প্রেম মানে কী

পীর হাবিবুর রহমান:

পেশাদার রিপোর্টার থাকতে চারদিকে দৌড়ঝাঁপ করে দুপুরের খাবারটা নিয়মিত জাতীয় প্রেসক্লাবেই খেতাম। সেই সময় জাতীয় প্রেসক্লাবকে সেকেন্ড হোম মনে হতো। অর্ধেক জীবন পার করে প্রথম হোম, সেকেন্ড হোম কোনোটাই মনে পড়ে না। মনে হয় চিরনিদ্রার ঘরখানিই সামনে। বসন্ত এলে সকাল থেকেই প্রাণ আকুল করা কোকিলের ডাক আমার মন প্রাণ উদাসই করে না শরীরটাকে নির্জীব করে দেয়। গাছে গাছে পাখিরা যতোই ভালোবাসাবাসি করুক আমার ভেতর শুধু হু হু করে ওঠে। এই বসন্তের কদিন থেকে শরীর মন একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে। রোজ সকালে জানালার বাইরে কোকিল যখন ডাক পাড়ে আমার শুধু মনে হয় এই দিনটা কেন আসে?

পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে ওঠার পর থেকে তিনটি জায়গা থেকে পাঠ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। প্রকৃতি, মানুষ ও বই। সবচেয়ে ভালোবেসেছি নির্মল আড্ডা আর আমার একমাত্র পেশা সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতার হৃৎপিন্ড বা সংবাদপত্রের বাদশা হলো রিপোর্ট। শুরু থেকেই আপাদমস্তক অস্থিমজ্জায় ছিলাম রিপোর্টার। ‘একুশ শতকের কান সংবাদপ্রধান’। উনিশ শতকের শেষ থেকেই খবরের সন্ধানে নিরন্তর ছুটেছি আমি। রিপোর্টার থেকে কলামিস্ট হয়ে ওঠার জায়গাটি বরাবরই ইবাদতের মতো গ্রহণ করেছি। এই জায়গাটিতে সর্বোচ্চ সুখ আমি পেয়েছি।
যে বয়সে তরুণকে বালিকার কাজল কালো চোখ আর চিবুক চুঁইয়ে পড়া হাসির মাধুর্য চুম্বকের মতো টানে সেই বয়সটা আমাকে টেনেছে ছাত্রমিছিল। যে বয়সে তরুণকে টানে প্রেমিকার উষ্ণ আলিঙ্গন, সেই বয়স ভালোবাসার জালে আটকেছে খবরের বারান্দা।

আজকাল রবীন্দ্রভক্তের মতো জীবন কেটে যাচ্ছে বিরহ যাতনায়। নষ্টালজিয়া, বিরহ কাতরতা, আগ্রাসী ভাবে আঁকড়ে ধরেছে আমাকে। আমার প্রেমিক রোমান্টিক খবরসন্ধানী অনুসন্ধিৎসু হৃদয় বড়োই তৃষ্ণার্ত। কী এক অন্তহীন হাহাকার আমাকে না আড্ডায় টানছে, না লেখা ও বইয়ের ভুবনে ডুবতে দিচ্ছে। কাঙালের মতো নিঃসঙ্গ হৃদয় আমার কি জানি খুঁজে ফেরে। একজন জানতে চাইলেন আমার কি মন ভাল নেই? বললাম ‘না’। পরামর্শ দিলেন হজ্ব করে আসতে। আরেকজনের পরামর্শ কোথাও ঘুরে আসা, বিশ্রামে যাওয়া। অতি আপন একজন বললেন- দুহাতে লিখতে! পরামর্শ দানের অভাব যদি পৃথিবীতে কোনও দেশে না থাকে সে আমার দেশ। এবং সহজলভ্যও বটে। পরামর্শ নিতে সম্মানী দিতে হয় না।

জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে একবার বের হতেই তোপখানা রোডে একদল ভিখিরিকে পেয়েছিলাম। এর মধ্যে এক ভিখিরি আরেক ভিখিরিকে বলছে, ‘গায়ে জ্বর, মাথা ব্যথা। আজ আর ভিক্ষে করবো না, চলে যাবো।’ অন্য ভিখিরি বলছে,‘চলে গেলে খাবে কি? প্যারাসিটামল খেয়ে নে।’ থমকে দাঁড়িয়ে এক পথচারী বলে উঠলেন ‘শালার দেশটাতে ফকিরের চেয়ে ডাক্তার বেশি।’
আমাদেরও হয়েছে সেই অবস্থা। নিজের দায়িত্ববোধের চেয়ে অন্যকে পরামর্শ দানে বেশি তৃপ্ত হই। আমার চঞ্চল শৈশব, দস্যি কৈশোর, খ্যাপাটে তারুণ্য। অবাধ্য দুপুরে সাতার কেটেছি। সবুজ মাঠ হাওরে বিস্তীর্ণ জলরাশি উপভোগ করেছি জোৎস্নায় ভিজতে ভিজতে। মুষলদারে নেমে আসা বৃষ্টিতে গা ধইতে ধুইতে ফিরেছি ঘরে। বেদনা বুকে নিয়ে ইনসমোনিয়ায় কত রাত কাটিয়েছি। আমি জানি আমার অন্তর কি চায়।

বেশি কিছু চাইনি আমি। একটু সচ্ছল জীবন, দুহাত খুলে লেখা, কণ্ঠ ছেড়ে বলা। গণতন্ত্রের পাঠ আমি নিয়েছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। একটি স্বাধীন আবাসভূ্মিই তিনি দেননি, জীবন যৌবন উৎস্বর্গ করে একটি জাতিকে শিখিয়েছিলেন- গণতন্ত্র ও অধিকার আদায়ে আত্মদান করার সংগ্রাম আর মাথা উঁচু করে বাঁচা। রবীন্দ্রনাথের ‘সত্য সে যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ চিন্তা ও চেতনায় নিয়েছি আমি। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের উক্তি ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে পারি’ হৃদয়াঙ্গম করেছি। কহলিল জিব্রান বলেছেন- ‘প্রেমহীন রুটি বিস্বাদ।’ অতিসাধারন মানুষ হলেও বিশ্বাসি করি আমার কথাই শেষ কথা নয়। কিন্তু আমি যা লিখি, আমি যা বলি তা আমার হৃদয়মিশ্রিত। সেখানে প্রেমের আকুতি থাকে। মন মানে না, যুক্তি মানেনা, নিজে বিশ্বাস করি না এমন কিছু পাঠক বা শ্রোতার সামনে উপস্থাপন করতে পারি না। প্রসব বেদনা একজন নারীকে যতটা কষ্ট দেয় তারচেয়ে বেশি পোড়ায় আমাকে লিখতে না পারার যন্ত্রনা, বলতে না পারার দহন। এক সপ্তায় চারটি টকশোর আমন্ত্রণ ‘না’ করেছি। যারা লেখার পরামর্শ দেন তাদের প্রশ্ন করি, মানিক মিয়া কি বেঁচে আছেন, আমাকে লিখতে দেবেন? সময়টা আমার জীবনের সবচেয়ে ক্রান্তিকাল ছিল। দুঃসহ বেকারত্ব, চারদিকে প্রতিরোধ, হৃদযন্ত্রে বসেছে রিং, ভিতরে তুমুল অস্থিরতা। প্রখ্যাত কার্ডিওলিস্ট ড. মুমেনুজ্জামান চেক আপ করতে করতে একদিন বললেন- মানসিক অস্থিরতা, অশান্তি আপনার শত্রু। কোথাও লিখতে না পারেন, ব্লগে লিখুন। উত্তরে বললাম- একজন পীর হাবিবুর রহমান ব্লগে লেখার জন্য জন্ম নেয়নি। তিনি অবাক হয়ে তাকালেন এবং বুঝলেন।

প্রেম আসলে কী? একটি হৃদয়কে হৃদয় দিয়ে বোঝা এবং তাকে ধারণ করা? প্রেম মানে কি একটি হৃদয়কে আরেকটি হৃদয়ের তৃষ্ণা নিবারণ করা এবং তাকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া? আহমদ ছফা বলেছিলেন ‘যে সমাজ কিছু পাগলকে (প্রথাবিরোধী মানুষ) ধারণ করতে পারে না সেই সমাজ বসবাস যোগ্য নয়।’ একটি গণতান্ত্রিক সমাজের ধর্মই হলো সব মত ও পথের মানুষকে ধারণ করা।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর