খনন না হলে মরেই যাবে সুরমা

সিলেট শহরকে দুই ভাগ করেছে যে নদীটি তার নাম সুরমা। এ নদীর উপরে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ক্বিনব্রিজকে কেন্দ্র করে নগরের একপাশে উত্তর সুরমা অন্যপাশ দক্ষিণ সুরমা নামে খ্যাতি পায়। আর দুই সুরমার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যুগ যুগ ধরে সুরক্ষা করে যাওয়া নদীও সুরমা বলে জানেন এ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু গত ৫২ বছর ধরে সুরমা নদীর পানিপ্রবাহ কমেছে সাড়ে ৯৭ ভাগ।

সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, ২০ বছর পর হয়তো আর পানিই থাকবে না ঐতিহ্যঘেরা সুরমা নদীতে। বারবার খননের উদ্যোগ নেয়া হলেও রহস্যজনক কারণে খনন হচ্ছে না সুরমা নদীর। দিনদিন নদী ভরাঠের কারণে হয়তো একদিন মরেই যাবে সুরমা।

নদী ভরাটের কারণে একদিকে যেমন সুরমার পানি কমছে তেমনি সিলেট নগরসহ আশপাশ এলাকায় পানির সংকট চরমভাবে দেখা দিচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে পানির স্তর কমছে। নতুন কোনো টিউবওয়েল বসানো হলে পানির স্তর পেতে হিমশিম খেতে হয়। ২০ বছর আগে যেখানে নতুন টিউবওয়েল বসালে ৫০ থেকে ৬০ ফুটের মধ্যে পানির স্তর পাওয়া যেত সেখানে এখন ৩২০ ফুটেও বিশুদ্ধ পানির স্তর পাওয়া যায়না।

surma 1বিষয়টির সাথে একমত প্রকাশ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. জহির বিন আলম পূর্বপশ্চিমবিডিডটকমকে বলেন, ‘সুরমা নদীকে আমাদের প্রয়োজনে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নদীতে অবর্জনা ফেলা, নদী দখল করা, দীর্ঘদিন থেকে নদী খনন না করার কারণেই আজ সিলেটের মানুষ অল্পস্তরে পানি পাচ্ছেন না। ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরো প্রকট হতে পারে।

তিনি বলেন, পানির স্তর কমে যাওয়ার আরো একটি কারণ হলো রাস্তাঘাট পাঁকা অথবা আরসিসি করার পর পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় পানি নিচে যেতে পারেনা, আর দ্বিতীয়টি হলো সুরমা নদী খনন না করা। সুরমাকে বাঁচাতে হলে সুরমার উৎসমূখ খনন করে পানি প্রবেশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সিলেটে পানির সমস্যা সমাধান করতে হলে সুরমাকে বাঁচানোর বিকল্প নেই।’

দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমার বর্তমান অবস্থা এমন শীতকাল এলেই নদীটি প্রায় শুকিয়ে যায়। জেগে ওঠে অনেক স্থানে চর। কোনো কোনো স্থানে নদীর বুকে শিশুদের ক্রিকেট খেলতেও দেখা যায়। নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে তারপরও হচ্ছে না খনন করা।

অপচনশীল পলিথিন, নগরের আবর্জনাও এখন ঠাঁই পায় সুরমার বুকে। নদী নয় যেন সুরমা এখন নদর্মায় পরিনত হচ্ছে।

একদিকে খনন বিহীন সুরমা হচ্ছে ভরাট আর অন্যদিকে আবর্জনা আর অপচনশীল পলিতিন সুরমার পানি হচ্ছে দূষিত। যা বর্তমানে মানুষের ব্যবহারের আনুপযোগী হয়ে পড়ছে। স্রোতের নদী সুরমার বুকে অনেক স্থানেই এখন পানি নেই। হারিয়ে গেছে নদীর স্রোতও। বছরের ১২ মাস যার বুকে স্রোতের কলকল ধ্বনি বহমান থাকতো, তার বুক এখন স্রোতহীন। স্রোতের কলকল সেই মধুর ধ্বনি এখন আর শোনা যায় না সুরমা তীরে গেলে। দখল, দূষণ আর দীর্ঘদিন খনন না করায় একসময়কার স্রোতস্বিনী সুরমা এখন যেন মৃত্যু পথযাত্রী।

দক্ষিণ সুরমার কুশিঘাট, নগরী শাহজালাল ব্রিজের নিচ, গোলাপগঞ্জের বৈইটিকড় এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সুরমার বুক এখন শুকিয়ে গেছে। পরিণত হয়েছে এসব স্থান বিশাল মাঠে। আর নদীতে যতটুকু পানি রয়েছে তাতে মানুষ হেঁটেই যাতায়াত করতে পারছেন।

নগরের ক্বিনব্রিজ এলাকা, কাজিরবাজার, ছড়ারপাড়, ক্বিনব্রিজের দক্ষিণ পাশ, কদমতলী, বরইকান্দি, কুচাইসহ যেসব এলাকার পাশ দিয়ে বহমান সুরমা এসব স্থানে পানিও মানুষ ব্যবহার করতে পারছেন না। অপচনশীল পলিথিন, আর আবর্জনা ফেলার কারণে ওইসব এলাকায় পানি দূষণ এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, মানুষ এখন সুরমার পানি ব্যবহার করে হতে হচ্ছে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। আর পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুরমার পানি মারাত্মক দূষণ করা হচ্ছে। এসব বন্ধ করে সুরমাকে বাঁচাতে হবে।

নগরের বিভিন্ন এলাকার আবর্জনার ফেলতে ডাস্টবিন হিসেবে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সুরমা নদীকে। পলিথিনে সয়লাব এখন নদীগর্ভ। দূষণ আর পানিশূণ্যতার কারণে সুরমায় নেই আগেরমত মাছও। বছরের বেশিরভাগ সময় সুরমার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন জেলেরা।

surma-river-46464এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, সুরমা নদী অনেক আগেই তার নাব্যতা হারিয়েছে। সুরমা নদী সিলেটের ঐতিহ্য। নদীটির খনন কাজ হয়নি। খনন করানো জরুরি হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, আগে নদীতে আবর্জনা ফেলে পানি নষ্ট করা হয়েছে। এখন তা করা হচ্ছে না। নগরীর অবর্জনা এখন সিসিক কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ সুরমার পারাইচকে ফেলছেন। তারপরও সুরমা নদী কালের গর্ভে হারাতে বসেছে। আগের মত সুরমার মাছও পাওয়া যায়না।

তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুরমা নদীর খনন কাজ করানো দরকার।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, নদী খনন না করায় সুরমা নাব্যতা হারাচ্ছে। নদী খননের ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই; খনন করতে উদ্যোগ নিতে হবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে। সুরমা নদী সিসিকের যে সব এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে আমরা সেসব এলাকার আবর্জনা পরিস্কার করি। এরপরও অনেকে অাবর্জনা নদীতে ফেলেন। বিভিন্ন সংগঠন এ বিষয়ে যখন সচেতনতামূলক কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তখন সিটি কর্পোরেশন তাদেরকে সহযোগিতা করে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর