ড. ইউনূসের তিন শূন্য তত্ত্ব

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে পৃথিবী। বাড়ছে জনসংখ্যা, অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণে বদলে যাচ্ছে জলবায়ু ও বায়ুমণ্ডল। ফলে ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হচ্ছে পৃথিবী। এ অবস্থায় বর্তমান বিশ্বকে নিরাপদ করতে হলে ‘তিন শূন্য তত্ত্ব’ বাস্তবায়ন করতে হবে। এগুলো হলো- দ্রারিদ্র্য ও বেকারত্বকে শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা আসতে হবে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ নামিয়ে আনতে হবে শূন্যে। এসব চ্যালেঞ্জ অর্জনে ৪টি মহাশক্তি সহায়তা করতে পারে। সেগুলো হলো- যুব বা তারুণ্য শক্তি, তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক ব্যবসা এবং সার্বজনীন সুশাসন প্রতিষ্ঠা।
গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, চীনের রাষ্ট্রদূত এইচ ই মা  মিংকিয়াং, ঢাকায় সফরকারী মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সিনিয়র কনসালটেন্ট শারিফাহ হাপসাহ শাহাবুদ্দিনসহ ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। দিবসটি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একটি ভিডিও বার্তা পাঠান। ইউনূস সেন্টারের আয়োজনে ৬ষ্ঠ ‘বার্ষিক সামাজিক ব্যবসা দিবস’ এটি। এবারের দিবসের বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘আমরা চাকরি প্রত্যাশী নই, চাকরি দাতা-বেকারকে উদ্যোক্তায় রূপান্তর’।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে এ অনুষ্ঠানে ১,৬০০ ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন, যাদের মধ্যে ৩০টি দেশ থেকে ২৫০ জনেরও বেশি বিদেশী প্রতিনিধি অংশ নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন গ্রামীণ আমেরিকার প্রধান নির্বাহী অ্যান্ড্রিয়া জাং, গ্রামীণ ক্রিয়েটিভ ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হ্যানস রিটজ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালেক্স কাউন্টস, গ্রামীণ অস্ট্রেলিয়ার চেয়ারম্যান পিটার হান্ট, ইউগ্লেনা জাপানের প্রধান নির্বাহী মিতসুরো ইজুমো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেকার কলেজের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জনসন, নেপালের চৌধুরী ফাউন্ডেশন ও নেপাল সামাজিক ব্যবসার প্রধান নির্বাহী নির্ভানা চৌধুরী প্রমুখ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পৃথিবীকে নিরাপদ করতে হলে আমাদের দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে। এ তিনটি বিষয় বাস্তবায়ন করা গেলে পৃথিবীকে নিরাপদ করা যাবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, পৃথিবীতে মোট সম্পদের ৫০ ভাগ মাত্র ৮৫ জন লোকের হাতে রয়েছে। অবশিষ্ট ৫০ ভাগ সম্পদের মালিক বাকি জনগণ। তাই সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হলে বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। এ জন্য বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসার যে ধারণা সেটি ছড়িয়ে দিতে হবে।
ড. ইউনূস বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই বেকারত্ব রয়েছে। কিন্তু আমাদের চ্যালেঞ্জ হলো একজন মানুষও বেকার থাকবে না। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছে সামাজিক ব্যবসা। তিনি বলেন, আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই ভুল। এখানে উদ্যোক্তা তৈরির উপায় নেই। মানুষকে দাস করে রাখা হয়। আমরা চাকরিপ্রার্থী হিসেবে শিক্ষার্থীদের তৈরি করছি, যা মানবিক গুণাবলীর অধিকারী হিসেবে এটি লজ্জার। ফলে আমাদের স্লোগান চাকরি প্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা।
তিনি বলেন, আমরা এখানে তরুণ বেকারত্বকে ফোকাস করছি। কারণ কোন মানুষ অন্যের চাকরি করার জন্য জন্ম নেয়নি। নিজের অন্তর্নিহিত সৃজনশীল শক্তি দিয়ে পৃথিবী গঠনে সবাই অবদান রাখতে পারে। কিন্তু এ ধারণা বাদ দিয়ে মানুষকে ভুল পথে চালানো হচ্ছে। সুযোগ পেলে সব মানুষের উদ্যোক্তা হওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা দেখছি ওপর শ্রেণীর কিছু মানুষের কাছে সম্পদের পাহাড়। আর নিম্ন শ্রেণীর মানুষ সম্পদ শূন্য। ফলে সম্পদশালীদের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে। আর বৈষম্য থাকলে টেকসই সমাজ হতে পারে না।
তিনি বলেন, চলতি বছরে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) শেষ হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী ধাপ হল টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)। এর অর্থ হলো সমস্ত বৈষম্য কমিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হবে।
ড. ইউনূস বলেন, পৃথিবী সৃষ্টির পর মানুষের সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে ৩০ হাজার বছর লেগেছে। এর পরবর্তী ২০ হাজার বছর পর ১৮০৪ সালে লোকসংখ্যা ১০০ কোটিতে উন্নীত হয়। বর্তমানে বিশ্বের লোকসংখ্যা ৭২৫ কোটি। তিনি মনে করেন, বর্তমানে প্রতি ১২ বছরে ১০০ কোটি লোক বাড়ছে। আর তাদের খাদ্য, পানি এবং বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণ আমাদের কাছে জমা নেই। তার মতে, পৃথিবীর সবকিছু দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে পুরনো ধ্যান-ধারণা দিয়ে আর চলা যাবে না। এতে দারিদ্র্য আরও বাড়বে।
অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, সামাজিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব হলো গ্রামীণ ব্যাংক। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের ২০ কোটিরও বেশি মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছে। এদের বেশিরভাগই নারী। তিনি বলেন, যদিও আমাদের দেশের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ। নাগরিকদের জীবন ব্যবস্থার মানদণ্ডের গড়ও সর্বোচ্চ। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এখনও অনেক আমেরিকান দরিদ্রতার সঙ্গে জীবনযাপন করে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এক-তৃতীয়াংশ পরিবারের প্রধান নারী। কিন্তু তারা দারিদ্র-সীমার নিচে বসবাস করে। ফলে এ অবস্থা উত্তরণে সামাজিক বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সামাজিক বাণিজ্য হচ্ছে এমন ধরনের ব্যবসা, যেখানে উদ্যোক্তারা সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিনিয়োগ করবেন। ব্যক্তিগত লাভ থাকবে না। সামাজিক ব্যবসাকে নিজের আয়েই নিজের যাবতীয় ব্যয় মিটাতে হবে। এ ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যবসার মুনাফাও পুনঃবিনিয়োগ করা হয়।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, এ ব্যবসার পুঁজি অমর। এটাই সামাজিক ব্যবসার শক্তি। এ ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা শুধু টাকাই নয়, তাদের সৃষ্টিশীলতা, যোগাযোগের দক্ষতা, প্রযুক্তিগত মেধা, জীবনের অভিজ্ঞতাসহ অনেক কিছুই বিনিয়োগ করে পৃথিবীটাকে পাল্টে দিতে পারে। সামাজিক ব্যবসার ৭টি মূলনীতি। এর মধ্যে রয়েছে- দারিদ্র্য বিমোচনসহ ব্যক্তিগত মুনাফাহীন কল্যাণকর ব্যবসা এটি, সবার অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন, বিনিয়োগকারীরা শুধু তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থই ফেরত পাবে, এর বাইরে কোন প্রকার লভ্যাংশ নিতে পারবে না, বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত নেয়ার পর পরবর্তী মুনাফা কোম্পানির সম্প্রসারণে ব্যবহৃত হবে, এ ব্যবসা হবে পরিবেশবান্ধব, এখানে চাকরিজীবীরা ভাল পরিবেশ ও চলমান বাজার অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাবেন এবং এটি হবে আনন্দের সঙ্গে ব্যবসা।
মূল অনুষ্ঠানে পাশে একটি ‘মার্কেটপ্লেস’ ছিল যেখানে বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসার পণ্য ও কর্মসূচির প্রদর্শনী করা হয়। মার্কেটপ্লেসে একটি বিশেষ মেলায় নবীন উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর প্রদর্শনীরও আয়োজন ছিল।
অনুষ্ঠানে তিনটি প্লেনারি সেশন ছিল নবীন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসার অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং আগামী দিনের রোড ম্যাপ। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঞ্চালনায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বক্তারা এসব সেশনে তাদের ধারণা ও কর্মসূচি সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
এ ছাড়া অনুষ্ঠানে ১২টি প্যানেল সেশন একই সময়ে সংগঠিত হয়। এগুলো হচ্ছে: সামাজিক ব্যবসা ও অ্যাকাডেমিয়া, নবীন উদ্যেক্তা রীতি-পদ্ধতি, সামাজিক ব্যবসা হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ব্যবসা ও প্রযুক্তি, সামাজিক ব্যবসায়ে অর্থায়নের উৎস, নবীন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং সামাজিক ব্যবসায়ের ওপর প্রশ্নোত্তর। বৃহত্তর চীনে সামাজিক ব্যবসার ওপর একটি বিশেষ প্যানেল ছিল। এ প্যানেল সেশনগুলোয় পৃথিবীব্যাপী সামাজিক ব্যবসার ধারণা, শ্রেষ্ঠ কর্মসূচিসমূহ, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয় এবং বক্তাদের মধ্যে মূল্যবান অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়।
এ বছরের সামাজিক ব্যবসা দিবসে কিছু নতুন উদ্যোগের ঘোষণা দেয়া হয়। এগুলো হচ্ছে: জাপান অটোমেকানিক ট্রেনিং স্কুল, গ্রামীণ ইনটেল সোশ্যাল বিজনেস লি., গ্রামীণ ইউগ্লেনা লি., গ্রামীণ ক্যালেডোনিয়ান নার্সিং কলেজ, ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস হেলথ হাব, ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস (অস্ট্রেলিয়া), আরএমআইটি অস্ট্রেলিয়ায় ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে সামাজিক ব্যবসা শর্ট কোর্স, সৌদি আরবের সেন্টেনিয়াল ফান্ড (সেন্টেনিয়াল ফান্ড থেকে উদ্যোক্তাদের জন্য প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের পূর্বশর্ত)। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে বেকার কলেজে ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সামাজিক ব্যবসা দিবস প্রতি বছর ২৮শে জুন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ বছর রমজানের কারণে অনুষ্ঠানটি এগিয়ে ২৮শে মে আনা হয়। একই কারণে আগামী বছরও সামাজিক ব্যবসা দিবস ২৮শে মে তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম সামাজিক ব্যবসা দিবস ২০১০ সালের ২৮শে জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর