অ্যাসেম্বলি হল ছিল আন্দোলনের কন্ট্রোল রুম

জাকারিয়া চৌধুরী। সাবেক মন্ত্রী ও উপদেষ্টা। বর্তমানে দৈনিক মানবকণ্ঠ পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বড় পরিচয় একজন মহান ভাষা সৈনিক।
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে। থাকতেন নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরলেন পূর্বপশ্চিবিডি ডটকমের কাছে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌফিক মাহমুদ। ছবি তুলেছেন দ্বীপময় চৌধুরী ডিউক।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট কেমন ছিলো?

জাকারিয়া চৌধুরী: ২০ ফেব্রুয়ারি থেকেই পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে চারদিক বেরিকেড দিয়ে থাকে। ওইদিন সন্ধ্যায় নবাবপুর রোডের এক গলিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জরুরী বৈঠকে মিলিত হই। ওখানে সব সিনিয়র ভাইরা ছিলেন। আমাকে তারা পছন্দ করতেন বলে জুনিয়রদের মধ্য থেকে আমি ছিলাম। তখনও ভাবিনি, পরের দিন আমরা সালাম, রফিক, বরকত ও জব্বারের রক্তের বিনিময়ে ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছি।

সভায় সভাপতি ছিলেন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মরহুম সৈয়দ শামসুল হক, যিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধরণ সম্পাদক ছিলেন। সভার কাজ ভোর ৩টা পর্যন্ত চললেও সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হবে কি হবে না- সে বিষয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়নি।

যতদূর মনে পড়ে, মতিন ভাই, তোহা ভাই, ইব্রাহীম তাহা ভাই ১৪৪ ধারা অমান্য করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। আমিও মনে প্রাণে তাদের দলে ছিলাম। কিন্তু শামসুল হক ভাইসহ দুইচারজন যুক্তি দেখালেন, প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করার মতো যথেষ্ট জনমত আমাদের নেই। তাই এমন সিদ্ধান্ত হঠকারি হবে।

২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় আমতলায় ছাত্র সমাবেশের সিদ্ধান্তও হয় বৈঠকে। আর ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিষয়টি সমাবেশে ঠিক হবে বলে সবাই মত দিলেন।

পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি অনেকেই নির্ধারিত সময়ের আগেই উপস্থিত হন। আমার ক্ষোভ এতই ছিলো যে, না খেয়ে সকাল ৯টায় সভাস্থলে হাজির হই। এরপর মধুর চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ বসলাম। ওই জায়গাটি ছিলো আমাদের মূল পাঠ্যশালা। ক্লাশ খুবই কম করতাম। যাই হোক, ওইসময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মতামত প্রকাশ করে বক্তৃতা করেন এ্যাডভোকেট গাজীউল হক। আমরা যারা এর পক্ষে ছিলাম তারা এই বক্তৃতায় খুশি হই। এই প্রশ্নে সমবেত শিক্ষার্থীদের মতামত চাইলে তারাও সমস্বরে এর পক্ষেই মত দেয়।

ওইদিন তুমুল আন্দোলন হয়। মিটিংটিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শামসুল হক ভাই। ক্যাম্পাস থেকে ১০জন করে বের হয়ে ১৪৪ ধারাকে প্রতীকীভাবে ভঙ্গ করা হতো। আর তাদেরকে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতো।

একসময় আমরা চিন্তা করলাম এভাবে তো সম্ভব নয়, একযোগে আন্দোলন করতে হবে। পুলিশও বোঝেনি যে, হঠাৎ এতোবড় মিছিল শুরু হবে। আমতলায় পৌঁছতেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। লোকজন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এক পর্যায়ে আমিসহ বেশ কয়েকজন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে লালবাগ থানা হয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে কারারুদ্ধ হই। ওটাই আমার প্রথম ও শেষ কারাভোগের অভিজ্ঞতা।

কারাগারে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে আংশিক খবরাখবর পাই। সম্পূর্ণ খবর পাই মাসখানেক বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে জানতে পারি হতাহতের কথা। তারা জানায়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল হয়ে উঠেছিলো আন্দোলনের কমান্ডিং পোস্ট। ওই কয়দিনে অর্থাৎ ২৭ বা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আন্দোলন অনেক বেগবান হয়, পরবর্তীতে তো আমরা দাবি আদায়ে সক্ষম হই।

সলিমুল্লাহ হলের আরও কোনো স্মৃতি?

জাকারিয়া চৌধুরী: ওইসময় আমি প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। থাকতাম এস এম হলে। মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হল রুপান্তরিত হয় আন্দোলনের কন্ট্রোল রুমে। স্কোয়াড করে কর্মীদের পাঠানো হয় ঢাকার মহল্লার সরদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। এস এম হলের দোতলায় চতুর্দিকে মাইক্রোফোনের লাউড স্পীকার বসানো হয়েছিলো। প্রতিদিন হাজারো জনতা অধীর আগ্রহে বক্তব্য ও পরবর্তী কর্মসূচি জানতে এখানে জড়ো হতো। এখান থেকে দেয়া কর্মসূচি তারা স্বত:স্ফূর্তভাবে পালন করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সক্ষম হয়। সে কয়দিনের মুসলিম হলের আন্দোলন মনে করিয়ে দেয় ফরাসী বিপ্লবের সময়ে জনতার মঞ্চের কথা।

ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন কারা?

জাকারিয়া চৌধুরী: নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক সংগঠন এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়নি। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী আর জনগনই ভাষা আন্দোলনের মূল কারিগর ও নেতৃত্বে ছিলেন।তাদের পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা অংশ নিতেন এবং বক্তব্য দিয়ে আন্দোলনকে উস্কে দিতেন। আর যাদের নাম এখন বেশি শোনা যায় তাদের অনেকেই ওইদিন (২১ ফেব্রুয়ারি) বড় মিছিলে ছিলেন না। তবে নেতৃত্বে এমন একজন ছিলেন যিনি কোনো রাজনীতি করতেন না। তিনি একজন টেনিস খেলোয়ার ছিলেন। নাম তার একরামুল হক। সবাই তাকে আসাদ ভাই বলেই জানতাম। ইতিহাস তার নাম জানবে না। কেননা ভাষা আন্দোলনের দাবীদাররা তার নাম উচ্চারণ করেন না বা জানেন না।

আরেকজনের নাম খুব মনে পড়ে। তিনি হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: দ্বীপু মনির বাবা ওয়াদুদ ভাই। ইতিহাসের সব কথাই সত্য নয়। অনেক সত্যই প্রচারের অভাবে চাপা পড়ে যায়। তাই বলে কি তাদের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ? যে ফুল লোক চক্ষুর আড়ালে আপন মহিমায় প্রস্ফুটিত হয়ে ঝড়ে পড়ে, স্থান পায় না কোনো দোকান বা ফুলদানীতে, তার মূল্যয়ন কিভাবে হবে?

আপনি ওই সময় রাজনীতি করতেন?

জাকারিয়া চৌধুরী: সরাসরি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। তবে আদর্শগতভাবে বাম ঘরানার সমাজতন্ত্রপন্থি রাজনীতিকে পছন্দ করতাম।

কোন প্রেক্ষাপটে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা ভাবলেন?

জাকারিয়া চৌধুরী: ‘৪৭ সালেই সীমিত আকারে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। এরপর চারবছরের মতো কেটে যায়। এরমধ্যে লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পরে খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন। আমরা ভাবলাম, এতদিন পরে একজন বাঙ্গালী মূখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি আমাদের দু:খ বুঝবেন। ‘৫২ সালের জানুয়ারিতে তিনি প্রথম সফরে ঢাকার পণ্টন ময়দানে মিটিং ডাকলেন। আমরা সবাই গেলাম। দেখি নাজিমুদ্দিন কি বলেন? কিন্তু তিনি ওইখানে বক্তৃতায় বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তখন বুঝলাম, বাস্তবে তিনি একজন সাচ্চা পাকিস্তানি।

নাজিমুদ্দিনের কথার পরে আমরা নিরাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি। সবাই ঘরে ফিরলাম। সবার মুখে মুখে একই কথা আন্দোলন করেই দাবি আদায় করতে হবে। এরপর আমরা ৪ ফ্রেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট ডাকলাম। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো। সেখানেই সিদ্ধান্ত হলো পুরো পূর্বপাকিস্তানে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। এভাবেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি।

আন্দোলনের দিনগুলোতে কোন ধরণের দায়িত্ব পালন করতেন আপনি?

জাকারিয়া চৌধুরী: এখন তো ছাত্র নেতারা গাড়ি ব্যবহার করেন। তখন আমরা হেঁটে হেঁটে কাজ করতাম। সদরঘাট থেকে চকবাজার পর্যন্ত আমার দায়িত্ব ছিলো। মিটফোর্ড রোড, ইসলামপুর রোড, বাবুবাজার, সদরঘাট, চকবাজার এলাকায় সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে ক্যাম্পেইন করতাম। অন্যান্য জায়গায় আলাদা গ্রুপ কাজ করতো। প্রতি গ্রপে ৪-৫ জন ছিলো। রিক্সা ভাড়া করে চোঙ্গাওয়ালা মাইক দিয়ে বক্তৃতা ও পথসভা করতাম। ৪ ফেব্রুযারির পরে আমরা ১৫ দিন ক্যাম্পেইন চালিয়েছি বলেই আন্দোলন জোরদার হয়।

ভাষা আন্দোলনে বেশি সহায়তা করেছেন কারা?

জাকারিয়া চৌধুরী: আন্দোলনকে ধরে রেখেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। প্রত্যেকদিন বিকেলে উর্দু রোড, লালবাগ, চকবাজার প্রভৃতি এলাকা থেকে লোকজন এসে এখানে জড়ো হতো। তখন এতো স্থাপনা ছিলো না। পুরোটাই ছিলো খালি। হল থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হতো। ছেলেরা পাড়া-মহল্লায় লোকজনকে ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে যেতো। ওইসময় মহল্লার সরদারগণ খুব প্রভাবশালী ছিলেন, কাদের সরদার, মতি সরদার, সবার নামও মনে নেই। তারা আমাদের পক্ষে মহল্লার লোকদেরকে সংগঠিত করতো। ওরা ছিলো আমাদের শক্তির শক্তিশালী মাধ্যম। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ওরা বিভিন্ন ধরণের সাহায্য ও সহায়তা করেছে।

কিন্তু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গোলাগুলিতে যারা হতাহত হয়েছে তারাই বেশি প্রচারে এসেছেন। অথচ আড়ালে চাপা পড়েছেন অনেকে, যারা আন্দোলনের প্রাণ যুগিয়ে তা ধরে রেখে একটা স্বার্থক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিবারের সহায়তা কেমন পেয়েছেন?

জাকারিয়া চৌধুরী: বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকরাই আমাদের সমর্থন ও সহায়তা করেছেন। কেউ কেউ ভয়ে চুপ ছিলেন। তবে পরিবার থেকে অনেকেই তেমন সমর্থন পাননি। আমার বাবা তখন কুষ্টিয়ার ডিসি ছিলেন। তিনি চাইতেন না আমি আন্দোলনে থাকি। কারণ তিনি সরকারি চাকরি করেন, সমস্যা হতে পারে। আর অধিকাংশ অভিভাবকই চান না, তাদের সন্তানরা পড়াশুনা বাদ দিয়ে আন্দোলন করুক, হুমকির মুখে পড়ুক। তারপরও আমরা দেশ ও আদর্শের কথা ভেবে পিছপা হয়নি।

যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে ভাষা আন্দোলন করেছেন, তা কতটুকু পূরণ হয়েছে?

জাকারিয়া চৌধুরী: বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালিত্বের উপর ভিত্তি করে আমরা ভাষা আন্দোলন করেছিলাম। শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে সবার সঠিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করেছিলাম আমরা। স্বাধীনতা পেলাম, বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পেলো, দেশে অনেক স্থাপনা হলো, উন্নয়ন ও অগ্রগতি হলো। কিন্তু আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপটে আজও মূল আদর্শ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।

আগে তো সমাজে একই প্রকারের মানুষ ছিলো। হাতে-গোনা দু’একজন ধনী ছিলো। কিন্তু এখন কিছু লোক দিনে দিনে সম্পদের পাহাড় গড়ছে, আর অন্যেরা বঞ্চিত হচ্ছে। জনগণের কষ্টের টাকা তারা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। তাই মনে হচ্ছে সামাজিক ব্যবধানটা দিনে দিনে বাড়ছে। পুরনো নিয়ম কানুন দিয়ে দেশ চলাটাই এখানে প্রধানত দায়ি।

আশার দিক কিছু দেখছেন?

জাকারিয়া চৌধুরী: শুধু ভাষা ও স্বাধীনতা অর্জনের যুক্তিতে তুষ্ট না হয়ে সামাজিক সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হতে সংগ্রাম করে যেতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না আনতে পারলে স্বাধীনতা ও পতাকা সবই বিপন্ন হয়ে পড়বে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এখনো আশা ছাড়িনি। কিন্তু আশার আলো ক্রমশই স্তিমিত হয়ে আসছে। জানি না, মৃত্যুর আগে দেশকে নিয়ে উজ্জল ভবিষ্যতের আলো প্রজ্বলিত দেখতে পাবো কিনা? নতুন প্রজন্ম যদি এই দায়িত্ব নেয় তবে সফলতা আসতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর