চলনবিলে পানি নেই

ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে শুকনো মৌসুমের শুরুতেই দেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক জলাধার চলনবিল পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো শুকিয়ে গেছে। উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার, নদীর মুখে অপরিকল্পিত স্লুইসগেট, ক্রস বাঁধ ও কালভার্ট নির্মাণ, ড্রেজিং না করা ও দখলের কারণে চলনবিলের প্রায় ১৬টি নদী ও ৩২টি খালের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একসময় যেখানে বছর জুড়ে পানি থাকত, শুকনো মওসুমে সেখানে এখন এক ফোঁটা পানিও মেলে না।

এ অঞ্চলের অধিকাংশ গরিব চাষি আগে এসব নদী থেকে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতেন। নদীগুলো মরে যাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এতে মারাত্মক সেচ সঙ্কটে পড়েছেন চলনবিলের কৃষকরা। এর ফলে কৃষি মৌসুমে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নদ-নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।

‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ বই থেকে জানা যায়, চলনবিলে ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ৩৯টি বিল, ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী ও ১২০ বর্গকিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৩২টি খাল আছে। চলনবিল অঞ্চলের নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে- বড়াল, গুমানী, আত্রাই, গুড় নদী, করতোয়া, তুলশি, চেচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা ও খুবজীপুর তেলকুপি। ৩২টি খালের মধ্যে নবীর হাজার জোলা, হক সাহেবের খাল, নিমাইচরা বেশানী খাল, বেশানী গুমানী খাল, উলিপুর, সাঙগুয়া খাল, দোবিলা খাল, কিশোরখলি খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাড়ি, গোহালা নদী, গাড়াবাড়ি দারুখালী খাল, বিলসূর্য, কুমারডাঙ্গা, জানি গাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের জোলা, পানাউল্লাহর খাল উল্লেখযোগ্য। নদীগুলোর গড় প্রস্থ ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ফুট।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিবছর নদী দিয়ে এ বিলে প্রায় ৬৩ লাখ ঘনমিটার পলি বাহিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে ১৫ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজিং না করায় চলনবিলের নদ-নদীগুলোর প্রস্থ ও গভীরতা কমে যাচ্ছে। বর্তমানে চলনবিলের বিভিন্ন স্থানের গভীরতা কমবেশি ১.৫৩ মিটার থেকে ১.৮৩ মিটার। বিলের নদীগুলোর প্রস্থ ও গভীরতা কমে আত্রাই নদীর দৈর্ঘ্য ২৫০ বর্গমাইল, নাগর নদী ১ হাজার ৫০০ বর্গমাইল, গুমানী ১ হাজার ৬০০ বর্গমাইল, বড়াল ১ হাজার ২০০ বর্গমাইল, নন্দকুজা ১ হাজার ৫০০ বর্গমাইল, ভাদাই ৯০০ বর্গমাইল, বানগঙ্গা ৮০০ বর্গমাইল, গুড় নদী ৬০০ বর্গমাইল, কমলা ৭০০ বর্গমাইল, রক্তাই ৪০০ বর্গমাইল, দুর্গাদই ৫ বর্গমাইল, চিকনাই ৮ বর্গমাইল, বিলসূর্য ৭০০ বর্গমাইল, তুলসীগঙ্গা ২ হাজার ৬০০ বর্গমাইলে দাঁড়িয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. রেদওয়ানুর রহমানের নদী বিষয়ক বই থেকে জানা যায়, ২০-২৫ বছর আগেও চলনবিলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোতে সারা বছর ধরেই কমপক্ষে ৬-৭ ফুট পানি থাকত। ফলে বছর জুড়েই নৌযান চলাচল করত। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব, বিলের মধ্য দিয়ে যত্রতত্র রাস্তা, স্লুইসগেট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, নদী দখল করে বসতি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরির ফলে নদীগুলো সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন বলেন, দেশের দুই বৃহৎ নদী পদ্মা-যমুনা ও বৃহত্তম বিল চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগকারী নদী হলো বড়াল। এটি রাজশাহীর চারঘাটে পদ্মার শাখা হিসেবে উৎপন্ন হয়ে ২২০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে চলনবিলের ভেতর দিয়ে মুসা খাঁ, নন্দকুজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির হুরাসাগর হয়ে যমুনায় মিশেছে। কিন্তু ১৯৮০ সালে নদীর উৎসমুখে ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে বড়াইগ্রামের আটঘরিয়ায় মাত্র এক গেটের একটি স্লুইসগেট নির্মাণ, পাবনার চাটমোহরে তিনটি ক্রস বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে প্রমত্তা বড়াল বর্তমানে মরা খালে পরিণত হয়েছে।

বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘বড়ালসহ চলনবিলের নদী রক্ষায় এলাকাবাসীর আন্দোলনের মুখে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। নদীবিষয়ক টাস্কফোর্স ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় বড়াল নদীর সব বাধা অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে পাউবো চাটমোহরে তাদের স্থাপনা সরানোর কাজ শুরু করেছে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) রাজশাহী সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাজিদুর রহমান বলেন, ‘নদীতে বাঁধ বা স্লুইসগেট নির্মাণে নদীর নাব্যতা কমার ধারণা ঠিক নয়। উজানে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে একতরফা পানি টেনে নেওয়ায় পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বড়ালসহ চলনবিল এলাকার নদীগুলোর নাব্যতা কমে গেছে। এটি একটি জাতীয় সমস্যা। তবে নদীর দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালু আছে। সেটি আরো জোরদার করা হবে।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর