বিশ্ব নেতাদের অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে তোলপাড়

বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অর্থ কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিশ্ব জুড়ে চলছে তোলপাড়। ওইসব ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে তাদের নিজ দেশে বিক্ষোভ করছে সাধারণ মানুষ। ঝড় বইছে নিন্দার। কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই এসব ঘটনার তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে।

পানামা পেপারস কি

‘মোস্যাক ফনসেকা’- পানামার একটি আইনী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে বিশ্বের ক্ষমতাবানরা তাদের গোপন অর্থ গচ্ছিত রাখেন। পানামার এ প্রতিষ্ঠানের অজস্র নথি ফাঁসের এ ঘটনা ‘পানামা পেপারস’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। আর সেই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ক্ষমতাশীলদের গোপন নথি ফাঁস হওয়ায় বিশ্ব জুড়ে চলছে এই তোলপাড়। বিশ্বের ধনী আর ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কোন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সেইসব তথ্য।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের যেসব প্রতিষ্ঠান গোপনীয়তা রক্ষার জন্য বিখ্যাত, পানামার এই মোস্যাক ফনসেকা তাদের অন্যতম।

গত ৪০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ক্ষমতাশালী মক্কেলদের কীভাবে অর্থ পাচারে সহযোগিতা করেছে, নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর এবং কর ফাঁকি দেওয়ার পথ দেখিয়েছে, সেসব তথ্য রয়েছে এসব নথিতে।

ফাঁস হওয়া নথিতে বিশ্বের শতাধিক ক্ষমতাধর মানুষ বা তাঁদের নিকটাত্মীয়দের বিদেশে টাকা পাচার করার তথ্য পাওয়া গেছে।

মোস্যাক ফনসেকার থেকে ফাঁস হওয়া সেই সব নথিপত্রে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, লিবিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মুয়াম্মার গাদ্দাফী এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ পযন্ত রয়েছেন।

এসব নথি থেকে বিলিয়ন ডলার পাচারের একটি চক্রেরও সন্ধান মিলেছে। এই চক্র পরিচালিত হয় একটি রুশ ব্যাংকের মাধ্যমে এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কয়েকজন ঘনিষ্ট সহযোগীও তাতে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

রাশিয়া, ক্রাইমিয়াকে নিজেদের অংশ করে নেওয়ার পর ব্যাংক রোশিয়া নামের ওই ব্যাংকের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ব্যাংকটি কীভাবে অর্থ পাচার করে আসছিল তা ফাঁস হওয়া নথির মাধ্যমেই প্রথম জানা যাচ্ছে।

কিভাবে ফাঁস হলো নথি

অজানা সূত্র থেকে মোসাক ফনসেকার ওই ১ কোটি ১৫ লাখ নথি জার্মান দৈনিক জিটডয়েচ সাইতংয়ের হাতে আসে। পত্রিকাটি সেসব নথি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসকে (আইসিআইজে) দেয়। ১৯৭৭ থেকে ২০১৫, প্রায় ৪০ বছরের এসব নথি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার কিছু অংশ আইসিআইজে প্রকাশ করে। আগামী মে মাসে আরও নথি প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি।

কারা আছেন তালিকায়

ফাঁস হওয়া নথিতে বিশ্বের শতাধিক ক্ষমতাধর মানুষ বা তাঁদের নিকটাত্মীয়দের বিদেশে টাকা পাচার করার তথ্য পাওয়া গেছে।

তালিকায় দেখা গেছে যে চীন, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবের মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাঁদের আত্মীয় এসব অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। শুধু রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানেরাই নন, বিশ্বখ্যাত ফুটবলার লিওনেল মেসি থেকে ভারতীয় চিত্রনায়িকা ঐশ্বরিয়া রাই—তালিকায় আছে অনেকেরই নাম। আছেন অমিতাভ বচ্চনও। মেক্সিকোর মাদকসম্রাট বা সন্ত্রাসী সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কালো তালিকায় থাকা ব্যবসায়ীরাও বাদ যাননি এ তালিকা থেকে।

আফ্রিকার দরিদ্র দেশ আইভরিকোস্ট, অ্যাঙ্গোলা থেকে শুরু করে ধনী যুক্তরাজ্য—সব দেশেরই ক্ষমতাধরেরা ৪০ বছর ধরে মোসাক ফনসেকার সহযোগিতায় অর্থ পাচার, কর ফাঁকি দিয়ে দেশের বাইরে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।

ফাঁস হওয়া সেই সব নথিপত্রে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, লিবিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মুয়াম্মার গাদ্দাফী এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ পযন্ত রয়েছেন।

এসব নথি থেকে বিলিয়ন ডলার পাচারের একটি চক্রেরও সন্ধান মিলেছে। এই চক্র পরিচালিত হয় একটি রুশ ব্যাংকের মাধ্যমে এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কয়েকজন ঘনিষ্ট সহযোগীও তাতে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

রাশিয়া, ক্রাইমিয়াকে নিজেদের অংশ করে নেওয়ার পর ব্যাংক রোশিয়া নামের ওই ব্যাংকের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ব্যাংকটি কীভাবে অর্থ পাচার করে আসছিল তা ফাঁস হওয়া নথির মাধ্যমেই প্রথম জানা যাচ্ছে।

তালিকায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আছেন আবাসন ব্যবসায়ী কে পি সিং, ধনকুবের ব্যবসায়ী গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানি, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিক শিশির বাজোরিয়া প্রমুখ।

কি আছে নথিতে

আইসিআইজের ওয়েসসাইটে থাকা প্রতিবেদনে জানানো হয়, মোসাক ফনসেকার নথিতে বিশ্বের ২০০ দেশের ২ লাখ ১৪ হাজার ব্যক্তির টাকা পাচারের নথি আছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে ১৪০ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং রাজনীতিকের নাম রয়েছে। এসব ব্যক্তি বিশ্বের ২১টি কর রেয়াত পাওয়া অঞ্চলে পাঠানো টাকায় গড়ে তুলেছেন তথাকথিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, নাম প্রকাশ করা হয়নি এমন একটি সূত্র থেকে মোস্যাক ফনসেকার ওই ১ কোটি ১৫ লাখ নথি জার্মান দৈনিক সুইডয়চে সাইটংয়ের হাতে আসে। এরপর সুইডয়চে সাইটং সেসব নথি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসকে (আইসিআইজে) দেয়। আইসিআইজে- এর কাছ থেকে সেসব নথি পায় বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ ৭৮টি দেশের ১০৭টি সংবাদমাধ্যম। এখনও চলছে এসব নথির বিশ্লেষণ। সম্পদের তথ্য গোপন রেখে কর ফাঁকি দিতে মোস্যাক ফনসেকা কীভাবে হোমরা চোমরাদের সহযোগিতা দিয়ে আসছিল, তার বিবরণ এসেছে এসব নথিতে।

আদালতের নথি থেকে জানা যায়, ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দা শুরুর পর আইসল্যান্ডের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক পথে বসে। ওই তিন ব্যাংকের বন্ডে নথিতে দেখা যাচ্ছে, আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ড গুনলাগসন ও তার স্ত্রী একটি অফশোর কোম্পানির আড়ালে কয়েক কোটি ডলারের সম্পদের তথ্য এতোদিন গোপন করে এসেছেন।

আরও অনেক নামি দামি লোকের মতো আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির নামও পাওয়া গেছে মোস্যাক ফনসেকার ব্যক্তিদের তালিকায়।

গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন এসব নথিতে মেসির কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। এফসি বার্সেলোনার এই খেলোয়াড় ও তার বাবার বিরুদ্ধে স্পেনে কর ফাঁকির মামলা চলছে।

মোস্যাক ফনসেকা অবশ্য বলছে, গত চার দশকে তাদের কাজ নিয়ে কোনো সমালোচনা হয়নি। কোনো ফৌজদারি মামলার মুখেও তাদের পড়তে হয়নি।

ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)-এর পরিচালক জেরার্ড রাইল বলেন, গত ৪০ বছরে মোস্যাক ফনসেকার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের দলিল এসব নথি। এসব নথির যে গুরুত্ব, তাতে আমার মনে হয়, এটাই হবে বিশ্বে গোপন নথি ফাঁসের সবচেয়ে বড় ঘটনা।

বিদেশি কোম্পনিগুলোর মাধ্যমে ব্যাংকটি কীভাবে অর্থ পাচার করে আসছিল তা ফাঁস হওয়া নথির মাধ্যমেই প্রথম জানা যাচ্ছে। তাতে দেখা যায় সোনেত্তি ওভারসিস, ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া ওভারসিস, সানবার্ন এবং স্যান্ডালউড কন্টিনেন্টাল ভুয়া শেয়ার হস্তান্তর, মিথ্যা পরামর্শক চুক্তি, অবাণিজ্যিক ঋণ এবং অবমূল্যায়িত সম্পত্তি কেনার মাধ্যমে কীভাবে লাভবান হয়েছে।

মোস্যাক ফনসেকা অবশ্য বলছে, চার দশকে তাদের কাজ নিয়ে কোনো অবৈধ পন্থা অবলম্বনের অভিযোগ ওঠেনি, কোনো ফৌজদারি মামলার মুখেও তাদের পড়তে হয়নি।

ওই গোপন নথিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহযোগি একটি সন্দেহজনক অর্থ পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে প্রকাশ পাচ্ছে।

নথিতে দেখা যায়, রুশ প্রেসিডেন্টের অন্যতম ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু সের্গেই রোলদুগিন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া ওভারসিস এবং সোনেত্তি ওভারসিস -এর মালিক। সংগীত বাদন দলের চেলো বাদক রোলদুগিন কিশোর বয়স থেকেই পুতিনের পরিচিত, প্রেসিডেন্ট পুতিনের কন্যা মারিয়ার ধর্মপিতাও তিনি।

নথি অনুযায়ী সন্দেহের আবর্তে ভরা ওই চুক্তিগুলো থেকে রোলদুগিন ব্যক্তিগতভাবে কোটি কোটি ডলার লাভ করেছেন।

চেলো বাদক রোলদুগিন এর আগে সাংবাদিকদের কাছে তিনি ব্যবসায়ী নন বলে দাবি করেছিলেন। বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে জটিল ওই চুক্তিগুলোর সঙ্গে তার জড়িত থাকার বিষয়টি সন্দেহ এমন বাড়িয়ে তুলছে যে, তিনি হয়তো শুধুমাত্র অন্য কারো প্রতিনিধিত্ব করছেন। ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া ওভারসিস তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সময় রোলদুগিনের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্টের সম্পর্কের বিষয়টিও গোপন করে। প্রতিটি একাউন্টের আবেদনপত্রে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রোলদুগিনের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কারো কোনো সম্পর্ক আছে কিনা? উত্তরে সে ধরনের কারো সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই বলে বলা হয়েছে- যা নিশ্চিতভাবেই সত্য নয়।

নথিতে আয়ারল্যান্ড ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট এবং সৌদি আরবের বাদশার নামও আছে।

পাশাপাশি ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার তারকা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি ও চলচ্চিত্র তারকা জ্যাকি চ্যানেরও নাম আছে।

এদিকে এই কেলেঙ্কারীতে ফেঁসে যাচ্ছেন ভারতের সুপারস্টার অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ও তার পুত্রবধূ ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনসহ ভারতের নামী দামী প্রায় ৫০০ ব্যক্তিত্ব।

তবে এসব নামের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর নামটি সম্ভবত চীনা প্রেসিডেন্টের। নিজ দেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট শি। দেশটির দুর্নীতিবিরোধী এই অভিযানে দেশের শীর্ষ পদগুলোতে আসীন কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা ধরাশায়ী হয়েছেন। কিন্তু ফাঁস হওয়া নথিপত্রে সেই চীনা প্রেসিডেন্ট শি ও তার পরিবারের সদস্যদের বিদেশে গোপন ব্যাংক একাউন্ট আছে এমন ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়েছে।

ফাঁস হওয়া নথির ভিত্তিতে তৈরি গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নথিতে দেখা যায়, ফুটবল সুপারস্টার মেসি ও তার বাবা হোর্হে হোরাসি ২০১২ সালে মোস্যাক ফনসেকায় নিবন্ধিত ‘মেগা স্টার এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি কোম্পানির চূড়ান্ত সুবিধাভোগী মালিক। দেশের বাইরে কোম্পানি খুলে তা পরিচালনা বেআইনি না হলেও স্বচ্ছতার অভাব থাকায় তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এফসি বার্সেলোনার এই খেলোয়াড় ও তার বাবার বিরুদ্ধে স্পেনে কর ফাঁকির মামলার বিচার চলছে।

গার্ডিয়ান বলছে, উরুগুয়ে ও বেলিজে কিছু নামকাওয়াস্তে প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বার্সেলোনার ফুটবল তারকার ইমেজ রাইটস বিক্রির মাধ্যমে কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। তবে এই মামলায় মেগা স্টারের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

অবশ্য বাবা ও ছেলে এই অভিযোগ অস্বীকার করে দায় চাপান এক সাবেক আর্থিক উপদেষ্টার উপর। ২০১৩ সালের অগাস্টে হোর্হে মেসি স্বেচ্ছায় ৫০ লাখ ইউরো জরিমানা পরিশোধ করেন।

গার্ডিয়ান আরও বলেছে, মেগা স্টারের বিষয়ে জানতে ১২ দিন আগে মেসির যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া মেলেনি। তার বাবা আইসিআইজের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তালিকাভুক্ত বিশ্ব নেতাদের অস্বীকার

অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তিদের ওই তালিকায় যাদের নাম এসেছে তাদের অনেকেই বলছে, বিশ্বনেতাদের জটিল অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের ছক কষে তার সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি পানামা নথিতে উঠে এসেছে। কিন্তু তার অর্থ এটা ভেবে নেওয়ার প্রয়োজন নেই যে, সেগুলোর সবগুলোই অবৈধ ছিল।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ওই প্রতিবেদনের প্রধান লক্ষ্য যে, প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে রাশিয়ার রাজনীতিতে বিরাজমান স্থিতিশীল পরিস্থিতি তা বেশ পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছে। ওই নথিতে যা পাওয়া গেছে তার কিছুই বস্তুগত নয় এবং নতুন নয়।

এ বিষয়ে কোনো ধরনের তদন্তের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে পেসকভ বলেন, এই নথির পেছনে সাংবাদিকদের যে দলটি রয়েছে তাদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও সিআইএ-র সাবেক কর্মকর্তা।

প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের মুখপাত্র বলেন, ডেভিড ক্যামেরনের প্রয়াত বাবার ইয়ান ক্যামেরনের অফশোর কোম্পানির আড়ালে সম্পদের তথ্য গোপন রাখার যে তথ্য উঠে এসেছে সেটা তার ‘ব্যক্তিগত বিষয়’।

যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্য কনজারভেটিভ পার্টির কয়েকজন নেতার নামও ওই নথিতে উঠে এসেছে।

অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলে ও মেয়ের অবৈধ কিছু করার বিষয়টি বাতিল করে দিয়েছে পাকিস্তান।

এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরশেঙ্কোও।

ফাঁস করা তথ্যে নাম উঠে আসা প্রধানমন্ত্রী গুনলাগসন জানিয়েছেন, তিনি কোনো আইন ভঙ্গ করেননি এবং তার স্ত্রী আর্থিকভাবে লাভবানও হননি।

প্রকাশিত নথিতে দেখা যায়, অ্যাইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী একটি বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন, যা তিনি গোপন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিবিসি বলছে, ফাঁস হয়ে যাওয়া নথির বরাতে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ড গুনলাগসন ও তার স্ত্রী ২০০৭ সালে উইনট্রাস নামের কোম্পানিটি ক্রয় করেন। ২০০৯ সালে দেশটির পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটি থেকে পাওয়া লভ্যাংশের কথা গোপন করেছিলেন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী গুনলাগসনের স্ত্রী আনা সিগুরলাগ পালসডোটিরের সই করা একটি নথিতে দাবি করা হয়েছে, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কোম্পানিটির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

ফাঁস হয়ে যাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গুনলাগসনকে উইনট্রাসের সাধারণ আইনি ক্ষমতা দেওয়া আছে। এর মধ্যদিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তাকে কোম্পানিটি পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হয়। গুনলাগসনের মুখপাত্র দাবি করেছেন, পালসডোটির সবসময় কর কর্তৃপক্ষের কাছে তার সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। কিন্তু পার্লামেন্টের নিয়ম অনুসারে উইনট্রাসের লাভ জানানোর প্রয়োজন নেই গুনলাগসনের।

এখনও অজানা তথ্যফাঁসকারী

বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় চললেও তথ্যফাঁসকারী এখনো রয়েছেন পর্দার আড়ালেই। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অন্তরাল থেকেই কলকাঠি নেড়ে চলেছে এক অজানা সূত্র।

২০১৪ সালের শেষ দিক থেকে অজানা সূত্রটির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয় জার্মানির দৈনিক জিটডয়েচ সাইতংয় পত্রিকার প্রতিবেদক বাস্তিয়ান ওবারওয়ের। চোরা পথে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে অজানা সূত্রটি যোগাযোগ করত তার সঙ্গে। অনলাইন চ্যাটের মাধ্যমেই বেশির ভাগ সময় যোগাযোগ হতো। শত চেষ্টা করেও ওবারওয়ে অজানা সূত্রের নাম-পরিচয় জানতে পারেননি।

আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সংস্থা (আইসিআইজে) বলছে, ২০১৪ সালের শেষ দিকে ওই অজানা সূত্রটি জিটডয়েচ সাইতংয় পত্রিকার প্রতিবেদক বাস্তিয়ান ওবারওয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চোরা পথে বিভিন্ন মাধ্যমে চ্যাট করে তিনি বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের দুর্নীতির গোপন তথ্য জনসমক্ষে আনতে চান বলে জানান।

সূত্রটি বারবার সতর্ক করে তার জীবনশঙ্কা রয়েছে। ওবারমেয়ারের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হননি তিনি। চ্যাট বার্তায় ওবারমেয়ার প্রথমে জানতে চান, কত গোপন তথ্য আছে? অজানা সূত্র থেকে উত্তর আসে, যা তিনি কখনো চোখে দেখেননি।

ওবারমেয়ার বলেন, রহস্যময় এই অজানা সূত্রটি চোরা চ্যানেল দিয়ে তাকে এক কোটির বেশি নথি পাঠান। এসব নথি দিয়ে ৬০০ ডিভিডি ভরে ফেলা সম্ভব। সূত্রটি বেশ কিছু চোরা চ্যানেল দিয়ে ওবারমেয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। যোগাযোগের মাধ্যম বারবার বদলে যেত। নতুন চ্যানেলে যোগাযোগের আগে পুরোনো সব তথ্য মুছে ফেলা হতো।

জিটডয়েচ সাইতংয় পত্রিকার প্রতিবেদনে জানানো হয়, এত তথ্যের বিনিময়ে অজানা সূত্র আর্থিক বা অন্য কোনকিছু চাননি। চেয়েছেন কেবল নিজের নিরাপত্তা ।

ওবারমেয়ার বলেন, ওই অজানা সূত্রের নাম-পরিচয় কিছুই জানেন না তিনি। তবে তার সঙ্গে এত যোগাযোগ হয়েছে যে তিনি অনেকটাই চেনা হয়ে গেছেন।

তদন্ত করার ঘোষণা, পদত্যাগের দাবি

বিশ্বের হোমরাচোমরা ব্যক্তিদের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস করার পর নড়েচড়ে উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ এসব ঘটনার তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া ফাঁস হওয়া তথ্যের অন্যান্য দেশগুলোর মানুষ সে দেশের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন। দাবি উঠছে তদন্তের ও বিচারের। কয়েকটি দেশ তদন্তের ঘোষণাও দিয়েছে।

আইসিআইজের ওয়েসসাইটে থাকা প্রতিবেদনে জানানো হয়, মোসাক ফনসেকার নথিতে বিশ্বের ২০০ দেশের ২ লাখ ১৪ হাজার ব্যক্তির টাকা পাচারের নথি আছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে ১৪০ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং রাজনীতিকের নাম রয়েছে। এসব ব্যক্তি বিশ্বের ২১টি কর রেয়াত পাওয়া অঞ্চলে পাঠানো টাকায় গড়ে তুলেছেন তথাকথিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।

তালিকায় নাম থাকা আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ডুর ডেভিড গুনলাগসনের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল সোমবার রাজধানী রেইকজাভিকের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে। মোসাক ফনসেকার ফাঁস হওয়া তথ্যে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রী কোটি কোটি ডলার ফাঁকি দিতে দেশের বাইরে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন, যেখানে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে সিগমুন্ডুর পদত্যাগ না করার বিষয়ে অবিচল।

২০০৮ সালে আইসল্যান্ডের ব্যাংক ব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে, তখন দেশটির এই প্রধানমন্ত্রী গোপনে কোটি কোটি ডলারের ব্যাংক বন্ডের মালিক হয়েছেন।

মোসাক ফনসেকার সম্পদশালী ৮০০ মক্কেলের বিষয়ে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে অস্ট্রেলিয়া। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে। স্পেনের বিচার বিভাগীয় সূত্র জানায়, স্পেন এরই মধ্যে আইনি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ পাচার-বিষয়ক তদন্ত শুরু হয়েছে।

কেলেঙ্কারির ঘটনার কারণে আলোচিত পানামাও বিষয়গুলো তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। জানিয়েছে, যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে এবং আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে, আর তা প্রমাণিত হয়, তাহলে পুরস্কৃত করা হবে। পানামার প্রেসিডেন্ট জুয়ান কার্লোস বলেছেন, আন্তর্জাতিক তদন্তে পানামা সহযোগিতা করবে। একই সঙ্গে তিনি দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন।

বিশ্ব ফুটবলের উজ্জ্বল নক্ষত্র লিওনেল মেসি ও তাঁর বাবার নাম আছে এ তালিকায়। নথি অনুযায়ী, বাবা-ছেলে মিলে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মেগা স্টার এন্টারপ্রাইজের নামে অর্থ পাচার করেছেন। এখন স্পেনে কর ফাঁকি দেওয়ার একটি অভিযোগ আছে মেসির বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা ও অবমাননাকর।

তালিকায় এসেছে রাশিয়ার শক্তিধর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বন্ধু সের্গেই রোলদুগিনের নামও। তাঁর বিরুদ্ধে ২০০ কোটির বেশি ডলার পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ দাবি করেন, তথ্য ফাঁসকারী সাংবাদিকেরা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক কর্মকর্তা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘পুতিন, রাশিয়া, আমাদের দেশ, আমাদের স্থিতিশীলতা ও আসন্ন নির্বাচনকে লক্ষ্য করে এসব খবর রটানো হচ্ছে; বিশেষ করে পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে।’

তালিকায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কোর নাম থাকলেও তিনি কোনো ভুল করেননি বলে দাবি করেছেন। তবে তাঁকে অভিশংসনের মুখে পড়তে হতে পারে।

এ ছাড়া লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে ১৯৮৩ সালে চার কোটি ডলার মূল্যের ব্রিটিশ সোনা-রুপার বার ডাকাতির ঘটনায় লাখ লাখ ডলার ফাঁকির দেওয়ার বিষয়ে পানামার একটি শেল কোম্পানি সহায়তা করেছে।

পানামার একটি আইনি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা রামোন ফনসেকা এএফপিকে বলেন, নথি ফাঁস হওয়া ‘একটি গুরুতর অপরাধ’ এবং ‘পানামার ওপর হামলা’।

সাধুবাদ, বিশেষ কমিশন হচ্ছে

বিশ্বনেতাদের অনেকেরই অর্থ পাচারের তালিকায় নাম উঠে এলেও কোনো কোনো বিশ্বনেতা এই তালিকা প্রকাশকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ তালিকা প্রকাশকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে ৫০০ ভারতীয়র নাম প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মোদির এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছেন, এর তদন্তে বিশেষ কমিশন গঠন করা হবে।

এখন পর্যন্ত প্রকাশিত নথিতে বাংলাদেশের কারও নাম নেই। তবে আগামী মে মাসে সম্পূর্ণ নথি প্রকাশ করা হলে বাংলাদেশের কারও নাম আছে কি না, জানা যাবে। এর আগে আইসিআইজে ২০১৩ সালে অর্থ পাচারের একই ধরনের তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেখানে বাংলাদেশের ৩৪ জনের নাম ছিল। তাঁদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরাও ছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর