বিএনপির টার্গেট জাতীয় নির্বাচন

পীর হাবিবুর রহমান :

বিএনপি আসলে কি চাই? দলের নেতাদের এখন একটাই টার্গেট জাতীয় সংসদ নির্বাচন। হাকডাক করা দলের কাউন্সিল এখন পর্যন্ত বিএনপির চেয়ারপার্সন পদে বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেযারম্যান পদে তারেক রহমানের পুন:নির্বাচিত হওয়া অভিষেক উৎসবে পরিণত হয়েছে। কাউন্সিলে খালেদা জিয়ার ভাষণ সর্বস্ব হলেও এখনো দলের স্থায়ী কমিটি কিংবা কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি এখনো ঘোষিত হয়নি। এনিয়ে কাউন্সিলের পর দলের অভ্যন্তরীণ হতাশা দূর করতে পারেননি বিএনপি নেতৃত্ব। কাউন্সিলের সাত দিন পর দলের মহাসচিব পদে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব পদে রুহুল কবির রিজভী ও কোষাধক্য পদে মিজানুর রহমান সিনহার নাম ঘোষণা করে বসে আছে বিএনপি।

এখনও পর্যন্ত দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণ ফোরাম স্থায়ী কমিটি ঘোষিত হয়নি। ঘোষিত হয়নি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। কার্যত কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে বিগত কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় বিএনপির রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক দলীয় ফোরাম নেই বললেই চলে। দুই দফায় ইউপি নির্বাচনে সরকারী দলের যে দখলের মহাউৎসব হয়ে গেছে সেটি আর বিএনপিকে বলতে হচ্ছে না। খোদ সরকারের মন্ত্রী ও জোটের অন্যতম শরীক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননই বলছেন। দুই দফা ইউপি নির্বাচনের চেহেরা দেখে বিএনপি বর্জন করে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিল। বর্জনে রাজনৈতিক অর্জন নেই তাই বিএনপি সরে দাঁড়ায়নি। ভোটের ময়দানে থেকে গেল। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ওয়ান ইলিভেন থেকে বিগত দিনে দলের দুঃসময়ে যারা সাহসী ভূমিকা রেখেছেন তাদেরকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে এসেছেন। এমন খবর বিএনপির কন্দলের বাইরে ঘটছে।

সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব পদে রুহুল কবির রিজভী যেমন থাঁই পেয়েছেন তেমনি সালাউদ্দিন আহমেদ স্থায়ী কমিটিতে পদোন্নতি পাচ্ছেন এমন থবর শোনা যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের ভাষায় এত বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি যেখানে আগামী দিনের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দল গোছাচ্ছে সেখানেই কাউন্সিল সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে দলের মহাসচিব, যুগ্ন মহাসচিব, স্থায়ী কমিটি, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নাম ঘোষণা হতে পারত। কাউন্সিলের আগেই বিএনপির নেত্রী সেই তালিকা চূড়ান্ত রাখার কথা। দলের কাউন্সিলে দেওয়া ভিশন ২০৩০ এর রুপরেখা নিয়ে দেওয়া ভাষণ যতটা আকর্ষনীয় হয়েছিল, কমিটি ঘোষণা করতে না পারা ততটাই ছন্দহীন করেছে।

কাউন্সিলের দেওয়া ভাষণে সন্ত্রাস সংসহিতার বিপরীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নত করার যে ঘোষণা দিয়েছেন তার বিপরীতে যুদ্ধাপরাধে অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী নেতাদের মঞ্চে আসন দান ততটাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এই কাউন্সিলে বিএনপির রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি হিসেবে আলোকিত হয়ে দল ত্যাগী অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও কর্ণেল (অব:) অলি আহমেদ বীর বিক্রম শুভেচ্ছা বক্তৃতা দিয়েছেন সেখানে জামায়তকে মঞ্চে নামালে বিএনপির আগামী রাজনৈতির জন্য ইতিবাচক বার্তা বইতো। কাউন্সিল মঞ্চে জামায়াতকে এনে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি কতটা শোভা বাড়িয়েছে তার চেয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপরাধে নিন্দিত এই দলটিকে যে বিএনপি ছাড়ছে না সেই বার্তায় দিয়েছে।

জনগণের মধ্যে সরকার বিরোধী মনোভাব যততটা রয়েছে তার চেয়ে বেশি তরুণ প্রজন্মসহ রয়েছে জামায়ত বিরোধী। এত পথ হেঁটে এসে দল গোছানোর বিএনপির কাউন্সিল থেকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার যে বার্তা জনগণের সামনে দিয়েছেন সেটি জৌলুশ ও আকর্ষণ হারিয়েছে জামায়াতের উপস্থিতিতে। সমালোচকদের ভাষায় বিএনপির শেষ শাসনামলকে দুটি শক্তি প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করেছে তার একটি হচ্ছে জামায়াত, অন্যটি হাওয়া ভবন।

জামায়াতের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। তাদের নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধে একে একে ফাঁসি হচ্ছে। সন্ত্রাস ও সংসহিতা অভিযোগে জনমনে চিহ্নিতই হয়নি। সরকারের কঠোর দমন পীড়নে পতিত হয়েছে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভাষণে শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীল রাজনৈতির পক্ষে ইতিবাচক বক্তৃতা করলেও জামায়াতকে মঞ্চে বসিয়ে সমালোচকদের হাতে মুখ্য মস্তটি যেমন তুলে দিয়েছেন তেমনি জামায়াতকে বাইরে রাখলে যেসব ছোট ছোট অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করার সম্ভাবনা দেখেছিলেন সেই পথটি রুদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে, বিএনপির শেষ শাসনামলে দূনীতি-সন্ত্রাস গ্রেনেড বোমা হামলা অভিযোগে অভিযুক্ত হাওয়া ভবনের কান্ডারী তারেক রহমানকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার সম্ভবণাও তিরহিত হয়েছে। কাউন্সিলে বিএনপির চেয়ারপার্সন ইতিবাচক বক্তৃতা করলেও লন্ডণে নির্বাসিত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইতিহাস বিকৃতির নেতিবাচক বক্তৃতায় রাখছেন। জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে দলের কাউন্সিলে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ভাষণটি নানা প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে যার নেপাথ্যে বিএনপির শুভাকাঙ্খী শক্তির হাত বা পেসক্রিপশন রয়েছে বলে গুঞ্জন আছে।

ভিশন -২০৩০ এ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত করার যে স্বপ্ন রেখা উত্থাপন করেছেন তার জন্য ২৩টি সাব-কমিটি দলের বাইরে বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে গঠন করার চিন্তা রয়েছে। যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও তথ্য প্রযুক্তি খাত মিলিয়ে ১৭টি সাব-কমিটি হতে পারে। বিএনপির নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে যে বিষয়টি এই মুহুর্তে দলের কাছে অগ্রাধিকার বলে মনে হয়েছে সেটি হলো দল গোছানেই প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে আগাম জাতীয় নির্বাচন আদায়ের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি সেটি সরকার নির্ধারিত ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু সেই নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য করতে গিয়ে ঐ সময়ের সরকার প্রধান হিসেবে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদলে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য কাউকে করতে হবে। শক্তিশালী দক্ষ নির্বাচন কমিশনের জন্য বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিদায় ও পুর্ণগঠন করাই মুল দাবি। কাউন্সিলে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণেও সেটি উচ্চারিত হয়েছে।

দলের স্থায়ী কমিটি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা ছাড়াও গোছানোর প্রধান লক্ষ্য। এটি সম্পন্ন করে ঈদের পর আগাম নির্বাচনের দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য মাঠে নামতে চায় বিএনপি। সেই চাপ সৃষ্টিতে জোটের বাইরে অনান্য দলগুলোকেও কাছে টানতে চায় বিএনপি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বড় বাধাই হচ্ছে জামায়াত। এদিকে দলের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কথাই শেষ কথা নয়। পর্যবেক্ষকদের মতে লন্ডনে নির্বাসিত পুত্র ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কর্তৃত্ব এখনো প্রবল। আর্šÍজাতিক মহলের সঙ্গে লবিং যতই জোরদার হোক না কেন নির্বাচন আদায় বহুদূর। ‘দিল্লী বহু দূরস্ত’র মতো। পর্যবেক্ষদের দৃষ্টি এখন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের নেতারা মামলার বোঝা নিয়ে যেভাবে হামেশা আদালত পাড়ায় ছুটছেন তার পরিনতি এবং দলের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিসহ অঙ্গ সংগঠন ও জেলা নেতৃত্বকে ঢেলে সাজিয়ে সাংগঠনিক দূর্বলতা কিভাবে কাটিয়ে উঠা যায় তার দিকে। খালেদা জিয়াসহ দলের নেতারা শান্তিপূর্ণ সভা ও সমাবেশের পথে সারা দেশ সফরে কতটা জনমত জানতে পারনে এবং সংগঠিত করেন সেটিই দেখার বিষয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর