নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশি লাঞ্ছনা

নববর্ষে নারীদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদে রোববার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন। কিন্তু কার্যালয় যাওয়ার আগেই ব্যাপক লাঠিপেটা, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও পানি ছিটিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এ সময় পুলিশের নির্মমতায় অন্তত ৩০ নেতাকর্মী আহত হন। পুলিশের নির্দয় পিটুনি থেকে রেহাই পায়নি নারী কর্মীরাও। উল্টো সেখান থেকে আটক করা হয়েছে ৫ জনকে। পুলিশ দাবি করেছে, তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপে রমনা থানার ওসিসহ সাত সদস্য আহত হন।

এ হামলার প্রতিবাদ ও নারী লাঞ্ছনাকারীদের বিচার দাবিতে কাল মঙ্গলবার সারা দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও আজ বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন। প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতি। প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে জড়ো হয়। তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে মিন্টো রোডে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাওয়ের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথে একাধিক স্থানে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। বেলা পৌনে ১টার দিকে তারা কাকরাইল হয়ে অফিসার্স ক্লাবের কাছে পৌঁছলে পুলিশ রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। মিছিলকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড পার হওয়ার চেষ্টা করলে দু’পক্ষে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। নেতাকর্মীরা রাস্তায় বসে পড়েন এবং ডিএমপি কমিশনার সেখানে না আসা পর্যন্ত বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়।

বিক্ষোভকারীরা রাস্তার পাশে ফুটপাত থেকে ফুলের টব ও নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট নিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করে। পুলিশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের বেধড়ক লাঠিচার্জ করে ও ধাওয়া করতে থাকে। টিয়ার গ্যাস শেল ও ওয়াটার ক্যানন ব্যবহার করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ছত্রভঙ্গ অবস্থায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ডিএমপি কার্যালয়ের সামনে থেকে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের কাছে পর্যন্ত।

প্রত্যক্ষদর্শী আরও জানায়, এ সময় ৮-১০ জন পুলিশ সদস্য মিলে এক-একজনকে মারধর করতে, শার্টের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে, বিক্ষোভকারীদের অস্ত্র দিয়ে পেটাতেও দেখা গেছে। এমনকি পুলিশকে নারী কর্মীদেরও নির্দয়ভাবে পেটাতে দেখা গেছে। হামলার পর আহত নারী কর্মীদের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখা যায়। ঘটনাস্থলে ব্যাপক ইটপাটকেল, স্যান্ডেল, পানির ক্যান পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেগুলো পুলিশ সরিয়ে নেয়।

ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারিক জানান, ঘেরাও কর্মসূচির আগে রাজু ভাস্কর্যের সামনে তারা সমাবেশ করেন। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশ দোয়েল চত্বরে ও হাইকোর্টের উল্টো দিকে দুই দফা বাধা দেয়। শেষে সার্কিট হাউস রোডের অফিসার্স ক্লাব এলাকায় গেলে লাঠিপেটা শুরু করে। এতে নেতাকর্মীদের অনেকেই জখম ও আহত হয়েছেন। পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে নিয়ে যায়। কয়েকজন নেতাকর্মীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

দফতর সম্পাদক আল আমিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্র ইউনিয়ন দাবি করেছে, ‘পুলিশের হামলায় ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি হাসান তারেক, সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম জিলানী শুভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি লিটন নন্দী, মহানগর সাধারণ সম্পাদক সুমন সেন গুপ্ত, সাংগঠনিক সম্পাদক অনিক রায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি তন্ময় ধর, মিরপুর থানা সভাপতি রাকিবুজ্জান, লালবাগ থানার আহ্বায়ক জিএম রাব্বি, কবি নজরুল কলেজের সভাপতি দীপক শীল, ঢাবি সংসদের কর্মী হাসিব মোহাম্মদ আশিক, নারায়ণগঞ্জ জেলা সংসদের নেতা ইসমত জাহান জো, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের নেতা কেএম মুত্তাকী, রাগিব নাঈম, তূর্য, ফারজানা, নোমান, অপূর্ব, অমিতসহ অন্তত ৩০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। পুলিশ আটক করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক দীপাঞ্জন সিদ্ধান্ত কাজল, ঢাকা মহানগর সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক অনিক রায়, তেজগাঁও কলেজ সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক অন্তু চন্দ্র নাথ, ঢাকা মহানগর নেতা সাদ্দাম হোসেন ও জাবির নেতা আরিফুল ইসলাম অনিককে।

ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তার এক বিবৃতিতে বলেন, শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ওপর পুলিশের এ নারকীয় তাণ্ডব প্রমাণ করে তারা দোষীদের আড়াল করতে চায়। এমন ফ্যাসিবাদী আচরণ রুখে দিতে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলারও আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, পুলিশের হামলায় আহত হাসান তারেক, লিটন নন্দী, মারুফ বিল্লা তন্ময়, দীপক চৌধুরী, জিলানী শুভ, রাশিদুল হক, মেহেদী হাসান, উজ্জ্বল ও দেলোয়ার হোসেনসহ ১০ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

রমনা থানার ওসি মশিউর রহমান যুগান্তরকে জানান, মিছিলকারীদের ইটপাটকেলে তিনিসহ সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। অপর পুলিশ সদস্যরা হলেন- থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলী হোসেন, এসআই কামরুল, নায়েক জাহিদ, শাহীন, কাজী আরিফ, আলী হোসেন ও আরাফাত। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন রাউন্ড টিয়ার গ্যাস শেল নিক্ষেপ করেছে। জলকামান সেখানে থাকলেও ব্যবহার করা হয়নি। এ বিষয়ে একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের উপকমিশনার আবদুল বাতেন জানান, ‘অবরোধকারীরা যানজট সৃষ্টি করেছিল। পুলিশ তাদের সরে যেতে বলে এবং দাবি-দাওয়া থাকলে প্রতিনিধি পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তারা না সরে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করতে থাকায় পুলিশ টিয়ার শেল ও ওয়াটার ক্যান ব্যবহার করে।’

কাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট : বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্র ইউনিয়ন। এতে ওই হামলার প্রতিবাদে কাল মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন সংগঠনের সভাপতি হাসান তারেক। এছাড়া আজ সোমবার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণাও দেন তিনি। এ সময় সহ-সভাপতি আবু তারেক সোহেল, সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তার, ঢাবি শাখার সভাপতি লিটন নন্দী, সাধারণ সম্পাদক সুমন সেনগুপ্তসহ সংগঠনের অন্য নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

নিন্দা ও প্রতিবাদ : ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচিতে পুলিশি হামলা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল। সিপিবি সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহম্মেদ, বাসদের কমরেড খালেকুজ্জামান এ নিন্দা জানান।

গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক মোশরেফা মিশু, কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সদস্য শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, সায়ফুল হক, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, জোনায়েদ সাকি, হামিদুল হক, প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান ও মহিনউদ্দিন চৌধুরী লিটন এক বিবৃতিতে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তারা আটকদের অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেন।

ভিন্ন বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি আবদুল আল ক্বাফি রতন, সাধারণ সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল এক বিবৃতিতে হামলা ও গ্রেফতারের নিন্দা জানান। বিজ্ঞপ্তিতে তারা বলেন, গণদাবিকে অগ্রাহ্য করে কোনো সরকার বেশি দিন টিকতে পারেনি। দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলে এর সমুচিত জবাব দেবে। যুব ইউনিয়নের নেতারা আহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান।

তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীও। সংগঠনের প্রচার সম্পাদক কংকন নাগের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, এ হামলার মাধ্যমে পুলিশ প্রকৃতপক্ষে ব্যর্থতার দায় স্বীকার না করে দোষীদের আড়াল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এছাড়াও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর