পাল্টে গেছে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ধারা

পীর হাবিবুর রহমান :
একটা সময় ছিল দু-চার বছর পর জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন হতো। কেন্দ্রীয় নেতারা যেতেন, কাউন্সিলর ডেলিগেটরা উৎসবমুখর পরিবেশে অংশ নিতেন। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য সাংগঠনিক দক্ষতার ওপর অভিজ্ঞ স্থানীয় নেতারা তুমুল প্রতিযোগিতায় মুখোমুখি হতেন। কেন্দ্রীয় নেতারা সম্মেলন উদ্বোধন করতেন। উদ্বোধনীর পর রাজনৈতিক দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতা করতেন। স্থানীয় অন্য নেতাকর্মীরাও উপস্থিত হতেন।

দ্বিতীয় পর্বে হতো অধিবেশন। জেলা ও উপজেলার নেতারা ছাড়াও কাউন্সিলররা এতে অংশ নিতেন।
পুরনো নেতৃত্ব বহাল রাখলেও কাউন্সিল অধিবেশনে সাবজেক্ট কমিটিতে ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। এমনকি কর্মীদের প্রাণচাঞ্চল্য নেতৃত্বের প্রতিযোগিতামূলক তুমুল উত্তেজনার ভেতর দিয়ে গভীর রাতে কেন্দ্রীয় নেতারা জেলা নেতৃত্বের নাম ঘোষণা করতেন। কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মেনে নেয়ায় বাকিরা ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে ঘুমে যেতেন। দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চায় দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচন করা না গেলে কাউন্সিলরদের গোপন ভোটে নেতা নির্বাচন করা হতো।

হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ দুটি সম্মেলনেই কাউন্সিলরদের ভোটে নেতা নির্বাচন হয়েছেন। সিলেটে হয়েছেন আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব। কিন্তু সিলেটে সর্বশেষ জেলা কমিটি ঘোষণাকালে মরহুম ইফতেখার আহমেদ শামিমের বিদায় পর্বটি কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।

২৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন কার্যত এক স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশে পরিণত হয়েছিল।
শীতের শেষে ঢাকা থেকে প্রতিবারের মতো যাওয়া বরদইবিলে এক কথায় হাওর ভ্রমণপিপাসু মেহমানদের জন্য যেতে হয়েছিল। বিকালে শহরে গিয়ে প্রবেশমুখে টানা দুই ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হয়েছে। মানুষ বলেছেন, আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা কিংবা খালদা জিয়ার সমাবেশে এই শহরে এত মানুষ আসেনি। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সম্মেলনে এসেছিলেন বলেই এত মানুষের ঢল নেমেছিল, তাও ঠিক নয়।

তিন কারণে এই সম্মেলনে হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল। এক, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে যারা ব্যবসা-বাণিজ্যে ফায়দা নিচ্ছেন, তারা লোকসমাগম ঘটিয়েছেন। দুই, জেলার দলীয় চারজন সংসদ সদস্য তাদের সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শন করেছেন সম্মেলনে নির্বাচনী এলাকার লোকবল এনে। তিন, দীর্ঘ ১৭ বছর পর সম্মেলন হওয়ায় সংগঠনের পোড় খাওয়া নেতাকর্মীরাও সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করেছেন উৎসাহ-উদ্দীপনায়।

জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সেবার আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। সভাপতি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মী নির্লোভ সৎ রাজনীতিবিদ আব্দুজ জহুর। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনীতি দিয়ে আওয়ামী লীগে দীর্ঘ সিঁড়ি হাঁটা আইয়ুব বখত জগলুল। ২০০১ সালের নির্বাচন ঘিরে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায়, দুই প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতার গ্রুপিংয়ের শিকার হয়ে অব্যাহতি পান তিনি। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন নুরুল হুদা মুকুট। ওয়ান ইলেভেনে আব্দুজ জহুর ইন্তেকাল করলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মতিউর রহমান। এদের বিরুদ্ধে সম্মেলন না করার, সংগঠনকে কুক্ষিগত করার, ইচ্ছেমতো পকেট থানা কমিটি গঠনসহ দলীয় ক্ষমতাকে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহারের অভিযাগ ছিল। কিন্তু এ ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল আওয়ামী লীগের মূল ধারা। জেলার প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা মরহুম আবদুস সামাদ আজাদেরই নয়, তারা ছিলেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত। অন্যদিকে জেলার দলীয় একজন সংসদ সদস্যও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে উঠে আসেননি।

ন্যাপ রাজনীতি থেকে আসা প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। কিন্তু তার ছায়ায় গণতন্ত্রী পার্টির রাজনীতি করে আসা এমপি মহিবুর রহমান মানিক, আমলা থেকে এমপি-প্রতিমন্ত্রী হওয়া আবদুল মান্নান, হাইব্রিড কোটায় আসা এমপি রতন, ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি থেকে উঠে আসা মহিলা এমপি শাহানা রব্বানী ও রাজনীতিতে নাবালক জেলা পরিষদ প্রশাসক ইমন একাট্টা হয়ে চেয়েছিলেন বর্তমান নেতৃত্বের পরিবর্তন। অন্তত জেলা সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুটকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া ছিল তাদের লক্ষ্য। জেলা সদরে এই গ্রুপটির কোনো ভিত্তি না থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে তারা কেন্দ্র ও স্থানীয় পর্যায়ে তৎপরতা চালিয়েছিলেন। জেলা প্রশাসক পদে যখন নুরুল হুদা মুকুটের নাম চূড়ান্ত, তখন নাটকীয়ভাবে স্থানীয় রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা না রাখা ইমন নিয়োগ নিয়ে এসে প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে মতিউর রহমানকে বাদ দিয়ে দল তাকে সদর আসনে মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগ কর্মীরা নুরুল হুদা মুকুটের পক্ষে বিশাল শোডাউন করেন। আসনটি পরবর্তীতে জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলে মতিউর রহমানকে বাদ দিয়ে ইমনকেই পুনরায় জেলা পরিষদে নিয়োগ দেয়া হয়। এবারের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কোনো কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়নি। কাউন্সিলররা স্লোগান তুলেছিলেন মুকুটের নামে।

নেতাকর্মীরা চেয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন এলে দুবারের পৌর মেয়র আইয়ুব বখত জগলুল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন। কিন্তু সম্মেলনের সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক বক্তৃতা শেষে যখন সভাপতি পদে মতিউর রহমানের নাম ঘোষণা করলেন, তখন কর্মীরা করতালিতে অভিষিক্ত করলেন। সাধারণ সম্পাদক পদে ইমনের নাম ঘোষণা হতেই সম্মেলনস্থলে না না ধ্বনি তুলে ব্যাপক বিক্ষোভ, চেয়ার ছোড়াছুড়ি ও নেতাদের দিকে মারমুখী হয়ে ওঠেন কর্মীরা। পুলিশ পাহারায় নেতারা চলে গেলেও শহরে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। দলীয় কর্মীদের চোখেমুখে নামে হতাশা ও অশ্রু। প্রশ্ন উঠেছে, দলে অসংখ্য নেতা থাকতে স্থানীয় রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ও ভূমিকা না রাখা ইমনকেই কেন ঘুরেফিরে আনা হচ্ছে? তিনি বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য। তার আরেক ভাই খায়রুল কবির রুমেনকে দলের অনেক অনভিজ্ঞ আইনজীবীকে বাদ দিয়ে পিপি (সরকারি কৌঁসুলি) পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ইমনের স্ত্রীকে সামনে উচ্চ আদালতে নিয়োগদানের চিন্তাভাবনা চলছে। সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞ সিনিয়র নেতাদের আত্মমর্যাদার সঙ্গে সম্মানজনক পদ নিয়ে রাজনীতি করার পথই অনেকটা রুদ্ধ হয়ে গেছে। কবেইবা গঠিত হবে পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি?

শুধু সুনামগঞ্জে নয়, অন্যান্য জেলায়ও দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ট্র্যাডিশন ভেঙে সম্মেলনের সমাবেশেই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা হচ্ছে। এক সময় সেনা শাসকদের হাতে তৈরি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলকে উপেক্ষা করে স্থানীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের যে পথ গ্রহণ করে এসেছে, সেটিই এখন ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছে! একটি গণমুখী রাজনৈতিক দলের চরিত্র কী তবে আওয়ামী লীগ হারাতে বসছে? পর্যবেক্ষকদের প্রশ্ন, কেন্দ্রের পছন্দ থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে কাউন্সিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দিতে আপত্তি কোথায়? জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের যখন এই চিত্র সেখানেই উল্টোটি ঘটেছে সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির সম্মেলনে। সেখানে কাউন্সিলরদের গোপন ভোটে নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। এতে যারা আগে কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হতেন তারা গোপন ভোটে পরাজিত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঐতিহ্যবাহী তৃণমূল বিস্তৃত গণতান্ত্রিক দল। এই দলটি শুধু এদেশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়নি, নানা উত্থান-পতন ও আত্মত্যাগের সিঁড়িপথে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। দলের কঠিন দুঃসময়ে নেতাকর্মীরা খেয়ে না খেয়ে ভোগবাদী রাজনীতির বিপরীতে পথ হেঁটেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান স্বাধীনতার সংগ্রামের পথে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ধীরে ধীরে সাংগঠনিক দক্ষতায় মুসলীম লীগের কবর রচনা করে আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় দলে পরিণত করেছিলেন। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দলটির ওপর দমন-পীড়নের খড়গ, নেতৃত্বের কোন্দল ও ভাঙা-গড়ার খেলা শুরু হলে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দলের নেতৃত্বে এসে দীর্ঘ সংগ্রামের পথে আওয়ামী লীগকে আরেক দফা চূড়ান্ত বিকশিতই করেননি, জনপ্রিয় করে ২১ বছর পর ৯৬ সালে গণরায় নিয়ে ক্ষমতায় আনেন। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। গরিবের দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত। দেশ ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা হেলিকপ্টার ভাড়া করে সম্মেলনে যাচ্ছেন, সমাবেশে কমিটি ঘোষণা করে উড়ে আসছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, জেলা সম্মেলনে অতীত ট্র্যাডিশন কেনইবা ভেঙে দেয়া হচ্ছে?

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর