দেশে নতুন সাত শতাধিক ফসলের জাত

নানা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এ পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের সাত শতাধিক উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। ১৯৭১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। সে সময় চালের উত্পাদন ছিল ১ কোটি টন। দেশের জনসংখ্যা এখন দ্বিগুণের বেশি। আর চালের উত্পাদন সাড়ে ৩ কোটি টন ছাড়িয়েছে। একইভাবে উত্পাদন বেড়েছে অন্যান্য ফসলেরও। অথচ জমি কমেছে। দেশের কৃষি গবেষণায় বেশি ফলনের জাত উদ্ভাবন করায় কৃষির এই সাফল্যকে ‘উত্সাহব্যঞ্জক’ বলছেন বিজ্ঞানীরা।

১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। প্রতিষ্ঠার পর থেকে উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত এবং ধান উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠার পর বর্তমানে ধান উত্পাদন তিনগুণের বেশি বেড়েছে। ধান গবেষণায় ব্রি সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশে বোরো মৌসুমে চাষ হওয়া ধানের ৮২ শতাংশ, আউশের (গ্রীষ্মকালীন) ৩৬ শতাংশ এবং প্রতিস্থাপিত আমনের (বর্ষাকালীন ধান) ৪৭ শতাংশই ব্রির উচ্চ ফলনশীল ধান। বর্তমানে দেশের ধান আবাদের আওতাধীন জমির ৭৫ শতাংশে ব্রি ধানের চাষ হয় এবং এর থেকে দেশের মোট ধান উত্পাদনের শতকরা ৮৫ ভাগ আসে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধান গবেষণা ও সম্প্রসারণে ১ টাকা বিনিয়োগ থেকে আসে ৪৬ টাকা।

সর্বাধিক ফলনের জন্য সারাদেশে ব্রি-২৮ এবং ব্রি-২৯ জাতের ধান কৃষকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। আমন মৌসুমে অনুরূপ সফলতার নজির সৃষ্টি করেছে উদ্ভাবিত জাত বিআর ১১। এছাড়া রয়েছে মঙ্গা মোকাবিলার জাত ব্রি ধান-৩৩, বন্যা পরবর্তী সময়ের উপযোগী জাত ব্রি ধান ৪৬, লবণাক্ত এলাকার উপযোগী জাত ব্রি-৪০, ব্রি-৪১ ও ব্রি-৪৭, অলবণাক্ত জোয়ার-ভাটা এলাকার উপযোগী জাত ব্রি-৪৪, সুগন্ধি ধান ব্রি ধান ৫০ (বাংলামতি), জিংক সমৃদ্ধ জাত ধান ব্রি-৬২। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্রি-২৯ জাতে ভিটামিন ‘এ’ সংযোজন করা হয়েছে। হঠাত্ বন্যা জলাবদ্ধতায় আমন চাষে কৃষকদের সকল অনিশ্চয়তা দূর করে সুখবর নিয়ে আসে ব্রি ৫১ ও ব্রি ৫২ জাতের ধান। এই জাত দুই সপ্তাহ ঘোলা পানিতে ডুবে থাকলেও বেঁচে থাকতে পারে।

ধানসহ বিভিন্ন ফসলের গবেষণার জন্য দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১২টি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার মাধ্যমে জাত উদ্ভাবন করে চলছে।

ধান, পাট ও আখ ছাড়া অন্যান্য কৃষি নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সর্ববৃহৎ এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ১৬টি বিভাগ এবং ৭টি গবেষণা কেন্দ্র, ৬টি আঞ্চলিক কেন্দ্র ও ৩০টি উপকেন্দ্র। দু’শর বেশি ফসল ও বিভিন্ন শস্যের ৪৪৩টি উন্নত উদ্ভাবন করেছে। এই প্রতিষ্ঠান গবেষণা করছে গম, ভুট্টা, চীনা, কাউন, ডালশস্য, তেলফসল, কন্দাল জাতীয় ফসল, ফল, ফুল, সবজি ও মসলা জাতীয় ফসল নিয়ে। এ প্রতিষ্ঠানটি দানা জাতীয় ফসলের ৬৭টি জাত উদ্ভাবন করেছে, এর মধ্যে অঞ্চল ভেদে ২৮টি গমের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।

বিভিন্ন জাতের সুস্বাদু আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন ফলের ৭০টি জাত উদ্ভাবন করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। যা সারা দেশে আবাদ হচ্ছে। ডালের উত্পাদন বাড়াতে মসুর, ছোলা, মুগ, খেসারিসহ ৩২টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। ঘাটতি কমাতে পেঁয়াজ, হলুদ, আদা, কালজিরা, মরিচ, পানসহ মসলার ২৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে। কন্দাল ফসল ৯৩ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। দেশে চাহিদার তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ তেল উত্পাদন হয়। তারা বিভিন্ন তেলবীজের ৪৩টি জাত উদ্ভাবন করেছে। বছর জুড়ে বৈচিত্র্যময় সবজির উত্পাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে ৮৯টি সবজির জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, অর্কিড, জারবেরা, অ্যান্থুরিয়াম-এর প্রায় ১৬টি ফুলের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। একটি রফতানিযোগ্য পণ্য হিসাবে ফুলের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এমনটি জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দেশ আলু উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। উচ্চ ফলনশীল আলুর জাত উদ্ভাবন ও উন্নত বীজ উত্পাদনের ফলে হেক্টর প্রতি গড় উত্পাদন হচ্ছে ৩০-৩৫ টন। গ্রীষ্মকালীন টমেটোর জাত উদ্ভাবনের ফলে কৃষকরা অধিক লাভবান হচ্ছে।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট উত্পাদন সম্পর্কিত গবেষণা এবং পাটের বহুমুখী পণ্য উদ্ভাবন ও উন্নয়নের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত ৪০টি উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যে ১৬টি জাত মাঠ পর্যায়ে ব্যাপকভাবে চাষ করা হচ্ছে। এসব জাত ব্যবহার করে পাটের গড় উত্পাদন বেড়েছে এবং কৃষকরাও অধিক লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে দেশে সাত লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৬ লাখ বেল পাট উত্পাদিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাট গবেষণার ক্ষেত্রে দেশের বিজ্ঞানীরা বিশ্বে সর্ব প্রথম জীব প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন। পাটসহ পাঁচ শতাধিক উদ্ভিদের বিধ্বংসী রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাকের জীবন রহস্য আবিষ্কৃত হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে দেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীবন রহস্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৭২ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ময়মনসিংহে তা স্থানান্তর করা হয়। পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার ও জীব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বংশগতি ধারায় পরিবর্তন করে অধিক ফলনশীল ও মানসম্মত ধান, পাট, তৈলবীজ, ডাল ও সবজি জাতীয় শস্যের জাত উদ্ভাবনে গবেষণা সফলতা অর্জন করেছে। ইনস্টিটিউট কর্তৃক এ যাবত্ ১২টি ফসলের ওপর ৮১টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। স্বল্প সময়ে বিনাধান-৭ কার্তিকের মঙ্গা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। উচ্চ ফলনশীল বিনা সরিষা-৪ মাঝারি জীবনকালের জন্য একটি অতিরিক্ত ফসল হিসাবে উত্পাদিত হচ্ছে। উচ্চ ফলনশীল বিনা মসুর-৫ ও ৬ এবং গ্রীষ্মকালীন বিনামুগ-৫ ও ৮ ব্যাপকভাবে দেশে চাষাবাদ করা হচ্ছে। বিনা চিনাবাদাম ৪ ও ৬ ইত্যাদি ছাড়াও সয়াবিন, টমেটো, পাট ও পাট শাক উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। নাইট্রোজেন সারের বিকল্প হিসাবে ৮ ধরনের জীবাণু সার উদ্ভাবন করা হয়েছে। দক্ষিণে উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল এলাকা জুড়ে ভূমিতে লবণাক্ততা বিদ্যমান। লবণাক্ততা সহিষ্ণু বিনাধান ৮ ও ১০ চাষের সফল প্রযুক্তি উদ্ভাবন উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান গুড় ও চিনি শিল্পের জন্য ইক্ষু উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫১ সালে ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট পাবনা জেলার ইশ্বরদিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। আখচাষ দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে স্বল্প বৃষ্টিপাত এলাকার জন্য উপযোগী এক নির্ভরযোগ্য অর্থকরী ফসল। এ যাবৎ ইনস্টিটিউট ৪১টি ইক্ষুর জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব জাত খরা, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রবণ এলাকার জন্য বিশেষ উপযোগী। নদী বিধৌত চরাঞ্চলে বর্তমানে নতুন জাতের আখ চাষ করা হচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গুড় ও চিনির উত্পাদন বৃদ্ধির জন্য আখচাষের পাশাপাশি সুগার বিট উত্পাদন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সফলতা অর্জিত হয়েছে যা আখের বিকল্প হিসেবে উত্পাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত ইক্ষুর গড় উত্পাদন চিনিকল ও গুড় উত্পাদন এলাকায় হেক্টর প্রতি ১৫০-২৫০ টন। বর্তমানে চিনির উত্পাদন এক লাখ টন এবং গুড়ের উত্পাদন পাঁচ লাখ টন।

এর বাইরে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট মাটি নিয়ে গবেষণা করছে। গবেষণার মাধ্যমে চায়ের উত্পাদন বাড়ানো, উত্পাদিত চা-এর গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৫৭ সালে শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট যাত্রা শুরু করে। ইনস্টিটিউট এ যাবত্ উচ্চ ফলনশীল ও গুণগত মানসম্পন্ন ১৮টি ক্লোন উদ্ভাবন, বাই- ক্লোনাল ও পলিক্লোনাল বীজ উদ্ভাবন করেছে।

রেশম শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। ইতোমধ্যে ৯টি উচ্চ ফলনশীল তুঁতজাত এবং ২৮টি রেশম কীটের উচ্চ ফলনশীল জাত ও ২টি শংকর জাত উদ্ভাবন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর