এশিয়ার সর্ববৃহৎ কারাগারের যাত্রা শুরু

আধুনিক কারাগারের সব ব্যবস্থা ও সুবিধা নিয়েই যাত্রা শুরু করল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কেরানীগঞ্জ। বলা হচ্ছে, এটি হবে এশিয়ার সর্ববৃহৎ কারাগার।

প্রস্তুত করা হয়েছে ফাঁসির মঞ্চ ও পেরিমিটার ওয়াল। বন্দিরা পালাতে গেলেই সক্রিয়ভাবে বেজে উঠবে পাগলা ঘণ্টি। রয়েছে জলসিঁড়ি ঘর, গ্রন্থাগার ও খোলা মাঠ।

চলতি মাসেই কারাগার ভবন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, করতোয়া ও মনিহারে হাজতিদের নেওয়া হবে। মধুমতি ও রূপসায় নেওয়া হবে কয়েদিদের। আর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রাখা হবে ডেঞ্জার সেল বনফুল, বকুল, শাপলা ও সূর্যমুখীতে।

নদী ও ফুলের সঙ্গে মিল রেখে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভবনগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। প্রায় ৩১ একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে কারাগারটি।

রোববার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুরে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার উদ্বোধন করেন।

এসময় উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও কারা মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারাগারটিতে বন্দি ধারণ ক্ষমতা চার হাজার ৫৯০ জন। প্রধান ফটকের বাঁ পাশে রির্জাভ গার্ড হাউজ, তারও বাঁয়ে বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ভবন। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই ডানপাশে রয়েছে দৈনিক রসদ গ্রহণ ও বিতরণ কক্ষ; তারপর ভর্তি শাখা এবং মুক্তি শাখা। আর ফটকের পাশে রয়েছে জেলারের কক্ষ।

প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ডান দিকে তাকালে দেখা যাবে কারাগার ভবন পদ্মা, তার দক্ষিণে যমুনা, তারপরই মেঘনা। ছয়টি ছয়তলা ভবনে হাজতি এবং একই ধরনের দুটি ভবনে কয়েদিদের রাখা হবে। এসব ভবনের প্রতি তলায় ৪০টি করে কক্ষ; প্রতি কক্ষে ১৩ জন করে বন্দি রাখার ব্যবস্থা। ২০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত প্রস্থের প্রতিটি কক্ষে থাকবে চারটি করে সিলিং ফ্যান। পাশেই রয়েছে বাথরুম।

চারটি চারতলা ভবন হবে ডেঞ্জার সেল। ৪০০ দুর্ধর্ষ জঙ্গি ও সন্ত্রাসীকে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। রয়েছে ডিভিশনপ্রাপ্ত (ভিআইপি) বন্দিদের জন্য ১৬টি বিশেষ কারাকক্ষ। মেঘনার পূর্বপাশের ভবনটি চম্পাকলি, যেখানে ভিআইপি বন্দিদের রাখা হবে। আর চম্পাকলির উত্তরে সুরমায় রাখা হবে কিশোর অপরাধীদের।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার আরিফুর রহমান জানান, কিশোর অপরাধীদের কাশিমপুরে কিশোর সংশোধানাগারে পাঠানো হবে। তবে যাদের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছর, তাদের সুরমায় রাখা হবে।

তিনি জানান, হাজতিদের রাখা হবে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, করতোয়া ও মনিহারে। কয়েদিরা থাকবেন মধুমতি ও রূপসায়।

শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও গুরুতর মামলার আসামিদের রাখা হবে ডেঞ্জার সেল- বনফুল, বকুল, শাপলা ও সূর্যমুখী নামের চার ভবনে। চারতলা এসব ভবনের প্রতি কক্ষেই টয়লেট ও ফ্যান রয়েছে।

ফাঁসির মঞ্চ রয়েছে কারাগারের দক্ষিণ অংশের সীমানা প্রাচীরের কাছে বনফুলের সীমানার মধ্যে। ফাঁসির মঞ্চটি দক্ষিমুখী এবং মঞ্চের ওপর ছাউনি রয়েছে। একই মঞ্চে এক সঙ্গে দুজনকে ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।

নতুন এ কারাগারের ডেঞ্জার সেলগুলো কাছাকাছি। বনফুলের উত্তরে বকুল আর পূর্বপাশে শাপলা। আর বকুলের পূর্বপাশে সূর্যমুখী।

এই চার কারা ভবন ঘিরে রয়েছে ১৮ ফুট উচ্চতার সীমানা প্রাচীর। তার ওপর দুই ফুট বৈদ্যুতিক তারের সেন্সর। প্রতিটি ভবনের রয়েছে আলাদা ছোট প্রাচীর। কোনো আসামি ১৮ ফুট দেয়াল টপকে যেতে চাইলে তারের সেন্সরে স্পর্শ লাগামাত্র নিরাপত্তা ঘণ্টা বেজে উঠবে। সেই সঙ্গে পলায়নপর কয়েদিকে খেতে হবে বৈদ্যুতিক শক। এখানে এক ভবনের আসামি অন্য ভবনে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই।

প্রধান ফটক দিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকলে প্রথমে বাঁ পাশে গ্রন্থাগার এবং তার উত্তরে মানসিক বন্দিদের জন্য জলসিঁড়ি ভবন। জলসিঁড়ির পূর্বপাশে এমআই ইউনিট ভবন। সেখানে এক সঙ্গে আটজন বন্দিকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যাবে।

জলসিঁড়ি ভবনের পর বিশাল ফাঁকা জায়গা। এখানে রয়েছে কেইস টেবিল শেড। কোন আসামিকে কোন ভবনে নেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করা হয় এ শেডে বসে। আসামিদের মধ্যে কেউ অপরাধ করলে, সেখানে এনে সাময়িক বিচারও করা হয়। কেইস শেডের দক্ষিণ-পশ্চিমে মধুমতী ভবন আর পূর্বে সুরমা। সুরমার দক্ষিণে ওয়ার্ক শেড আর ওয়ার্ক শেডের পূর্বে রয়েছে আটার মিল।

দোতলা ওয়ার্ক শেডে বড় বড় চারটি কক্ষ রয়েছে। সেখানে বন্দিরা কী কী কাজ করবেন, তা এখনও নির্ধারণ হয়নি।

কারাগারের ভেতর সেলুন ও লন্ড্রি ভবনও রয়েছে। আর সবকিছু পর্যবেক্ষণের জন্য কারাগারের চারপাশে রয়েছে ৪০ ফুট উঁচু চারটি ওয়াচ টাওয়ার।

কারাগারের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে রয়েছে ব্যারাক দুর্জয়। ৯৬টি কক্ষে প্রায় ৪০০ কারারক্ষী সেখানে থাকতে পারবেন।

কারাগারের পশ্চিম পাশে তৈরি করা হয়েছে আবাসিক এলাকা। ৬০০ বর্গফুট আয়তনের ১৭টি ভবন সেখানে তৈরি হচ্ছে। ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ছাড়াও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য ১২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটও তৈরি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ডেপুটি জেলার আরিফুর রহমান জানান, চম্পাকলিতে ১৬টি ভিআইপি কক্ষ রয়েছে, যাতে ১৬ জন ভিআইপি বন্দি থাকতে পারবেন।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দেশের ও এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের মতোই এটিকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। পুরুষের জন্য ২টি পার্ট ও নারী বন্দিদের জন্য ১টি পার্ট এবং কারাগারের বাইরের অংশে ২০০ শয্যার হাসপাতাল। থাকছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও সুবিধা।

কারাভ্যন্তরে বিশ্বের উন্নত দেশের কারাগারের ন্যায় ৬ তলাবিশিষ্ট ৮টি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ভবনে ৫০০ বন্দিকে রাখা হবে। রয়েছে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, দুধর্ষ ৪০০ আসামিকে রাখার জন্য ৪ তলাবিশিষ্ট ৪টি ভবন। এতে প্রতিটি ফ্লোরে ১০০ বন্দিকে রাখা হবে।

৬০ জন ভিআইপি অর্থাৎ ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের রাখার জন্য ৬০টি বিশেষ কক্ষ রয়েছে। কিশোর অপরাধে অভিযুক্ত ১০০ কিশোর বন্দিকে রাখার জন্য রয়েছে বিশেষ সেল ও ৩০ জন মানসিক ভারসাম্যহীন বন্দির জন্য আলাদা ভবন।

কারাগারের বাইরে থাকবে কর্মরত কর্মকর্তাদের ৫০টি পরিবারের আলাদা ইউনিট ও কর্মচারীদের ৩৫০টি পরিবারের জন্য আলাদা ভবন।

রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনোদনে অফিসার্স ক্লাব, কর্মচারীদের জন্য স্টাফ ক্লাব, স্কুল, মসজিদ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ সভার জন্য মিলনায়তন।

সূত্র জানায়, ১৯৮০ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হলেও প্রায় ৩৪ বছর পর বর্তমান সরকার এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। ২০০৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একনেকে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়ার পর থেকেই শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। ২০০৭ সালে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে মূল কারাগার ভবন নির্মাণের কাজ জোরদার করা হয়। ২০১৩ সালের জুনে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের নথিতে দেখা যায়, ১৯৮০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কাউন্সিল সভায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রীয় কারাগার সরাতে দুটি কারাগার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে একটি গাজীপুরের কাশিমপুর ও অন্যটি রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায়। তবে মূল কেন্দ্রীয় কারাগার যাবে কেরানীগঞ্জে। কিন্তু প্রথমেই কাশিমপুরের কারাগারটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর