাস্বর হয়ে আছে সে দিনটি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মণি ভাই এসেছেন হরতালের সপক্ষে প্রচার কাজ চালানোর জন্য। তিনি তখন ছাত্র নন। ড. ওদুদুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন। তিনি মণি ভাইকে বললেন, ‘মণি, তুমি এখন ছাত্র নও। তুমি ক্যাম্পাসে অবস্থান করো না, চলে যাও। তুমি যদি না যাও তবে আমার চাকরি যাবে।’ মণি ভাই স্যারের কথায় সবিনয়ে সম্মতি জানিয়ে আমাদের হরতাল কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের নির্দেশ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ফলে তেজগাঁওয়ে শ্রমিক মনু মিয়া, আদমজীর শ্রমিক মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় আটশ লোককে গ্রেফতার করা হয়। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তারা সেখানে বক্তৃতা করেন। প্রকৃতপক্ষে ৭ জুন ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু।

১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬-এর ৭ জুনে ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারির গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান। ৯ ফেব্রুয়ারি ১১ দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে শপথ দিবস পালন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি লাগাতার সংগ্রাম শেষে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান। অতঃপর ২২ ফেব্রুয়ারি সব রাজবন্দীর মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্ত মানব শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান। পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্রলীগ। এসব মহিমান্বিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করেছিল গণতান্ত্রিক তথা নিয়মতান্ত্রিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জয় করে নিয়েছিল বাংলার মানুষের হৃদয় আর সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস। অতীতে আমাদের সময়ে ছাত্রলীগের সম্মেলন গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতি বছর ২১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তা না হলে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির কাছে নেতৃত্ব তুলে দিতে হতো। এটাই ছিল বিধান এবং গঠনতান্ত্রিক বিধি-বিধানের অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বিধান মোতাবেক ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আ স ম আবদুর রব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে এক বছর পরে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২১ মার্চের মধ্যে সম্মেলন করে নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজের কাছে নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করে আমাদের কমিটি বিদায় নেই এবং ২২ মার্চ হল ত্যাগ করে গ্রিন রোডে একটি বাসা ভাড়া করে আমি এবং রাজ্জাক ভাই বসবাস শুরু করি। আজ অতীতের সেই সোনালি দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই স্মৃতির পাতায় দেখি, সেদিনের ছাত্রলীগ ছিল বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায়ে মুজিবাদর্শ প্রতিষ্ঠার অগ্রবর্তী সংগঠন। মূলত বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতৃত্বই সেদিন সারা দেশে ৭ জুনের কর্মসূচি সফলভাবে পালন করে স্বাধিকারের পথে এক অনন্য নজির স্থাপন করে। আর বাংলার মেহনতী মানুষ আত্দত্যাগের অপার মহিমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীসহ সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত ছয় দফাই হচ্ছে বাঙালির জাতীয় মুক্তির একমাত্র পথ।

ছয় দফাকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু ছয় দফার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্থির-প্রতিজ্ঞাবোধ তাকে জনমনে জনগণমন অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। ‘৬৬-এর ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েও ছয় দফার আন্দোলনকে যখন রোধ করা যাচ্ছিল না, তখন বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে চিরতরে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলা দেন। ছয় দফা দাবি আদায়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে বাংলার সর্বস্তরের মানুষসহ আমরা যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ‘৬৯-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ছয় দফাকে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনসমেত ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-কলে-কারখানায় ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলশ্রুতিতে ১১ দফা আন্দোলনের সপক্ষে সারা দেশে যে গণজোয়ার তৈরি হয় তাতে দেশে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে।

আজ ভাবতে কত ভালো লাগে আমাদের জাতীয় জীবনে শত শহীদের রক্তে লেখা এ দিনটি চেতনায় জাতীয় মুক্তির যে অগি্নশিখার জন্ম দিয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ‘৭০-এর ৭ জুন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে এবং তারই নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করি। আমি হই আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ কর্মী। আওয়ামী লীগে যোগদানের পর বঙ্গবন্ধু আমাকে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন দেন এবং মাত্র ২৭ বছর এক মাস ১৫ দিন বয়সে আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই, যা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। এরপর ‘৭১-এ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নির্দেশে মুজিব বাহিনীর চার প্রধানের অন্যতম হয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি। স্বাধীনতার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় আমাকে তার রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন। আজ ৭ জুনে অতীতের অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহে আমার জীবন ধন্য। ৭ জুনের চেতনাবহ এই দিনটি আমার জীবনে অম্লান হয়ে আছে। ৭ জুনে যে সব শহীদ ভাই তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে বাংলার মানুষের মুক্তির পথকে প্রশস্ত করে গেছেন, আজকে তাদের পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। তাদের অমর প্রাণের বিনিময়ে সংগ্রাম পরম্পরায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কায়েম হয়েছে। ৭ জুন আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার চেতনার প্রারম্ভ বিন্দু। এই দিনটিতে ৭ জুনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা কর্তব্য বলে মনে করি।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার tofailahmed69@gmail.com

 

– See more at: http://www.bd-pratidin.com/editorial/2015/06/07/85853#sthash.SGnVoOGE.dpuf

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর