রক্তে নাচিয়ে নতুন দ্রোহ এলো উত্তাল মার্চ

এলো অগ্নিঝরা উত্তাল মার্চ। পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে বাঙালির রক্তক্ষরণের মাস এটি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে, একাত্তরের এ মাসেই শুরু হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বেয়নেটের সামনে বুক চিতিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি। লড়েছিল বীর দর্পে। বুকের রক্তে ভাসিয়ে মাটি, এনেছিল স্বাধীনতা। বাতাসে উড়েছিল লাল সবুজ পতাকা। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মুখ তুলে দাঁড়িয়েছিল- বাংলাদেশ।

এ বছর মার্চ এলো এক নতুন দ্যোতনা নিয়ে, রক্তে নাচিয়ে নতুন দ্রোহ। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ায় দীর্ঘদিন বুকের ভেতর পুষে ছিল যে ক্ষোভ ও যন্ত্রনা, অনেকটাই লাঘব হয়েছে দেশের মানুষের। ইতিমধ্যেই চার যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বিচারাধীন রয়েছে আরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বিশ্ব আরেকবার অবাক চোখে দেখছে অকুতোভয় বাঙালিকে। অসাম্প্রাদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মানে এখনো একাট্টা মানুষ। মার্চ আরো বেশি সুসংহত করবে তাদের।

একাত্তরের সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের দাবিতে এখনো পথে মানুষ। শাহবাগের গণজাগরণ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, গোটা দেশে, দেশের বাইরেও। মানুষ জেগেছে, জাগছে। কিন্তু থেমে নেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধে ধর্মীয় মৌলবাদী চক্রের মরন কামড়, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র। তবুও পিছু হটছে না মানুষ, হটবেও না। এ লড়াইয়ে জিততে হবে- মার্চের আগুনবাতাসে ছুটছে সে বার্তা।

বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বিনষ্টে এখনো সক্রীয় উগ্র মৌলবাদী চক্র। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী। বারবার হামলা হচ্ছে। খুন হচ্ছে মুক্তচিন্তার প্রগতিশীল লেখক- প্রকাশক। বিশ্বে বাংলাদেশকে উগ্র জঙ্গিরাষ্ট্র প্রমাণে চেষ্টা চলছে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংস্কৃতি নষ্টের। কিন্তু সে ষড়যন্ত্র বানচাল করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জোট বেঁধেছে শুভবোধ মানুষ। মার্চ সে সম্মিলনকে আর দৃঢ় করার ব্রত নিয়ে এলো।

একাত্তরের মার্চে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধ- অনিবার্য হয়ে উঠেছিল বাঙালির জন্য। জন্মলগ্ন থেকেই পুর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের। মোট জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের।

বাঙ্গালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরও নিপীড়ন ছিল তাদের। তার উদাহরণ- রাষ্ট্রভাষার উর্দুর ঘোষনা।

সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন অংশে সমগ্র বাহিনীর মাত্র ৫ শতাংশ ছিল বাঙ্গালি অফিসার। পাকিস্তানের বাজেটের একটি বড় অংশ সামরিক খাতে বরাদ্দ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এর সুফল পেত খুবই কম।

১৯৬৫ সালে কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, বাঙালির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি আরও বাড়িয়ে দেয়।

রাজনৈতিক ক্ষমতাও কুক্ষিগত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতেই। বারবার নানা অজুহাতে পদচ্যুত করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের। বিশেষ করে ১৯৫৮ সাল থেকে টানা ১১ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের অনৈতিক ক্ষমতা দখল, দুরত্ব বাড়ায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভোলার সাইক্লোনে বিপর্যস্ত মানুষের প্রতি পাকিস্তান সরকারের নিষ্ঠুরতা, পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে আরো বেশি ক্ষুব্ধ করে তোলে।

১৯৭০ সালের পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন স্পষ্ট করে তোলে দুই পাকিস্তানের বিভাজন। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সরকার গঠন করতে দেওয়া হয় না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন থেকে ঘোষনা দেন স্বাধীনতার। স্বাধীনতার আকাঙ্খায় উত্তাল হয়ে পড়ে গোটা জাতি।

রাজনীতির নামে চলতে থাকে পাকিস্তান সরকারের সময়ক্ষেপণ। অবশেষে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে বাঙ্গালি নিধনযজ্ঞের সবুজ সংকেত দিয়ে, গোপনে যাত্রা করে পশ্চিম পাকিস্তানে। সে রাতেই বাঙালি নিধনযজ্ঞে নামে পাকিস্তান সেনাদের ‘অপারেশন সার্চলাইট’। মাত্র এক রাতেই কেবল ঢাকা শহরেই হত্যা করে অন্তত ৫০ হাজার ঘুমন্ত মানুষকে।

প্রতিরোধে জ্বলে উঠলো বাঙালি। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। এগিয়ে এলো ভারত। চললো টানা ন’মাসের যুদ্ধ। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান। প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র- বাংলাদেশ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর