ফুলের মূল্য

জন্মের পর জীবনের ঠিক কোন মুহূর্তে প্রথম ফুল দেখেছিলাম, কখন ফুল দেখে হেসেছিলাম, কখন ফুলকে ফুল বলে চিনেছিলাম তার কিছুই মনে নেই। বুদ্ধি হওয়ার পর আমাদের ঘরের সামনে ফুলের বাগান করতে দেখেছি আমার ছোটচাচাকে। তাঁর সাথে আমিও বাগানের আগাছা বাছতাম, ফুলগাছের গোড়ায় পানি দিতাম, বাগিচার পরিচর্যা করতাম, তাকে উপভোগ করতাম। ফুলের গাঢ় উজ্জ্বল বর্ণ আমাকে অবাক করে দিত! খুশবুতে মাতোয়ারা হয়ে যেতাম! এভাবে কখন যে ফুলকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলাম, তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। খালি যে ফুলই আমার ভাল লাগত তাই নয়, ফুলবাগানের সব অতিথিরাও ছিল সমানভাবে আমার মায়া-মমতার পাত্র। এখানে অতিথি বলতে আমি বোঝাচ্ছি – পোকামাকড়, মৌমাছি, প্রজাপতি, ফড়িং, পাখি ইত্যাদিকে। আমরা যেমন ফুলের সুবাস ও সৌন্দর্যে বিভোর হই আল্লাহ্র মখলুক কীট-পতঙ্গরাও হয়।
এই সেই ফুল, যা আমার জীবনে বারবার এসেছে, ঘুরেফিরে এসেছে, বিভিনড়ব পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে। কখনো দূর থেকে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, কখনো কাছে এসে হৃদয়-মনে দোলা দিয়েছে, বোধশক্তিকে জাগ্রত করেছে, অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে। আবার কখনো আমি নিজেই ফুল নিয়ে খেলেছি, মাখামাখি করেছি, ভুল করে ফুল ছিঁড়েছি, ফুল দিয়ে মালা গেঁথেছি, গলায় পরেছি, আবার ফেলেও দিয়েছি, তবু কারো কন্ঠে তুলে দেইনি, অথবা দেওয়ার মত কাউকে খুঁজে পাইনি। এ ব্যাপারে যা খুশি তাই ভাবতে পারেন। দীর্ঘ জীবনে ফুলের সাথে আমার আত্মীয়তা, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি একেকবার একেক রকম হয়েছে। তাদের কোনো একটার সঙ্গে আরেকটার মিল পাওয়া যায় না। আজ বয়সের শেষবেলা এসে আমি সেসবের একটা খতিয়ান নেওয়ার চেষ্টা

২: করছি, দেখছি তাদের মাঝে কোনো অর্থবহ যোগসূত্র বের করা যায় কিনা। যদি যায় তো ভাল, না গেলেও অসুবিধা নেই। জীবনে অনেক কিছু করতে গিয়েই তো ব্যর্থ হয়েছি – এ আর গোপন করে লাভ কী?
ফুল দিয়ে ঘর সাজানোর প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছে পাঠশালায় থাকতে। যেদিন পুজোর ছুটি হত সেদিন দেয়ালবিহীন, দুয়ার-ভাঙ্গা, হেলে-পড়া ইসকুলঘর খুব যতড়ব করে ফুল দিয়ে সাজাতাম। মাস্টারবাবু আসার আগেই এ কাজটা করতে হত, আর তাই ওই দিন ইসকুলে যেতে হত সকাল সকাল। এখন নিজেকে যখন প্রশড়ব করি, ছুটির দিন ফুল দিয়ে কেন ইসকুল সাজাতাম, তার কোনো উত্তর পাই না। এমন কাজ আপনারা কেউ করেছেন কিনা তাও জানি না। ইসকুল সাজাতে বড় বড় লাল ও হলুদ জবাফুল আনতাম বাড়ি বাড়ি ঘুরে বনবাদাড় ভেঙ্গে গ্রামের নমশূদ্র পাড়া থেকে। ফুল তুলতে তারা বাধা দিত না, কিন্তু আমরা যমের মত ভয় পেতাম তাদের ঘেউ ঘেউ করা কুকুরগুলোকে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে তো কুকুর বেঁধে রাখার রেয়াজ ছিল না সে সময়ে, কে জানে, হয়তো বা আজো নেই! এখানে একটা কথা না বলে পারছি না। মারমুখো পাগল মানুষকে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখতে দেখেছি, কিন্তু মানুষ-কামড়ানো কোনো কুকুরকে গলায় দড়ি দিয়েও কখনো বাঁধতে দেখিনি।
বাড়ির ঠিক সামনে মরা ধামাই গাঙের পারে ছিল তিন জাতের বড় বড় তিনটা ফুলের গাছ। এদের একেকটা আমার জীবনকে একেকভাবে আবেগাপ্লুত করত। প্রথমটা কদম। কদম ফুল মানেই বর্ষার আগমনী বার্তা। গাছে যখন ফুল ফুটত ঠিক তখনই ধামাই গাঙও ফুটত, অর্থাৎ নদীর পানিতে ¯্রােত বইত এবং নাও চলাচল শুরু হত। ওই কদম গাছের গোড়ায়ই বাঁধা হত আমাদের নৌকোগুলো। গাছ বাইতে পারতাম না, তাই নাওয়ের লগি দিয়ে কদম ফুল পাড়তাম। একটা ফুল হাতে তুলে ঘ্রাণ নিতে অনেকগুলো তাজা সবুজ পাতাকে শহীদ করতে হত, বিষয়টা এখন যেভাবে বুঝি তখন সেভাবে মাথায় আসত না। কদম ফুলের সাদা

৩: সাদা লম্বা লম্বা চিকন কাঁটার মাথায় ফুলের রেণু থাকত, সেগুলো হাতে, গায়ে ও মুখে মাখতাম। হলুদ ফুলদল ছিঁড়ে জমা করতাম, দোকান দিতাম, কেনাবেচা খেলা খেলতাম। সেমাই দানার মত সাদা সাদা পাপড়িকে বানাতাম চিনি আর হলুদগুলো হত গুড়। চিনি চড়া দামে বিμি হত, আর গুড় সস্তায়। তার মানে তখন বুদ্ধি সুদ্ধি কিছু হয়ে গেছে, কেননা চিনি আর গুড়ের দামের তফাৎটা বুঝে গেছি। দোকানের খদ্দের ছিল

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর