জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর্মি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাই

কর্নেল জাফর ইমাম (অব.)… ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ মুহূর্তে আমি ছিলাম পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, পাকিস্তান ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে চাকরিরত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত পদাতিক বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার অফিসার। আমার ইউনিট ছিল ২৪-এফ. এফ রেজিমেন্ট। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ২৬ মার্চ রাতে আমার সঙ্গে আরেকজন বাঙালি অফিসারকে নিরস্ত্র করে বন্দী অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম থেকে আমাকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বদলির উদ্দেশ্যে আরও কয়েকজন অফিসারসহ হেলিকপ্টারযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে।

হেলিকপ্টারটি ঢাকা পুরাতন বিমান বন্দরে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবার অগোচরে আমার হ্যান্ডবাগ নিয়ে এয়ারপোর্ট টয়লেটে ঢুকে তাৎক্ষণিকভাবে ইউনিফর্ম খুলে সিভিল পোশাক পরিধান করে ঝটপট টয়লেট থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টের গেটের বাইরে চলে আসি। তখন এমন একটা ভাব দেখাচ্ছিলাম যে, যদি ধরা পড়ে যাই, তাহলে বলব, আমি ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য আর্মি ট্রান্সপোর্ট খুঁজছি, না পেলে সিভিল ট্যাক্সি অথবা বেবিট্যাক্সিতে ক্যান্টনমেন্টে চলে যাব— এই উত্তর দেব (যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে)। চলার পথে ছোটখাটো এ ধরনের আরও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছিল। সম্ভবত, পরের দিন ’৭১-এর এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ অথবা তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে (সঠিক তারিখ মনে নেই) আমরা কুমিল্লার কসবা সীমান্ত অতিক্রম করি। সেখান থেকে আমরা ভারতের মেলাঘরে ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সেদিন সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এমএজি ওসমানীও উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদের সবার সঙ্গে আলিঙ্গন করলেন। বললেন শাবাশ। এবার আমরা ২ নম্বর সেক্টরকে সুসংহত করতে পারব বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। আমাকে প্রথম অবস্থায় পাঠালেন বিলোনিয়া সেক্টরে। যেদিন আমি বিলোনিয়াতে আসি ওই দিন আমার সঙ্গে ছিলেন কর্নেল আকবর ও ক্যাপ্টেন আমিনুল হক। উদ্দেশ্য ছিল— আমাকে বিলোনিয়া সেক্টরে রেখে তারা চলে যাবেন অন্য অঞ্চলে। তাই হলো। তারা কয়েকদিন আমার সঙ্গে অবস্থান করার পর চলে যান ২ নম্বর সেক্টরের অন্য রণাঙ্গনের দায়িত্বে।

আমি বিলোনিয়াতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সিন্ধু ও বিলোনিয়া সেক্টরের বিএসএফ কমান্ডার মেজর প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং ওই অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থান জেনে নিই। আমি যেহেতু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদাতিক বাহিনীর অফিসার ছিলাম ওই কারণে ওই সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনায় মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করে পাক হানাদার বাহিনীকে মোকাবিলা করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ লক্ষ্য করলাম। আমিও আমার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করলাম এ ব্যাপারে। সম্ভবত এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ হবে, আমি মেজর প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে ওই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করার কাজ শুরু করলাম। ৩-৪ দিনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা (ছাত্র, শ্রমিক, জনতা) ও প্রাক্তন ইপিআর বাঙালি সৈনিক, পুলিশ এদেরকে একতাবদ্ধ করে মোটামুটি ২ নম্বর সাব সেক্টর গঠন করে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে সামরিক অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। ভারত সীমান্তের রাজনগর ও বড় কাসারিতে পর্যায়ক্রমে স্থাপন করলাম আমাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ হবে।

আমরা শুরু করলাম পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন সামরিক ও গেরিলা অভিযান। ফেনীর দিকে মুখ করে বিখ্যাত মুন্সিরহাট ডিফেন্স তৈরি করে পজিশন গ্রহণ করি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মুন্সিরহাট ডিফেন্সকে শক্তিশালী মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে পরবর্তীতে ফেনী মুক্ত করা। এর পাশাপাশি বৃহত্তম নোয়াখালীতে সুবেদার লুত্ফর রহমান, শ্রমিক নেতা রুহুল আমীন ও অন্য আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় সংগঠিত করতে থাকলাম বৃহত্তম নোয়াখালীর বিভিন্ন থানার মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা নিজ অঞ্চলে থেকে নিজস্ব এলাকাতে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। কারণ ওইসব অঞ্চলের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা গ্রুপ ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ প্রত্যেকটি মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন যোগাযোগ সম্ভব ছিল না। তাই আমরা তাদের কমান্ডার ও ওইসব অঞ্চলের তৎকালীন আওয়ামী লীগ এমপি ও নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে সামরিক ও গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতাম। এসব নেতার মধ্যে নূরুল হক, হানিফ, মুহম্মদ আলী, তালেব আলী, কচি ভাই, ছাত্রনেতা বেলায়েত, রশিদ এমপি, সফদার এমপি, কালু ভাই এমপি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সেদিন বাংলাদেশের ভিতরে এই গ্রুপগুলোকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র ও বিভিন্নভাবে পাক হানাদার বাহিনীর খবরাখবর দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছিল, তাই তাদের আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অবশ্যই স্বীকৃতি দেব। মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে যদিও এদের তৎপরতা খুব সীমিত আকারে ছিল কিন্তু যুদ্ধ শেষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এরা ছিলেন সদা সজাগ তত্পর। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি সেক্টরগুলো ও কে, জেড, এস, ফোর্সগুলোর রেগুলার বাহিনী ও বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো (তৎকালীন ইপিআর পুলিশ ও অন্যদের সমন্বয়ে গঠিত) ফিরে গেল ক্যান্টনমেন্টে। ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তীতে এলাকাভিত্তিক গণবাহিনী/মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত হতে থাকল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ/মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সংগঠন। যারা স্বাধীন বাংলা সরকারের বিভিন্ন সেক্টর ও কে, জেড, এস, ফোর্স-এর অধীনে বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোর নেতৃত্বে মূল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তারাও ওইসব আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনগুলোতে নাম লেখাতে বাধ্য হলো। অবশ্য অনেকে আজও এসব সংসদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে গঠিত বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নেই। এ ছাড়া সংসদ ও এসব সংগঠন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। তাই বাংলাদেশের সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধার প্রতিনিধিত্ব এরা দাবি করতে পারেন না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর