‘নির্দয়’ ভবন ব্যানবেইস

অবসরকালীন আর্থিক সুবিধা পাওয়ার জন্য কোনো কোনো শিক্ষক আবেদন করেছিলেন পাঁচ বছর আগে। এর মধ্যে কেউ কেউ মারাও গেছেন। এখনো পাওনা মিটিয়ে দেয়া হয়নি তাদের পরিবারের কাছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীরা ২৫-৩০ বছর চাকরি জীবন শেষে শূন্য হাতে ঘরে ফিরছেন। অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট দফতরে বছরের পর বছর চক্কর কেটেও যৎসামান্য আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না। তদবির আর ঘুষ ছাড়া ওই দফতরে ফাইল নড়ে না। মামার জোর অর্থাৎ মন্ত্রী, এমপি, সচিব ও প্রভাবশালীদের সুপারিশে জীবদ্দশায় কোনো কোনো শিক্ষক এই সুবিধা পেয়ে থাকেন। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কাছে তাই রাজধানীর পলাশী মোড়ে শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ‘নির্দয়’ ভবন হিসেবে পরিচিত।
পাবনার সুজানগরের উদয়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মো. জহরুল হক ২০১২ সালে স্ত্রী, দুই সন্তান ও বৃদ্ধ মাকে রেখে মারা যান। পরবর্তী সময়ে তার স্ত্রী স্বামীর অবসর সুবিধা পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও প্রাপ্য সুবিধা পাননি। তার বড় ছেলে বর্তমানে ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজে একাদশ শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়া করছে। মৃত শিক্ষকের স্ত্রী মোছা. সুফিয়া খাতুন বলেন, সংসারে উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই। সামান্য জমিতে চাষাবাদ করে যে আয় হয়, তা সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এই আয়ে দুই সন্তানের পড়ালেখা, অসুস্থ  বৃদ্ধ শাশুড়ি নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। অবসর সুবিধার প্রাপ্য টাকা ব্যাংকে ডিপোজিট করে পাওয়া অর্থে সংসারে কিছুটা স্বস্তি আনত।
সরেজমিন দেখা গেছে, ব্যানবেইস ভবনের নিচতলায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ড এই প্রতিষ্ঠান দুটির দফতর। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে শিক্ষকরা তাদের আবেদনের বিষয়ে খোঁজ নেন। অবসরের টাকা তুলতে এসে নানা ধরনের হয়রানির মুখেও পড়তে হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের। কখনো কখনো ‘ঘুষ’ দিতে হয় এমন অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহারও পান তারা। আবার সামান্য কাগজের ঘাটতির কথা বলেও হয়রানি করা হয়। কর্মচারীরা জানিয়ে দেন, ফান্ডে টাকা নেই, অপেক্ষা করতে হবে।
গত রোববার দফতর ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষকদের হাজার হাজার আবেদন পাটের বস্তাবন্দি। প্রতিদিন শিক্ষক-কর্মচারীদের আবেদন জমা পড়ছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। যদিও সেখানে ছয়জন বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) কর্মকর্তা প্রেষণে আছেন বলে দফতরের এক কর্মচারী জানান। ওই কর্মচারী আরো বলেন, অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যাপক আসাদুল হক প্রতিদিন মধ্যাহ্নের পর অফিসে আসেন। ওইদিন শিক্ষক নেতা আসাদুল হককে আর দফতরে পাওয়া যায়নি। চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা শিক্ষক মাহতাব উদ্দিন বলেন, তার পরিবার চরম আর্থিক সমস্যার মধ্যে আছে। কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা থেকে প্রাপ্য অর্থে তিনি তার বড় ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে চেয়েছিলেন। যাতে তার অবর্তমানে বড় ছেলে সংসারের হাল ধরতে পারেন। কিন্তু এটা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, কয়েকবার ঢাকায় এসে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাকে বলা হয়েছে, টাকা পেতে আরো দুই-আড়াই বছর অপেক্ষা করতে হবে। রংপুরের শিক্ষক আবদুস সালাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন। প্রতিদিন ১০০ টাকার ওষুধ প্রয়োজন হয়। তিনি টাকাটা পেলে স্থায়ী আমানতে ব্যাংকে জমা রাখতে চেয়েছিলেন। তা থেকে যে লাভ পাওয়া যেত ওই টাকায় তার ওষুধ ও হাত খরচের টাকা হয়ে যেত বলে তিনি জানান। তিনি এক বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নেন।
জানা গেছে, অবসরের পর সর্বশেষ বেতন স্কেলের সমপরিমাণ ধরে যত বছর চাকরি তত মাসের বেতন দেয় কল্যাণ ট্রাস্ট। আর এর তিন গুণ টাকা দেয় অবসর সুবিধা বোর্ড। অর্থ সংকটের কারণে অবসরপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষক-কর্মচারীকে টাকা দিতে পারছে না অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট। ইতিমধ্যে কল্যাণ ট্রাস্টে ১৭ হাজার ৯০০ এবং অবসর বোর্ডে ২২ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন পড়ে আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২৬ হাজার এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মূল বেতনের ২ শতাংশ অর্থ কল্যাণ ফান্ডে এবং ৪ শতাংশ অর্থ অবসর সুবিধার জন্য কেটে নেয়া হয়। সেই হিসাবে কল্যাণ ট্রাস্টের ফান্ডে জমা হয় আট কোটি টাকা। আর অবসর ফান্ডে জমা হয় ১৭ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও কৃষি ব্যাংকে এসব টাকা প্রতি মাসে জমা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধে কল্যাণ ফান্ডের ১৭-১৮ কোটি টাকা এবং অবসর বোর্ডের ৫৬-৫৮ কোটি প্রয়োজন পড়ে। কল্যাণ ফান্ডের এক হিসাবে জানা গেছে, জাতীয় বেতন স্কেল-২০০৯ অনুযায়ী একজন অধ্যক্ষ বেতন পান ২৫ হাজার ৭৫০ টাকা। তিনি চাকরিকালে বেতনের ২ শতাংশ হারে ৬২ হাজার ৬৭৫ টাকা চাঁদা দেন। অবসরে তিনি ৬ লাখ ১৫ হাজার ৫২৮ টাকা প্রাপ্য হন। সহকারী থেকে অধ্যক্ষ যে কোনো পদধারী শিক্ষক ৯ গুণিতক হারে কল্যাণ সুবিধা প্রাপ্য হন। কল্যাণ ফান্ড ও অবসর সুবিধা বোর্ডের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে শিক্ষকরা শূন্য হাতে ঘরে ফিরছেন। প্রতি মাসেই আর্থিক সংকট আরো প্রকট হচ্ছে। এ অবস্থায় সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে দুই দফতরই বারবার টাকা চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু মানবকণ্ঠকে বলেন, অর্থ সংকটে শিক্ষক-কর্মচারীদের পাওনা নিয়মিত পরিশোধ করা যাচ্ছে না। প্রতি মাসে শিক্ষকদের পাওনা পরিশোধে ১৭-১৮ কোটি টাকা প্রয়োজন; সেখানে শিক্ষকদের কাছ থেকে ২ শতাংশ হারে প্রতি মাসে সাড়ে আট কোটি টাকা ফান্ডে জমা হয়। তিনি বলেন, অসুস্থ, মুক্তিযোদ্ধা, কন্যাদায়গ্রস্ত ও হজযাত্রী এই চার ক্যাটাগরির শিক্ষকরা স্বল্প সময়ে কল্যাণ ট্রাস্টের সুবিধা পাচ্ছেন। তিনি বলেন, কল্যাণ ফান্ডে শিক্ষকরা প্রতি মাসে ২ শতাংশ হারে চাঁদা দেন, এর সঙ্গে সরকার থেকে আরো ২ শতাংশ চাঁদা দিলে আর্থিক সংকট থাকে না। শিক্ষকদের সময়মতো প্রাপ্য টাকা পরিশোধ করা যায়।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর