আইন লংঘনের প্রতিযোগিতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে শিক্ষাসংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধান লংঘনের হিড়িক পড়েছে। দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকরা এ প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছেন। এতে শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় নানা ধরনের আইন ও বিধিবিধান জারি করে। এসব আইন-কানুন মেনে চলার বিষয়ে বাধ্যবাধকাও আছে। কিন্তু শুধু অবৈধ অর্থ উপার্জনের নেশায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিধিবিধান উপেক্ষা করছেন অধিকাংশ স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা। ফলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবৈধ অর্থ আয়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অভিভাবকদের কাছ থেকে ছলে বলে কৌশলে আদায় করা হচ্ছে অর্থ। সেই অর্থ নিয়ে চলে হরিলুট। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোর নজরদারি নেই বলে অভিযোগ অভিভাবকদের।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে শিক্ষায় যেসব সমস্যা নজরে পড়ছে, একসময় তা ধরাই হতো না। আমরা এগুলো চিহ্নিত করে তা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আইন ও বিধিবিধান করেছি। এসব বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমরা ইতিবাচক ফল পাচ্ছি। সমাজে একটি নড়াচড়া শুরু হয়েছে। অভিভাবকরা সচেতন হয়েছেন। অধিকার আদায়ে তারা আন্দোলন করছেন। শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বিবৃতি দিচ্ছেন। বিচার বিভাগকেও পাশে পাচ্ছি। আসলে অশুভ শক্তির বিনাশে আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এই প্রক্রিয়াতে অশুভ দূর হবে।’
যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইন লংঘনের দায়ে শাস্তি হয় না। ফলে এ প্রবণতা কমছে না উল্টো বেড়েই চলেছে। এ বাস্তবতায় এগুলো কাগুজে আইন ও বিধিবিধানে পরিণত হয়েছে। বিশিষ্ট নাগরিকরা বিদ্যমান আইন-কানুন প্রয়োগে কঠোর হতে সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন। তারা বলেন, মূলত বিদ্যমান আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে শিক্ষা ব্যবসার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের কাজ হচ্ছে জনগণকে সুরক্ষা দেয়া। শিক্ষায় সুশাসন নিশ্চিতে যে আইন ও বিধান আছে তা যথেষ্ট। এখন তা বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন জোরদার মনিটরিং। প্রয়োজনে সাবেক শিক্ষাবিদ, অভিভাবক ও সাংবাদিকদের নিয়ে সরকার কমিটি গঠন করতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার যেসব বিধিবিধান বেশি লংঘিত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে, এসএসসি ফরম পূরণে সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করা। বছরের শুরুতে বিভিন্ন ফি আদায় এবং ভর্তির ক্ষেত্রে নীতিমালা লংঘনের ঘটনা ঘটে। কোচিং নীতিমালা লংঘন মহামারী আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া আরও যেসব প্রজ্ঞাপন, পরিপত্র ও নির্দেশনা অহরহ লংঘন হচ্ছে তার অন্যতম হল- শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেয়া, যৌন নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের নির্দেশনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্যসংবলিত নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরি করা। ছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ও পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা, স্থাপন, শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিদ্যমান বিধিবিধান অহরহ লংঘন করছেন এক শ্রেণীর শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ।
এসএসসি-এইচএসসির ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘটনা অনেকটাই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর নভেম্বর-ডিসেম্বর এ দুই পরীক্ষার ফরম পূরণের কাজ হয়। তখন স্কুল-মাদ্রাসায় বলতে গেলে বাড়তি অর্থ আদায়ের প্রতিযোগিতা চলে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে যুগান্তরে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন আমলে নিয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলনিশি জারি করেন। তখন ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে সরকারের মন্ত্রী, একাধিক এমপি এবং সচিবকে হাইকোর্টে তলব করা হয়েছিল। ওই সময় হাইকোর্ট বাড়তি ফি ফেরতের নির্দেশনা দেন। কিন্তু ওই নির্দেশনাও অনেক প্রতিষ্ঠান মানেনি বলে অভিযোগ করেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের চেয়ারম্যান জিয়াউল কবীর দুলু।
এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময় শিক্ষা বোর্ডগুলো হাইকোর্টের ওই নির্দেশনা স্মরণ করিয়ে দেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। তাতেও খুব বেশি কাজ হয়নি। অনেক প্রতিষ্ঠান বাড়তি ফি আদায় করেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের ওপর একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশের ৩ হাজার ৩৮টি স্কুল-মাদ্রাসা বাড়তি ফি নিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী গত ৩ ফেব্র“য়ারি সংবাদ সম্মেলন করে এসব প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি ফি ফেরতের নির্দেশ দেন। কিন্তু মন্ত্রীর ওই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে মাত্র ৮৩০টি প্রতিষ্ঠান।
সরকার প্রতিবছর নভেম্বর মাসে পরবর্তী বছরের ভর্তি নীতিমালা প্রকাশ করে। কিন্তু এটি লংঘনের ঘটনা অজস্র। চলতি বছরও জানুয়ারি মাসে ভর্তিকালে বিভিন্ন ধরনের ফি সরকারের নীতিমালা লংঘন করে আদায় করা হয়েছে। এ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) তদন্তে সত্যতা বেরিয়ে এসেছে। একই নীতিমালায় শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য শূন্য আসন সংখ্যা আগে ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু এটিও মানা হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল ও ভিকারুননিসা স্কুল এবার নীতিমালা লংঘন করেছে। এ নিয়ে মাউশি ইতিমধ্যে দুই সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে।
সরকারের আইন হচ্ছে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীকেই কেবল শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা যাবে। কিন্তু খণ্ডকালীনসহ নানা নামে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধন সনদ না থাকা প্রার্থীকে নিয়োগ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ১১ ধরনের শারীরিক শাস্তি দেয়া নিষিদ্ধ করে ২০১১ সালের ৯ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনও স্কুলে স্কুলে এই শাস্তি দেয়ার প্রবণতা আছে। ২০১২ সালের ২০ জুন জারি করা হয় কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা। কিন্তু প্রায় শতভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কোচিং চলছে। ২০১০ সালে পাস করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে আউটার ক্যাম্পাস অবৈধ। কিন্তু এখনও ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় অবৈধভাবে এবং কয়েকটি আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে আউটার ক্যাম্পাস চালাচ্ছে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, একজন শিক্ষক ক্লাসে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীকে কোচিংয়ে প্রলুব্ধ করেন। তার সঙ্গে আর ফাইল আটকে ঘুষ নেয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আসলে এটা গোটা সমাজেরই নেতিবাচক চিত্রের অংশ। আমরা আর্থিকভাবে উন্নত হয়েছি। এখন নৈতিকভাবে উন্নতি আর সংস্কৃতিমনা মানুষ গড়ে তুলতে না পারলে এসব অন্যায় দূর হবে না।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর