আগুনমুখী স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক

কার্ফু দিয়েও ঘরে রাখা যাচ্ছিল না বাঙালিকে। ক্রমেই বেগবান হয়ে উঠছে আন্দোলন। ঘর ছেড়ে পথে নামছে নানা পেশার ও বয়সের মানুষ। চারদিক প্রকম্পিত হচ্ছে -‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি আগুনমুখী স্লোগানে। পাকিস্তান সরকার তাই ফন্দি আঁটল গোপনে বাঙালি নিধনের।

আজ ৪ মার্চ। একাত্তরের এ দিনে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ও গণহত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধুর ডাকা সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় পূর্ব পাকিস্তানে। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এ হরতালে অচল হয়ে পড়ে বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা।

ঢাকায় অকার্যকর কারফিউ তুলে নিতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু বহাল রাখে খুলনা ও রংপুরে। ঢাকা বিমানবন্দরে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় দিনভর চলে ব্যারিকেড রচনার কাজ। ঢাকার সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত মুমূর্ষুদের রক্ত দিতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঢাকা মেডিকেলের সামনে ভিড় জমায় শত শত মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয় হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে।

২ মার্চ থেকে হরতাল চলছিল খুলনায়। দিনে শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সামনে এক বিরাট শোভাযাত্রার ওপর গুলিবর্ষণ করে সেনাবাহিনী। শহীদ হন ছয় জন। আহত হন বেশ কয়েকজন। বিক্ষুব্ধ জনতা পাকসেনাদের গাড়িবহর প্রতিরোধের জন্য পথে পথে ইটের দেয়াল, গাছের গুঁড়ি ও ট্রেনের বগি ফেলে এবং বাস-ট্রাক রেখে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে।

দৌলতপুরে ছাত্র-জনতার একটি মিছিলের ওপর বোমা নিক্ষেপকারি একজনকে পিটিয়ে মারে উত্তেজিত জনতা।

বিক্ষোভে জ্বলতে থাকা চট্টগ্রামের অবস্থার আরও অবনতি হয় আজ। দিনভর চলে বাঙালি-অবাঙালির মধ্যকার সংঘর্ষ। দু’দিনের সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২০ জনে। এদের মধ্যে ধারালো ছুরি ও গুলিতে মৃত্যু হয় ১০০ জনের এবং ২০ জনের মৃত্যু হয় হাসপাতালে।

সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আজ থেকেই রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ ও পাকিস্তান টেলিভিশন ‘ঢাকা টেলিভিশন’ হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে। সংগ্রাম চলাকালীন বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেন বেতার ও টেলিভিশনের শিল্পীরা।

৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু বলেন, যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পাননি শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।

অপর এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোনো জাতির মুক্তি আসেনি।

বিবৃতিতে উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্ববানে সাড়া দেয়ায় বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান।

বাড়তে থাকে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সংহতি।

ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে পৃথক বিবৃতি দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ শিক্ষক।

পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব ও তকমা বর্জন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, মুনীর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ইব্রাহীম খাঁ, কবি আহসান হাবীব, কথাশিল্পী জয়েনউদ্দিনসহ অনেকেই।

পাকিস্তান সরকারের শোষণ ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভ-আন্দোলনের জন্য বীর বাঙালিকে অভিনন্দন জানান বঙ্গবন্ধু।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবি জানান।

পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে।

অন্যদিকে, করাচী প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষা করতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।

পিডিপি প্রধান নূরুল আমীনও এক বিবৃতিতে ১০ মার্চ অনুষ্ঠেয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্টের প্রতি অবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহ্বানের দাবি জানান।

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড এ ভুট্টো করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, দেশের সংহতির জন্য তাঁর দল যদ্দুর সম্ভব ৬-দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তানের বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির অবসানের জন্য তিনি এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজি হবেন কী না- এ প্রশ্নের জবাবে জনাব ভুট্টো বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটছে। এ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবো।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর