একের পর এক খুনের ঘটনায় বিব্রত সরকার

দেশে একের পর এক খুনের ঘটনায় বিব্রত সরকার। শঙ্কিত সাধারণ মানুষ। প্রতিরোধের কোন পরিকল্পনাই কাজে না লাগায় উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। এমনকি অপরাধ বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টিকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে মত দিয়েছেন।

ব্লগার ও মুক্তমনাদের হত্যা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে এমনিতেই ভীষন উদ্বেগে দেশের মানুষ। তারওপর মেধাবী শিক্ষার্থী ও থিয়েটার কর্মী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আরও বেশি উদ্বিগ্ন ও আবেগময় করে তোলে মানুষকে।

বিশেষ করে সর্বশেষ সমকামীদের অধিকার বিষয়ক পত্রিকা রুপবানের সম্পাদক জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু থিয়েটার কর্মী তনয়কে কুপিয়ে হত্যা ও তার আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমনা শিক্ষক অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউজকে করিম সিদ্দিকীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করার ঘটনায় আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে মানুষকে।

এ নিয়ে ভীষন চাপের মধ্যে রয়েছে সরকারও। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে প্রতিনিয়তই জবাবদিহির মুখে পড়তে হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি বিচারে তৎপর রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলছেন, একদিকে সরকার এসব ঘটনার কোনো কুলকিনারা করতে পারছে না, অন্যদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নানাজনের ও মহলের নানা প্রশ্ন, সমালোচনা ও তোপোর মুখে ভীষন বিব্রতও বটে।

পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের গত প্রায় চার মাসে সারা দেশে খুন হয়েছেন ১ হাজার ১৬৫ নারী-পুরুষ। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে খুনের শিকার হয়েছেন ১১ জন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি উদ্বেগজনক।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে একটি চক্র টার্গেট কিলিংয়ে নেমেছে। একই সুরে কথা বলেছেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।’

তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশে জঙ্গি তৎপরতায় যে ‘টার্গেট কিলিং’ হচ্ছে তা বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মন্ত্রী দাবি করেন।

সংশ্লিষ্ট দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে (২০১৫ সাল) হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৪ হাজার ৩৫ জন। আর এর আগের বছর ২০১৪ সালে খুন হন ৪ হাজার ৫১৪ জন। ২০১৫ সাল থেকে একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনায় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়ে। বিদেশী নাগরিকসহ টার্গেট কিলিংয়ের ১১টি ঘটনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস, আল কায়দা ইন ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট (একিআইএস) ছাড়াও দেশি জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম দায় স্বীকার করে। যদিও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিদেশি এসব জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব বরাবরই অস্বীকার করে আসা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যা নিয়ে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলনের মধ্যেই সোমবার সকালে গাজীপুরের কাশিমপুরে প্রধান কারারক্ষীকে ও বিকেলে রাজধানীর কলাবাগানে খুন হন বাংলাদেশস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয়।

এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সাধুকে ও রাজধানীর পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমউদ্দিন সামাদকে প্রায় একই কায়দায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা।

মঙ্গলবার দুর্বৃত্তের হাতে নিহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর গ্রামের বাড়ি দরগামাড়িয়া জামে মসজিদের ইমাম রায়হান আলী খাজাপাড়া গ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষক মুনসুর রহমানকে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে করে বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়েছে আতংক।

জানা গেছে, ২০ মার্চ কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার রহস্য এখনও উদঘাটন হয়নি।

ওই খুনের রেশ না কাটতেই রাজধানীতে ৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় ব্লগার ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। ওই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কাউকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি।

২৩ এপ্রিল শনিবার রাজশাহী মহানগরীর শালবাগান এলাকায় নিজ বাসার কাছে (১৫০ গজ দূরে) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে (৫৮) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই হত্যাকাণ্ডটিও আইএস ঘটিয়েছে বলে তাৎক্ষণিকভাবে একটি ওয়েব সাইটে জানান দেয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত পুলিশ ওই খুনের কোনো ক্লু পায়নি।

সোমবার সকালে প্রকাশ্য দিবালকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের অদূরে খুন হন রুস্তম আলী নামে সাবেক এক কারারক্ষী।

এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিকালে রাজধানীর কলাবাগান থানার লেক সার্কাস রোডের একটি বাড়িতে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাত ভাই জুলহাজ মান্নান ও মান্নানের বন্ধূ তনয় নামে দু’জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত দু’জনার মধ্যে জুলহাজ মান্নান ইউএসএআইডির কর্মকর্তা ছিলেন। এছাড়া ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এ জোড়া খুনের দায় শিকার করে বিবৃতি দিয়েছে আনসার আল ইসলাম নামের দেশীয় একটি জঙ্গি সংগঠন।

এর আগে রোববার মধ্যরাতে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় কুপিয়ে ও গুলি করে দু’জনকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

উল্লিখিত প্রায় সব খুনের ধরন ও কৌশল দেখে তদন্ত সংস্থাগুলোর ধারণা, ধর্মীয় উগ্রপন্থী বিভিন্ন গ্রুপ এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।

এর আগে গত বছরের ১ নভেম্বর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

একই দিন কলাবাগানে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে আহমেদুর রশীট টুটুল, লেখক তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকে কুপিয়ে ও গুলি করে আহত করা হয়।

এছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে মন্দিরের পুরোহিত জগেশ্বরী দাসাধীকারী, গত বছরের ৫ অক্টোবর ঈশ্বরদীতে ধর্মযাজক লুক সরকারকে হত্যার চেষ্টা, ১১ নভেম্বর দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানার মির্জাপুর বাসস্ট্যান্ডে ইতালির নাগরিক ডা. পিয়েরো পারোলারিকে হত্যার চেষ্টা, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আমেদ হায়দার রাজিবকে হত্যা, গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানমনষ্ক লেখক ড. অভিজিৎ রায়কে হত্যা, গত বছরের ৭ আগস্ট নিলাদ্রী চ্যাটার্জি ওরফে নিলয় হত্যা, গত বছরের ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াসিকুর রহমান বাবু হত্যা, ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস হত্যা, ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যা চেষ্টা ও একই বছরের ১০ এপ্রিল বুয়েটের ছাত্র ও ব্লগার আরিফুর রহমান দীপুকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়।

এসব ঘটনায় দেশে-বিদেশে শুরু হওয়া ব্যাপক তোলপাড় এখনও চলছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আহ্বান জানায়। তাদের এই আহ্বান এখনও অব্যাহত রয়েছে। মুক্তমনা লেখকদের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে। এছাড়াও কয়েকটি ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের উগ্রপন্থী আইএস দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়ায় বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিকভাবেও চাপ তৈরি করা হয়। যদিও সরকার এবং আইনশৃংখলা বাহিনী বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একটি ঘটনা ঘটার পর পরই যদি সেটাকে টার্গেট কিলিং কিংবা জঙ্গি হামলা বলা হয় তখনই এর তদন্তের ওপর প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। কোনো একটি ঘটন ঘটলে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটি কোন ধরনের ঘটনা তা সরকার বা পদস্থ কর্মকর্তাদের মুখ থেকে উল্লেখ না করাই ভালো। এতে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে এবং অপরাধীরাও পার পেয়ে যেতে পারে বলে তার ধারণা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর