দেশাত্মবোধ ও ইসলাম

দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ একটি বহুমাত্রিক অনুভূতির বাহ্যিক প্রকাশ। দেশের প্রতি যার অন্তরে ভালোবাসা রয়েছে, দেশের মঙ্গলসাধনে অব্যাহত প্রচেষ্টা তার সহজাত বিষয়। প্রকৃত দেশপ্রেমিক দেশের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে হলেও নিজের দেশপ্রেমের প্রমাণ দেয়। দেশ তার একজন সন্তান এবং নাগরিকের কাছে এ ধরনের ত্যাগ ও নিবেদনই প্রত্যাশা করে। অনুকূল পরিবেশে দেশের জন্য দরদ দেখাতে পারেন সবাই। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে দেশের জন্য সামান্য কিছু করতে পারাও অনেক বড় বিষয়। চরম প্রতিকূল পরিবেশে হজরত নবী করিম (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি বারবার ঘুরে মক্কার প্রান্তর, পাহাড়, বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি!’ দশ বছর পর যখন প্রায় বিনাযুদ্ধে তিনি বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন, তখনও তার মহানুভব হৃদয়ে ছিল স্বদেশে ফিরে আসার কোমল ও পবিত্রতাপূর্ণ এক আকুতি। নিজের দেশের মাটিতে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসে প্রতিশোধহীনতার এক আকাশ-উঁচু চেতনার বাণী তিনি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি আজ কোনো প্রতিশোধ নেই।’ দীর্ঘ তেরো বছর শত জুলুমে, উত্পীড়নে বিদ্ধ হওয়ার পরও দেশটি ফিরে পাওয়ার পর স্বদেশবাসীর প্রতি এই অভিব্যক্তি ও সর্বোচ্চ সদাচার ছিল একজন মহান দেশপ্রেমিকের। দেশ ফিরে পাওয়ার আনন্দে তিনি নিজের ব্যক্তিগত সব আবেগ-ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলেছিলেন। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কাছে ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও আবেগ তুচ্ছ। দেশের স্বার্থে শত্রুকেও সে আপন করে নিতে পারে।

ইসলামে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়ার কথা বলা হয়েছে। নববী আদর্শে গড়া সাহাবায়ে কেরামও স্বদেশকে খুব ভালোবাসতেন। হিজরতের পর মদিনায় হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় তাদের মনে-প্রাণে নিজের দেশ মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তারা জন্মভূমি মক্কার দৃশ্যগুলো স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। নবী করিম (সা.) সাহাবিদের মনের এ দুরবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়েও বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন।’ (বুখারি)

দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আহ্বান করেছেন সাহাবায়ে কেরাম সর্বতোভাবে এ ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তারা জানতেন, নিজেদের বিশ্বাস, আদর্শ ও ধর্মমতের প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তারা যেমন আন্তরিক ছিলেন, তেমনি নিবেদিত ছিলেন দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায়। ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ মানুষকে স্বদেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশপ্রেমিক নাগরিক নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। যুগে যুগে দেশপ্রেমিক নাগরিকরা নিজের সর্বস্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন ও সুরক্ষার আন্দোলন করে গেছেন। বিশেষত যাদের ধর্ম ইসলাম, বিশ্বাসে যারা শেষ নবির অনুসারী, তাদের কাছে দেশ ও জাতির জন্য আত্মত্যাগ ও বিসর্জনের দৃষ্টান্তে ইতিহাসের পাতা ভরপুর। নিজ দেশের ওপর আঘাত এলে আদর্শ ও বিশ্বাসের ধারকরাই সর্বপ্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ইসলামের প্রেরণা যাদের ভেতরে কাজ করে তারা দেশ ও জাতির যেকোনো দুর্দিনে সর্বাত্মক বিসর্জনের মানসিকতা পোষণ করেন।

স্বাধীনতার কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি রয়েছে। যেমন জাতীয়তাবোধ, দেশাত্মবোধ, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য। কোনো জনগোষ্ঠী নিজেকে স্বাধীন জাতি হিসেবে তখনই ভাবতে পারে যখন তার মধ্যে জাতীয় চেতনাবোধ, ঐক্য ও সংহতি, আত্মনির্ভশীলতা, আত্মবিশ্বাস স্বাধীনতার—এসব মৌল উপাদান মোটাদাগে থাকে। ইসলাম স্বাধীনতার প্রতি যেমন গুরুত্ব দিয়েছে, তেমনি স্বাধীনতা সুরক্ষার প্রতিও রয়েছে ইসলামের জোরালো তাগিদ। দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি সদস্যের ওপর স্বাধীনতা সুরক্ষার পবিত্র দায়িত্ব বর্তায়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য যেমন একজন নাগরিকের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকবে, তেমনি রাষ্ট্রের ইমেজ যেন কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকেও থাকবে তার সতর্ক দৃষ্টি। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ থাকলেই কেবল একজন নাগরিক প্রকৃত অর্থে নাগরিকের মর্যাদা লাভ করতে পারে।

সাড়ে চার দশক আগে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র লাভ করেছি। স্বাধীনতা মহান প্রভুর অন্যতম বিশেষ দান। যারা পরাধীন তারাই শুধু জানেন, স্বাধীনতার মূল্য কত বেশি। স্বাধীন প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্ট মানুষের পক্ষে পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকা অসহনীয় ব্যাপার। যেহেতু আমরা অসহনীয় একটি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছি এজন্য স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। স্বাধীন দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আরও কিছু দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তায়। সে দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করলেই একজন নাগরিক আদর্শ নাগরিকের খেতাব পায়।

ইসলামের চোখে একজন আদর্শ নাগরিক রাষ্ট্রের মূল্যবান সম্পদ। নাগরিকের অব্যাহত প্রচেষ্টা থাকবে দেশ ও জাতির কীভাবে উন্নতি করা যায়। নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে হলেও দেশের জন্য, নিজের জাতির জন্য কিছু করার মানসিকতা থাকতে হবে। রাষ্ট্র তার নাগরিকের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি ভাববে, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ভাবনা থাকবে—কীভাবে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যে দেশের নাগরিক যত সভ্য ও সুশীল, সে দেশ তত উন্নত ও অগ্রসর। নাগরিকের দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। নাগরিকের দায়িত্বহীনতা ও অনগ্রসরতা যেকোনো দেশকে পিছিয়ে দেয়। চেতনার দিগন্ত সমৃদ্ধ ও বলিষ্ঠ না হলে দেশ এবং জাতির জন্য কিছু তো করা যায়ই না, বরং এমন নাগরিক দেশের জন্য বোঝা।

ব্যক্তির সমষ্টির মাধ্যমেই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য চাই ব্যক্তির আন্তরিকতা ও চেতনাবোধ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নাগরিকের। দেশ স্বাধীন করার চেয়ে দেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার দায়িত্ব অনেক বেশি। আর শুধু সীমানা অক্ষুণ্ন থাকলেই স্বাধীনতা টিকে থাকে না, প্রতিটি নাগরিককে বলিষ্ঠ চেতনায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হয়। নৈতিক মূল্যবোধে চিড় ধরে, এমন কোনো কাজ সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। এজন্য জাগ্রত বিবেক ও বলিষ্ঠ চেতনার আধার হতে হয় একজন আদর্শ নাগরিককে। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পেরিয়ে গেছে। এ মুহূর্তে আমাদের প্রত্যেককে ভাবতে হবে, আমরা সত্যিই কি আদর্শ নাগরিক হতে পেরেছি? দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেমের যথার্থ উপস্থিতি কি আমাদের মধ্যে আছে? আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা এখনও পাইনি। কারণ আদর্শ নাগরিকের সংখ্যা অনেক কম। প্রকৃত দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ আছে খুব কম লোকের মধ্যেই। এজন্য সবার প্রচেষ্টা থাকা চাই—নিজে আদর্শ নাগরিক হওয়া এবং অন্যকে আদর্শ নাগরিক ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা। এটাই ইসলামের শিক্ষা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর